Home » » খলিফা আল মামুনের শাসন আমলে জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতি

খলিফা আল মামুনের শাসন আমলে জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতি

খলিফা আল মামুনের শাসন আমলে জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতি

খলীফা আল মামুনের শাসনকাল ইতিহাসের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গৌরবজনক অধ্যায়। এই সময়ে আব্বাসীয় ইতিহাসের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য চরম শিখরে উপনীত হয়। আল-মামুনের রাজদরবার হয়ে ওঠে জ্ঞানীগুণী, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, হাদিসবেত্তা ও মনীষীদের মিলনমেলা। খলীফা উদার হস্তে এই সকল গুণী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন।


ইসলামের গৌরবময় যুগ

খলীফা আল-মামুনের শাসনকাল ছিল ইসলামের ইতিহাসের গৌরবময় যুগ। এই যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ তাঁর পূর্ববর্তী সকল সময়কে ছাড়িয়ে যায়। তাঁর সময়ে ইসলাম ও বিশ্বের কৃষ্টি সভ্যতার ইতিহাসের সর্বাধিক মানসিক জাগরণের সূত্রপাত হয়। ইউরোপীয় নবজাগরণ ও আধুনিক সভ্যতা তারই সুচিন্তিত ভাবধারা ও দূরদর্শিতার ফল। এই প্রসংগে সৈয়দ আমীর W 161694, Mamun's reign was unquestionably the most brilliant and glorious of all in the history of Islam. 


শিক্ষা প্রসারে ভূমিকা 

আল-মামুন মনে করতেন জনগণের সুখ-সমৃদ্ধি নির্ভর করছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতির উপর। তাই তিনি সাম্রাজ্যের সর্বত্র বহু স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এজন্য প্রচুর অর্থদান ও লাখেরায সম্পত্তি দান করেন। তিনি মসজিদ ও মাদ্রাসাকে ব্যাপকভাবে স্থায়ী আয়ের মধ্যে নিয়ে আসেন। চীন দেশের অনুকরণে কাগজ কল স্থাপন করেন। 


অনুবাদ কার্যবলি 

খলীফা আল-মনসুরের সময় প্রথম অনুবাদ কার্যের সূচনা হয়। খলীফা আল-মামুনের সময় তাঁর পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তিনি সিরিয়া, এথেন্স, এশিয়া, মিসর প্রভৃতি দেশ হতে প্রাচীন গ্রন্থসমূহ সংগ্রহ করেন এবং তা বিখ্যাত পণ্ডিতদের দ্বারা অনুবাদ করেন। প্লেটো, এরিস্টটল, গ্যালেন, হিপোক্রিটাস প্রভৃতি দার্শনিকের গ্রন্থসমূহ আরবী ভাষায় অনুবাদ করা হয়। খলীফা লিউকের পুত্র কোস্টার উপর গ্রিক, সিরিয়া ও ক্যালদীয় ভাষায় গ্রন্থাবলি, মানকাহ এবং দুবান নামক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের উপর সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থসমূহ, ঈসা ও মুসার (আ.) উপর পারসিক ভাষায় লিখিত গ্রন্থসমূহ অনুবাদ করান। তিনি স্বর্ণমুদ্রার দ্বারা অনুবাদকদের পারিশ্রমিক দিতেন।


বাইতুল হিকমা প্রতিষ্ঠা 

৮৩০ খ্রি: প্রতিষ্ঠিত বায়তুল হিকমা ছিল খলীফা আল-মামুনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কীর্তি। বাইতুল হিকমা (House of Wisdom) ছিল অনুবাদ কর্ম পরিচালনার জন্য একটি গ্রন্থাগার। এর মােট ৩টি শাখা ছিল। এগুলো হল- গ্রন্থাগার, শিক্ষায়তন ও অনুবাদ বিভাগ। হুনায়ন ইবনে ইসহাকের উপর এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। সকল পণ্ডিতগণ এই প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনভাবে গবেষণা করার সুযোগ পান। এই সকল মনীষীদের গবেষণার ফসল আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতাকে বিনির্মাণ করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এ যুগে অনুবাদের পাশাপাশি বিজ্ঞানচর্চায় ও বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল।


বিজ্ঞান চর্চা 

বিজ্ঞান গবেষণা ও চর্চায় এই যুগ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জন করে। যে সময় ইউরোপ অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল ঠিক সেই সময় ইয়াহিয়া-বিন-আল-মনসুর, সিন্ধ-বিন-আলী, খালিদ-বিন-আব্দুল মালিক প্রমুখ খ্যাতনামা গণিত ও জ্যোতির্বিদ পৃথিবীর আকৃতি, গ্রহ, নক্ষত্র, বিষুবরেখা, ধুমকেতু ইত্যাদি বিষয়ের উপর মূল্যবান তথ্য আবিষ্কার করেন। 


দূরবীক্ষণযন্ত্র ও নৌ-কম্পাস আবিষ্কার

খলীফা আল-মামুনের সময়ে আবুল হাসান নামক একজন বৈজ্ঞানিক দূরবীক্ষণ যন্ত্র ও নৌ-কম্পাস আবিষ্কার করেন। এছাড়া মুসা-আল-খাওয়ারিজমী নামক বিখ্যাত গণিত ও ভূগোলশাস্ত্রবিদ এই যুগে আবির্ভূত হন। তাঁর রচিত “হিসাবুল জবর ওয়াল মুকাবালাহ” গণিত শাস্ত্রের একটি প্রাচীনতম গ্রন্থ। 


চিকিৎসা ও রসায়ন শাস্ত্র 

চিকিৎসা ও রসায়ন শাস্ত্রে এই যুগে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। উহান্না-বিল-মােসাওয়াহ চিকিৎসাশাস্ত্রে ও জাবির ইবনে হাইয়ান রসায়ন শাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। 


ফারসি সাহিত্যে ধর্ম ও দর্শন 

খলীফা আল-মামুনের সময়ে ফারসি সাহিত্য নবজীবন লাভ করে। ফারসি কবিতার জনক আবুল আব্বাস তাঁর সভাকবি ছিলেন। প্রসিদ্ধ হাদীস সংগ্রাহক ইমাম বুখারী, ঐতিহাসিক ওয়াকিদী ও ইবনে সাদ ইমাম শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল ও দার্শনিক আল-কিন্দি তার শাসনকালকে গৌরবান্বিত করেন। 


হস্তলিপির বিকাশ 

খলীফা আল-মামুনের সময়ে হস্তশিল্পের বিশেষ উৎকর্ষ সাধিত হয়। এই সময়ে বিখ্যাত হস্তলিপিকার ছিলেন আবু রায়হান। তাঁর নামানুসারে তাঁর লিখন পদ্ধতিকে বলা হত ‘রায়হানী লিপি।


মুতাযিলা মতবাদের প্রচলন 

খলীফা আল-মামুনের সময়ে মুতাযিলা মতবাদ ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। খলীফা একজন উদার ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মাঝে কোন ধর্মীয় গোঁড়ামী ছিল না। তিনি যুক্তিবাদী মুতাযিলা মতবাদকে গ্রহণ করেন ও রাজধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেন। 


মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগ

খলীফা আল-মামুনের সময় মুক্তবুদ্ধির চর্চা ছিল স্বীকৃত। বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, ইতিহাস সকল ক্ষেত্রেই এই যুগ ইসলামের ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করেছে। এই যুগ কেবল ইসলামের ইতিহাসেই নয়, সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অভূতপূর্ব জাগরণ ও উন্নতি বহন করেছিল। এটি ছিল মুসলিম ও ইসলামের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ (The Golden Age of Islamic Civilization)। এই যুগ ইতিহাসে 'Augustan Age of Islam নামেও পরিচিত। সকল সীমাবদ্ধতাকে পেরিয়ে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এই যুগের অবদান ছিল অত্যন্ত ব্যাপক।


পরিশেষে বলা যায়, খলীফা আল-মামুনের রাজত্বকাল ছিল আব্বাসীয় ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য চর্চায় এই যুগ তাঁর পূর্ববর্তী সকল যুগকে ছাড়িয়ে যায়। এই যুগের অবদান কেবলমাত্র মুসলিমরাই গ্রহণ করেনি বরং সমগ্র ইউরােপের আধুনিক সভ্যতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক নবজাগরণ এই যুগের অবদানের ফসল। বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, শিল্প, রসায়ন, গণিত, ভূগোল এত উৎকর্ষ লাভ করেছিল যে, একে বলা হয় The Golden Age of Islamic Civilization।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *