জাহেলিয়া যুগের ধর্মীয় অবস্থা
ধর্মীয় পাপাচার আর সামাজিক অনাচারের মিশ্রণে আরবে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। একত্ববাদের স্থলে বহু ঈশ্বরবাদ আরব সমাজকে চরম অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেয়। এ সময় আরবে মোটামুটি চার ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাসসম্পন্ন লোকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। যথা- ইহুদি, খ্রিস্টান, মূর্তিপূজক ও হানিফ সম্প্রদায়।
ইহুদিবাদ :
ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে হিমারীয় রাজা আবু কাদির আসাদ দক্ষিণ আরবে ইহুদি ধর্ম প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে রাজা যুনাওয়াস শক্তি প্রয়োগে ইহুদি মতবাদ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালান। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের প্রাক্কালে উত্তর আরবের বিভিন্ন এলাকায় বনু নযির, বনু কোরায় এবং মদিনার উপকণ্ঠে বনু কায়নুকা প্রভৃতি ইহুদি উপনিবেশ গড়ে ওঠে। ইহুদিরা অজ্ঞতাবশত জাহহাবাকে বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা মনে করতো। তারা হযরত মুসা (আ.)-এর শিক্ষা ভুলে গিয়ে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। খোদায়ী বিধানের সাথে তারা নিজেদের মনগড়া বিধান যুক্ত করে।
খ্রিস্ট্রবাদ :
হযরত ঈসা (আ.) ছিলেন আল্লাহর রাসূল। তিনি তাঁর উম্মতকে এক আল্লাহর দিকে আহবান জানিয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা ঈসা (আ.)-কে উঠিয়ে নেয়ার পর তাঁর উম্মত অজ্ঞতাবশত একত্ববাদের পরিবর্তে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। তারা হযরত মরিয়ম (আ.)-কে আল্লাহর স্ত্রী, ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র এবং আল্লাহসহ তিন স্রষ্টায় বিশ্বাস শুরু করে (নাউযু বিল্লাহি-মিন-যালিক)। ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় দু’জন নবীর উম্মত হয়েও তারা নবীর বিশ্বাস রদপূর্বক নতুন মতবাদ চালুর মাধ্যমে ধর্মীয় বিশ্বাসে অনাচারের সৃষ্টি করে। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের পূর্বে তারা। প্রত্যেকেই দাবি করতো, সর্বশেষ নবী তাদের গোত্র থেকে আগমন করবেন। ইহুদি খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ই একে অন্যের বিরুদ্ধে সর্বদা বিদ্বেষ ছড়াতো। আল কুরআনে তাদের বিবাদের বর্ণনা এসেছে এভাবে-“ইহুদিরা বলত নাসারারা (খ্রিস্টান) সত্যের ওপর নেই; অন্যদিকে নাসারারা বলত ইহুদিরা সত্যের ওপর নেই, অথচ তারা উভয় সম্প্রদায়ই কিতাব অধ্যয়ন করতো।
পৌত্তলিকতা বা মূর্তিপূজা :
ইহুদি-খ্রিস্টানদের ছাড়া আরব দেশে ব্যাপকভাবে মূর্তিপূজক সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। প্রাচীনকাল থেকেই কাবা গৃহকে পবিত্র স্থান মনে করা হতো। বিশ্বের বিভিন্ন জনপদ থেকে লোকেরা কাবায় হজ্জ করতে আসত। আরবরা কাবা গৃহে বিভিন্ন গোত্রের পূজ্য ৩৬০টি মূর্তির অবয়ব স্থাপন করে সেগুলোর পূজা করতো। এ সকল মূর্তির মধ্যে পূর্ববর্তী নবী হযরত ইবরাহীম, ইসমাঈল, ঈসা ও মরিয়মের মূর্তিও ছিল। এছাড়া লাত, মানাত, ইয়াগুস, নাসরও ছিল অন্যতম প্রধান প্রধান মূর্তি। মনুষ্যাকৃতির হোবল ছিল কাবাঘরে স্থাপিত প্রধান বিগ্রহ।
কোনো আরব অনারব নয়, কোনো স্থানকালের জন্য নয়; বরং কুসংস্কারের সব জাল ছিন্ন করে তাওহীদের বাণী প্রচার করার জন্যই মহানবী (সা.) মক্কানগরীতে আবির্ভূত হন। তিনি অনন্ত কল্যাণ ও আপসহীন তাওহীদের প্রতীক। ঐতিহাসিক পি কে Refu zaitez 1619- The stage was set the moment was psychological, for the rise of a great religious and national leader. এ সময় মহান ধর্মীয় ও জাতীয় নেতার আবির্ভাবের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত হয়েছিল এবং সময়ও ছিল মনস্তাত্ত্বিকতাপূর্ণ।
জাহিলিয়া যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ করে বলা যায়, তারা অধঃপতনের সর্বনিম্ন স্তরে উপনীত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা অগ্নির অতল গহবরে নিমজ্জিত ছিলে। পরিবেশপরিস্থিতি একজন মহান পুরুষের আবির্ভাবের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিল, সময়টাও ছিল মনস্তাত্ত্বিকতাপূর্ণ। অবশেষে আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সা.) এই ধরাপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়ে আরবগণকে এক মহান ধর্মের ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেন।
হানিফ সম্প্রদায় :
এমন ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগেও আরবের কতিপয় লোক আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তারা স্বতন্ত্র দ্বীন পালন করতেন এবং কোনো প্রকার মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতেন না। পৌত্তলিক আরবে তারা ‘হানিফ' নামে পরিচিত ছিলেন। বিবি খাদিজার চাচাতো ভাই ওরাকা বিন নওফল, উমাইয়া বিন আবিস সালত, আওস বিন সাওদা, কবি যুহায়র প্রমুখ বিশিষ্ট আরববাসী ছিলেন একমাত্র সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী হানিফ সম্প্রদাভুক্ত। আরব তথা সমগ্র বিশ্বের নৈরাশ্যজনক ধর্মীয় কোনো এক ঐশ্বরিক ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের পূর্বাভাস সূচনা করেছিল। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন- Never in the history of the world was need so great, the time so ripe for the appearance of a deliverer. অথ্যাৎ “পৃথিবীর ইতিহাসে এ পরিপক্ব সময়ের মতো কোনো কালেই একজন উদ্ধারকারীর প্রয়োজনীয়তা এত বেশি অনুভূত হয়নি।”
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions