বিশ্বগ্রাম কি?
গ্লোবাল ভিলেজ (global village) বা বিশ্বগ্রাম হচ্ছে এমন একটি সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা, যেখানে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষ ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সহজেই তাদের চিন্তা-চেতনা, অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি-কৃষ্টি ইত্যাদি বিনিময় করতে পারে ও একে অপরকে সেবা প্রদান করতে পারে।
কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিখ্যাত দার্শনিক হার্বাট মার্শাল ম্যাকলুহান (Marshall McLuhan) সর্বপ্রথম গ্লোবাল ভিলেজ কথাটি ব্যবহার করেন। ম্যাকলুহান ১৯১১ সালের ২১ জুলাই কানাডাতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি “দি মিডিয়াম ইজ দি মেসেজ” "The medium is the message" এবং “গ্লোবাল ভিলেজ” (Global Village) এর উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি ওর্য়াল্ড ওয়াইড ওয়েব বা ইন্টারনেট আবিষ্কারের প্রায় ৩০ বছর পূর্বেই এ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। ম্যাকলুহান ১৯৬২ এবং ১৯৬৪ সালে তার প্রকাশিত দুইটি গ্রন্থ "The Gutenberg: The Making of Typographic Man" এবং Understanding Media" তে গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রাম এর ধারণা দেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উন্নতির ফলে সমস্ত পৃথিবী ক্রমশই ছোট হয়ে একটি গ্রামের দিকে ধাতিবত হচ্ছে। গ্লোবাল ভিলেজ এমন একটি শব্দ যেখানে গোটা পৃথিবীকে একটি গ্রাম হিসেবে কল্পনা করা হয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গ্রাম রয়েছে। একটি গ্রামের সকল মানুষ যেমন খুব সহজেই তাদের বিভিন্ন দৈনন্দিন প্রয়োজনে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে তেমনি এখন পৃথিবীর সকল মানুষ খুব সহজেই প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মুল লক্ষ্যই হচ্ছে এমন একটি বিশ্ব গঠন করা যেখানে যেকোন ব্যক্তি বিশ্বের যেকোন স্থান হতে যেকোন সময় উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তথ্য আদান প্রদান করতে পারে। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে গ্লোবাল ভিলেজ কথাটিকে যোগাযোগ প্রযুক্তি তথা ইন্টারনেট বা ওর্য়াল্ড ওয়াইড ওয়েব এর বর্ণনায় ব্যবহার করা হচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আজ নতুন এক পৃথিবী গড়ে উঠেছে। যেখানে সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে যোগাযোগ কার্যক্রম অনেক সহজ হয়েছে। পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে যোগাযোগের জন্য বাস্তবে অনেক দূরত্ব থাকলেও ইন্টারনেট সেই দূরত্বকে একবারেই কমিয়ে দিয়েছে। আজকাল মানুষ অনলাইনের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ বা তথ্য আদান প্রদানের জন্য অনলাইন-সমাজ ব্যবস্থা বা ইনফরমেশন সোসাইটি গড়ে তুলেছে। এই দ্রুতগতির প্রযুক্তি নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলেই মানুষ বিশ্বের যেকোন প্রান্তের খবর মুহুর্তের মধ্যেই জানতে পারছে এবং তাদের মতামত বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারছে। এতে করে মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধও বাড়ছে। প্রযুক্তির কল্যাণে আজ ঘরে বসেই আমরা পৃথিবী আমরা পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত সম্পর্কে জানতে পারছি এবং অনুভব করতে পারছি। পৃথিবী কত বিষ্ময়কর স্থান।
গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রাম কে নিম্নোক্তভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়:
গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রাম হচ্ছে এমন একটি পরিবেশ যেখানে পৃথিবীর সকল মানুষই একটি একক সমাজে বসবাস করে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে একে অপরকে সেবা প্রদান করে থাকে।
অক্সফোর্ড আমেরিকান ডিকশনারী অনুযায়ী গ্লোবাল ভিলেজ হচ্ছে "The world considered a single community linked by telecommunications."
উইকিপিডিয়ার একটি উদ্ধৃতি অনুযায়ী বিশ্বগ্রাম হচ্ছে: "The global village is the sociological and cultural structure."
উপরের সকল সংজ্ঞা অনুযায়ী বলা যায় বিশ্বগ্রাম হচ্ছে এমন একটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা যার আনুষাঙ্গিক সকল কিছুই ইন্টারনেট তথা যোগাযোগ প্রযুক্তির মধ্যে বিদ্যমান।
যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন এবং আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষ গ্লোবাল ভিলেজে প্রবেশ করছে।
বিশ্বগ্রাম এর গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাসমূহ নিম্নরূপ:
১। সারা পৃথিবী মানুষের মুঠোয় এসেছে।
২। মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নত হয়েছে।
৩। মানুষের কাজের দক্ষতা এবং গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে এবং লেনদেন সহজতর হচ্ছে।
৫। অনলাইন লাইব্রেরি, অনলাইন ইউনিভার্সিটি, অনলাইন কেনাকটা, অনলাইন বিভিন্ন ধরনের সেবাসহ বিভিন্ন অনলাইন কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৬। ঘরে বসেই সহজে উন্নত চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাচ্ছে।
৭। সকল প্রকার ব্যবস্থাপনা খরচ করে আসছে।
৮। গবেষণার উপাত্ত ও তথ্য প্রাপ্তি সহজতর হচ্ছে এবং সহজেই বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল জানা যাচ্ছে।
বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠান উপাদান সমূহ:
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রামের ধারণা সহজেই বাস্তবায়ন ও এর প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। নিচে বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার প্রধান উপাদান সমূহ উল্লেখ করা হলো। যথা:
১। হার্ডওয়্যার
২। সফটওয়্যার
৩। নেটওয়ার্ক সংযুক্ততা বা কানেকটিভি
৪। ডেটা এবং
৫। মানুষের সক্ষমতা।
বিশ্বগ্রামের ধারণা সংশ্লিষ্ট প্রধান উপাদানসমূহ:
১। যোগাযোগ
২। কর্মসংস্থান
৩। শিক্ষা
৪। স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা
৫। গবেষণা
৬। অফিস
৭। বাসস্থান
৮। ব্যবসা-বাণিজ্য
৯। সংবাদ
১০। বিনোদন ও সামাজিক যোগাযোগ
১১। সাংস্কৃতিক বিনিময়
পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বগ্রাম হলো তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর এমন একটি পরিবেশ, যেখানে দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করেও পৃথিবীর সকল মানুষই একটি একক সমাজে বসবাস করার সুবিধা পায় এবং একে অপরকে সেবা প্রদান করে থাকে। অর্থাৎ বিশ্বগ্রাম হচ্ছে এমন একটি ধারণা যেখানো গোটা পৃথিবীটাকেই একটি গ্রাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কানাডিয়ান দার্শনিক ও লেখক হারবার্ট মার্শাল ম্যাকলুহান (১৯১১-১৯৮০) হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজ শব্দটিকে সকলের সামনে তুলে ধরে একে জনপ্রিয় করে তোলেন।
১৯৬২ সালে তার প্রকাশিত The Gutenberg Galaxy; The making of Typographic Man' এবং ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত 'Understanding Media': The Extension of Man' বইয়ের মাধ্যমে এই গ্লোবাল ভিলেজ ধারণাটি গুরুত্ব লাভ করে।