জাহেলিয়া যুগের সামাজিক অবস্থা
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। বিভিন্ন পাপাচার, ব্যাভিচার, দুর্নীতি, কুসংস্কার, অনাচার, অরাজকতা, ঘৃণ্য আচার-অনুষ্ঠান ও নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডে সমাজ কলুষিত হয়ে পড়েছিল। গোত্রভিত্তিক আরব সমাজের দুটো পৃথক শ্রেণি মরুবাসী বেদুইন এবং শহরবাসী আরবদের জীবনযাত্রা প্রণালি ছিল একই সূত্রে গাঁথা। উভয় শ্রেণির বৈবাহিক সম্পর্ক ও আচার অনুষ্ঠান, ধ্যানধারণা ও রীতিনীতি ছিল প্রায় একই রকম।
মদ ও জুয়া : ঐতিহাসিক খোদা বখশ-এর মতে, War, Women and Wine were three absorbing passions of the Arabs, অর্থাৎ, মদ, জুয়া ও নারী- এ তিনটি ছিল আরবদের মুখ্য নিত্যব্যবহার্য বস্তু। মদ এবং নর্তকী ছাড়া তাদের জীবন কল্পনাও করা যেত না। তারা মদ্যপানে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। মাদকাসক্ত আরবরা যে কোনো গর্হিত কাজ করতে দ্বিধা করতো না। তকালীন আরব দেশে মদ্যপান ও জুয়া খেলা কত লোককে যে সর্বস্বান্ত করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
নারীর অবস্থান : ঐতিহাসিকদের প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী সে যুগে আরব, রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যসহ সমগ্র বিশ্বে সমভাবে নারীর অবস্থা ছিল সীমাহীন অবমাননাকর ও হৃদয়বিদারক। তারা ভোগের সামগ্রী ও অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হতো। সমাজে তাদের কোনো রকম মান-মর্যাদা বা অধিকার ছিল না। একজন পুরুষ যত খুশি বিয়ে করতো এবং যত খুশি তালাক দিতে পারত। তৎকালীন আরবে চার ধরণের বিবাহ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
প্রথমতঃ এক নারী-পুরুষের বিয়ে।
দ্বিতীয়তঃ এক ব্যক্তি একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতো।
তৃতীয়তঃ একজন স্ত্রীলোক একাধিক পুরুষকে বিয়ে করতো।
চতুর্থতঃ পন্থাটি ছিল বর্তমান সময়ের পতিতালয়ের মতো। একজন রমণী তার গৃহের সামনে একটি নির্দিষ্ট পতাকা স্থাপন করে রাখত। এর মাধ্যমে লোকজন গৃহটি শনাক্ত করতে সক্ষম হতো। মোটকথা, মানবতা-বিবর্জিত জাহিলী যুগে নারীর কোনো মূল্যই ছিল না। নারীকে আপদ অশুভ বলে মনে করা হতো।
কন্যা সন্তানদের অবস্থা: জাহিলী যুগে কোনো ব্যক্তি তার কন্যা সন্তানের জন্মে খুশি হতো না। কন্যার জন্ম সংবাদ দেয়া হলে তাদের চেহারা লজ্জায় কালো হয়ে যেত। এটা তাদের নিকট ছিল এক চরম লজ্জার ব্যাপার। অনেক পিতা এ চরম লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য, আবার অনেকে দারিদ্র্যের ভয়ে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিতেও কুণ্ঠাবাধ করতো না।
দাসপ্রথা: প্রাচীনকাল থেকেই আরব সমাজে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। শুধু আরব নয়, সমকালীন সমগ্র বিশ্বেই দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। মানুষ মানুষের প্রভু, মানুষ মানুষের দাস। বাজারে পণ্যদ্রব্যের মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তাদের বিক্রি করা হতো। বিভিন্ন যুদ্ধে বন্দি হয়ে আসা কিংবা জোরপূর্বক ধরে আনা মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলা পরিয়ে দেয়া হতো। কখনো বা পরিশোধে অক্ষম ঋণ গ্রহীতা ঋণদাতার ক্রীতদাসে পরিণত হতো। আবার অনেক সময় জুয়া খেলায় অনবরত হারতে হারতে ব্যক্তিটি বিজয়ী লোকের ক্রীতদাস হয়ে যেত। এভাবে ক্রীতদাস প্রথার সৃষ্টি হয়েছিল। দাস-দাসীদের সামাজিক ও ব্যক্তি অধিকার বলতে কিছুই ছিল না। মনিবের ইচ্ছাই ছিল সবকিছু। এমনকি বিয়ের অধিকারও তাদের ছিল না। কেউ। যদিও বা বিয়ের অনুমতি পেত, তবে তার সন্তানের মালিক হতো মনিব । সামান্যতম অপরাধেও দাসদের নিষ্ঠুর নির্যাতন। করা হতো। তাদের দুরবস্থা সম্পর্কে সৈয়দ আমীর আলী বলেন- “ভূত্যই হোক আর ভূমিদাস হোক, তাদের ভাগ্যে ক্ষীণ আশা তথা এক কণা সূর্যরশ্মিও কবরের এদিকে অর্থাৎ ইহজীবনে জুটত না।”
সুদপ্রথা: জাহিলী যুগের সমাজব্যবস্থায় সুদ ছিল শোষণের হাতিয়ার। সুদের পরিমাণ ছিল কখনো কখনো একশ ভাগ; আবার বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে স্থানভেদ দুশ ভাগ পর্যন্ত। প্রাক্ ইসলাম যুগে আরবে ইহুদিরা সুদের ব্যবসায় করতো। তারা দরিদ্র আরবদের থেকে এত উচ্চহারে সুদ আদায় করতো, অনেক সময় ঋণগ্রহীতা উচ্চহারে সুদ পরিশোধে ব্যর্থ হতো। সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে ঋণগ্রহীতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সাথে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকেও ঋণদাতা জোর করে নিয়ে যেত।
ব্যাভিচার : ব্যভিচার বেহায়াপনা আরব সমাজে একটি গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্যভিচারের মাত্রা এত অধিক ছিল, স্বামী স্বীয় স্ত্রীকে অন্য লোকের সন্তান গর্ভে ধারণের অনুমতি দিত। পিতার মৃত্যুর পর সন্তানরা বিমাতাকে স্ত্রীরূপে। গ্রহণ করতো। একই সময়ে একজন স্ত্রীলোকের একাধিক স্বামী থাকত। অনেক সময় ভ্রাতা ভগ্নি এবং সত্য ও পুত্রের মাঝে। বিয়ে সংঘটিত হতো। সামাজিক অনাচার ব্যভিচার, নৈতিক অধঃপতন, লাম্পট্য, চরিত্রহীনতা, মদ্যপান, জুয়া, লুটতরাজ, নারীহরণ, কুসীদ প্রথা প্রভৃতি নানা অব্যবস্থায় আরব সমাজ কলুষিত ছিল।
কুসংস্কার : কোনো কাজ আরম্ভ করার পূর্বে কুসংস্কারের বশবর্তী আরবরা তীরের সাহায্যে দেব মূর্তির সাথে পরামর্শ করে নিত। কোনো লোক মারা গেলে তার উট কিংবা ঘোড়া তার কবরের পার্শে এ বিশ্বাসে বেঁধে রাখা হতো, মৃতব্যক্তি কোনো এক সময় কবর থেকে উঠে কবরের পাশে বেঁধে রাখা সওয়ারীর পিঠে আরোহণ করে অজ্ঞাত গন্তব্যে যাত্রা করবে।
নিষ্ঠুরতা : জাহিলী যুগের আরব সমাজ ছিল নিষ্ঠুরতায় ভরপুর। অভিজাত আরবরা নিছক খেলাচ্ছলে নারীদের ঘোড়ার লেজের সাথে বেঁধে ঘোড়া ছুটিয়ে দিত। এতে হতভাগা নারীর মৃত্যু হলে তা প্রত্যক্ষ করে তারা আনন্দ উল্লাস করতো। কন্যা সন্তানদের তারা জীবন্ত কবর দিত এবং হাসতে হাসতে তারা একে অপরকে খুন করতেও দ্বিধা করতো না।
আভিজাত্য ও অহংকার: সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সব মানুষের মর্যাদাই আল্লাহর কাছে সমান। অথচ জাহিলী যুগে আরবের নেতৃস্থানীয় লোকেরা মানুষকে বহু দলে বিভক্ত করে রেখেছিল। গরিব, অসহায় লোকদের প্রতি ছিল তাদের চরম ঘৃণা। অহংকার, আত্মম্ভরিতা, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা প্রভৃতি কারণে তাদের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ প্রকট আকার ধারণ করেছিল।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions