Home » » অশোক

অশোক

অশোক

চন্দ্রগুপ্তের পর তাঁর পুত্র বিন্দুসার সিংহাসনের বসেন। তিনি প্রায় ২৫ বছর রাজত্ব করার পর মৃত্যুবরণ করলে তাঁর পুত্র অশোক সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের ৪ বছর পর তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠান হয়। এই বিলম্বের কারণে অনেকে মনে করেন যে সিংহাসন নিয়ে তাঁর ভাইদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চলেছিল। তবে কোন উৎসে এর সমর্থন পাওয়া যায় না। সিংহলি ইতিবৃত্ত দীপবংশ হতে জানা যায় যে গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের ২১৪ বছর পরে অশোক সিংহাসনে বসেছিলেন এবং সিংহাসনে বসার ৪ বছর পর তাঁর অভিষেক হয়েছিল। সাধারণভাবে গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের তারিখ ৪৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলে মনে করা হয়। কাজেই অশোক (৪৮৭-২১৪) ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসনে বসেছিলেন এবং তাঁর অভিষেক হয়েছিল ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

সিংহাসনে আরোহণ করে অশোক তাঁর পূর্বসুরীদের মতই ‘দেবনম পিয়' উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি নিজেকে ‘দেবনম পিয় পিয় দসী' রূপে পরিচয় দিতেন। অশোক নামটি সাহিত্যে এবং মাত্র দুটি শিলালিপিতে পাওয়া যায়। অশোক রাজপ্রাসাদের আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছিলেন এবং স্বভাবতই যুবরাজসুলভ আমোদপ্রমোদ, মৃগয়া, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি ভালোবাসতেন। পিতার রাজত্বকালে অশোক প্রথম জীবনে উজ্জয়িনীর শাসনকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। পরে তক্ষশীলায় বিদ্রোহ দেখা দিলে বিন্দুসার তাঁকে সেখানে পাঠান। বিদ্রোহ দমনের পর তিনি তক্ষশীলার শাসনভার গ্রহণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর ২৭৩ খ্রিস্টপুর্বাব্দে তিনি পাটলিপুত্রের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

রাজত্বের প্রথম ১৩ বছর অশোক পূর্বসুরী মৌর্যদের ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার ও ভারতের বাইরে বিদেশী শক্তির সঙ্গে বন্ধুত্বের সনাতন নীতি অনুসরণ করেন। রাজত্বের ত্রয়োদশ বছরে অশোক কলিঙ্গ আক্রমণ ও জয় করেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। উড়িষ্যা ও গঞ্জাম জেলার কিছু অংশ নিয়ে কলিঙ্গ রাজ্য গঠিত ছিল। অশোকের শিলালিপিতে তাঁর কলিঙ্গ আক্রমণের কারণ পাওয়া যায়না। বিভিন্ন পন্ডিত বিভিন্নভাবে এ আক্রমণের কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। ড. রায়চৌধুরী মনে করেন যে, কলিঙ্গ নন্দ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও নন্দদের পতনের পর কলিঙ্গ স্বাধীন হয়ে যায়। প্লিনির বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বকালেই কলিঙ্গ ছিল স্বাধীন রাজ্য। কাজেই সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের নীতি অনুসরণ করে অশোক কলিঙ্গ আক্রমণ ও জয় করেছিলেন। তিববতীয় বিবরণ থেকে জানা যায় যে জলপথ বা স্থলপথে দক্ষিণ ভারতে যাওয়ার পথে কলিঙ্গ ছিল বাধাস্বরূপ। কাজেই কলিঙ্গ জয় করা অশোকের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। অধ্যাপক রোমিলা থাপার এটাকেই কলিঙ্গ আক্রমণের মূল কারণ বলে মনে করেন। তাছাড়া কলিঙ্গ ছিল তখন এক শক্তিশালী রাজ্য। পিস্ননির বিবরণ অনুযায়ী চন্দ্রগুপ্তের আমলে কলিঙ্গের ৬০ হাজার পদাতিক, ১২ হাজার অশ্বারোহী ও ৭ শত রণহসিত্ম ছিল। অশোকের আমলে এ সামরিক শক্তি নিশ্চিতভাবেই আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ রকম একটি শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ধ্বংসসাধন অশোকের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল। ড. ভান্ডারকারের মতে, বিন্দুসারের আমলে কলিঙ্গ দক্ষিণের চোল ও পান্ড্য রাজাদের সঙ্গে জোট বেধে তাঁর বিরুদ্ধে বাধা দিয়েছিল। অশোক দেখেন যে মগধের অধীনস্থ অস্ত্র, উত্তরে কলিঙ্গ ও দক্ষিণে চোল ও পান্ড্যদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়েছে। এ কারণেই তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করেছিলেন। তাছাড়া বাণিজ্যিক স্বার্থও অশোককে কলিঙ্গ জয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মগধের বাণিজ্য তখন তাম্রলিপ্ত বন্দরের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের পথে ব্রহ্মদেশ, সুমাত্রা এবং জাভা পর্যন্ত চলতো। কলিঙ্গ ছিল মগধের এই সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রতিদ্বন্দবী। কাজেই কলিঙ্গকে মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত করতে অশোক উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন।

কলিঙ্গ বিজয়ের পর এটা মৌর্য সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এ যুদ্ধে ১১/২ লক্ষ লোক বন্দী, ১ লক্ষ লোক নিহত এবং বহু সংখ্যক লোক আহত হয়।এ যুদ্ধে শুধু কলিঙ্গের সৈন্যরাই নিহত হয়নি। কলিঙ্গের সাধারণ অধিবাসীরাও আহত-নিহত হয়েছিল।নতুন এ প্রদেশের রাজধানী হয় তোসালী এবং একজন রাজকুমারকে এর শাসনভার দেওয়া হয়।নতুন প্রদেশের প্রশাসনিক নীতি ঘোষণা করে অশোক মহামাত্রদের উদ্দেশ্যে দুটি অধ্যাদেশ জারি করেন।এ অধ্যাদেশ দুটিতেই সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন যে ‘‘সব মানুষই আমার সন্তান’’।

ড. রায়চৌধুরীর মতে, কলিঙ্গ বিজয় ছিল ‘‘মগধ ও ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিম্বিসার অঙ্গরাজ্য জয় করে মগধের রাজ্যজয় ও বিস্তারের যে সূচনা করেছিলেন কলিঙ্গ বিজয় তাঁর সমাপ্তি সূচনা করে। এটা এক নতুন যুগের সূচনা করে- যে যুগ ছিল শান্তি, সামাজিক প্রগতি, ধর্মপ্রচার এবং একই সাথে রাজনৈতিক স্থবিরতা এবং সম্ভবত সামরিক অকার্যকারিতার যখন অনুশীলনের অভাবে মগধের সামরিক তেজস্বিতা অবলুপ্ত হয়ে যায়। সামরিক বিজয় বা দিগ্বিজয়ের যুগের অবসান ঘটে, ধম্মবিজয় বা আধ্যাত্মিক বিজয়ের যুগের সূচনা হয়।’’ কলিঙ্গযুদ্ধ অশোকের মন ও শাসননীতির ওপরেও গভীর প্রভাব ফেলে। এ যুদ্ধের পর অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ গ্রন্থমতে তিনি উপগুপ্ত নামক এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। অশোকের মনের পরিবর্তন তাঁর ধর্মমতের পরিবর্তনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি-মৌর্য সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতেও প্রভাব ফেলেছিল।

অশোক তাঁর সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তিনি ভবিষ্যতে আর যুদ্ধ করবেন না। ধর্ম বিজয় অর্থাৎ সৌহার্দ্য, মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে অপরের প্রীতি অর্জনই শ্রেষ্ঠ বিজয়। সামরিক বিজয়কে প্রকৃত বিজয় বলে মনে না করে ধর্ম বিজয়কেই প্রকৃত বিজয় বলে মনেপ্রাণে তিনি গ্রহণ করেছেন। মৌর্য সম্রাটদের চিরাচরিত দিগ্বিজয় নীতি তিনি পরিত্যাগ করেন। তাঁর পুত্র, প্রপৌত্র কেউই ভবিষ্যতে আর যুদ্ধ করবে না বলেও তিনি ঘোষণা করেন। তিনি ভারতের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে তাঁর ধর্মনীতি প্রচারের উদ্দেশ্যে লোক পাঠান। তিনি তাঁর মৈত্রী নীতি দ্বারা ভারতের কেরল, চোল, পান্ড্য, সত্যপুত্র, কেরলপুত্র প্রভৃতি তামিল রাজ্যগুলোর সৌহার্দ্য লাভে সমর্থ হয়েছিলেন। ভারতের বাইরে তিনি সিরিয়া, মিশর, ম্যাসিডোনিয়া, ইপিরাস, সিংহল প্রভৃতি রাজ্যের রাজাদেরও প্রীতি ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। অশোক রাজ-কর্তব্যের এক নতুন আদর্শ প্রচার করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে সব মানুষই তাঁর সন্তান। তাদের জাগতিক ও পারলৌকিক সুখ নিশ্চিত করাই ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। প্রজাদের জাগতিক কল্যাণের জন্য তিনি শাসনব্যবস্থার কিছু কিছু সংস্কার সাধন করেছিলেন। দেশে শান্তি, শৃক্মখলা, সুবিচার ইত্যাদির অবস্থা দেখার জন্য তিনি ‘রাজুক', ‘সুত' প্রভৃতি কর্মচারীদের তিন ও পাঁচ বছর পর পর রাজ্য পরিক্রমায় পাঠাতেন। অশোক আইনের চোখে সকলকে সমান বিবেচনা করতেন। তিনি সকলের জন্য সম-অপরাধের জন্য সম-পরিমাণ শাসিত্মর বিধান করে ‘ব্যবহার-সমতা' এবং ‘দন্ড-সমতা' নীতির প্রবর্তন করেন।

মানুষ ও পশুর জন্য তিনি চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। পথিকদের সুবিধার জন্য তিনি রাস্তার পাশে ছায়াবান গাছ রোপন ও কূপ খনন করেছিলেন। রাজকর্মচারীরা যাতে কর্তব্যে অবহেলা না করে সেদিকেও তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। তিনি ধর্মমহামাত্র নামের এক শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ করেন যাদের কাজ ছিল প্রজাদের আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক মঙ্গল সাধন করা। তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃভাব ও সহিষ্ণুতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। নিজে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও তিনি ব্রাহ্মণ, শ্রমণ, জৈন ও আজীবিক সম্প্রদায়কে নানা রকম দানে সম্মানিত করতেন।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলেই ভারতবর্ষের এক বিশাল এলাকায় মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটেছিল। অশোক কলিঙ্গ জয় করলে তার আরো বিস্তৃতি ঘটে। দেশী-বিদেশী লেখকদের বিবরণ এবং অশোকের শিলালিপিগুলোর অবস্থান থেকে তাঁর সাম্রাজ্যের সীমানা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। কলিঙ্গের ধোলিতে এবং অন্ধ্রের জৌগড় গ্রামে অশোকের শিলালিপি পাওয়া গেছে। উত্তর-পূর্বে লুম্বিনী ও নিগস্নীভ স্তম্ভলিপি থেকে বোঝা যায় যে, নেপালের তরাই অঞ্চল ছিল অশোকের রাজ্যের উত্তর-পূর্ব সীমা। দেরাদুন জেলার কালসী গ্রামে অশোকের শিলালিপি-প্রাপ্তি হিমালয় অঞ্চলে তাঁর রাজ্য-সীমা নির্দেশ করে। পাকিস্তানের হাজারা জেলার মানসেরা গ্রামে এবং পেশোয়ার জেলার শাহবাজ গরহি গ্রামে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে তাঁর রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। গ্রিকসূত্র থেকে জানা যায় যে, মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্তরপশ্চিম সীমান্ত হিন্দুকুশ পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আফগানিস্তানের জালালাবাদে এবং গান্ধারের তক্ষশীলায় অশোকের শিলালিপি পাওয়া গেছে। এ থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যে সেলুকাসের কাছ থেকে কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও বেলুচিস্তান লাভ করেছিলেন তাঁর সমর্থন পাওয়া যায়। কাশ্মির যে অশোকের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তা হিউয়েন সাং এর বিবরণ ও কল্হণের রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায়।

জুনাগড়ে প্রাপ্ত অশোকের শিলালিপি কাথিয়াওয়াড়ে মৌর্য প্রভুত্বের সাক্ষ্যবহন করে। মহারাষ্ট্রের সোপারাতে অশোকের শিলালিপি পাওয়া গেছে যা থেকে বোঝা যায় যে, তাঁর সাম্রাজ্য আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই এলাকা যে মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল তা অবশ্য পরবর্তীকালের শক মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামনের জুনাগড় শিলালিপি থেকেও জানা যায়।

দক্ষিণে অন্ধ্র প্রদেশের এরাগুড়িতে এবং মহীশুরের চিতলদ্রুগ জেলায় অশোকের শিলালিপি পাওয়া গেছে। এ থেকে বলা যায় যে, দক্ষিণে অশোকের সাম্রাজ্য ঐ দুটি এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাংলার মহাস্থানগড়ে ব্রাহ্মী হরফে লেখা শিলালিপি পাওয়া গেছে। হিউয়েন সাং তাম্রলিপ্ত বন্দরে ও কর্ণসুবর্ণে অশোক নির্মিত স্তুপের কথা উল্লেখ করেছেন। এ থেকে স্বভাবতই বাংলা মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করা যায়। তবে কামরূপ মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না বলেই মনে করা যায়। শিলালিপি, স্থাপত্য নিদর্শন ও বিভিন্ন লেখক ও পরিব্রাজকদের বর্ণনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, পূর্বে কামরূপ এবং দক্ষিণে কয়েকটি তামিল রাজ্য ছাড়া গোটা ভারতবর্ষের ওপর অশোকের শাসন কর্তৃত্ব ছিল। ভারতের বাইরে আফগানিস্তানের কিছু অংশ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।

ব্যক্তিগত জীবনে সম্রাট অশোক ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। কল্হণের রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায় যে, প্রথম জীবনে অশোক ছিলেন শিবের উপাসক। কিন্তু কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁর মনে পরিবর্তন আনে এবং তিনি উপগুপ্ত নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। অশোক যে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। তাঁর লিপিমালা ও অন্যান্য উৎস থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়। ১ম অপ্রধান প্রস্তরলিপিতে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তাঁর আসক্তির বিভিন্ন পর্যায় বর্ণনা করেছেন। মাস্কি ও রূপনাথ লিপিতে নিজেকে তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বলে ঘোষণা করেছেন। ১ম অপ্রধান প্রস্তরলিপিতে উল্লেখ আছে যে, তিনি দুবছরের বেশি সময় যাবৎ উপাসক হয়েছেন। কিন্তু এক বছর তিনি ধর্মের ব্যাপারে তেমন উদ্যম প্রকাশ করেননি। কিন্তু সংঘের সঙ্গে জড়িত হওয়ার পর থেকে প্রায় দেড় বছর ধরে তিনি যথেষ্ট উদ্যমের সঙ্গে ধর্মপালন করছেন। এ সংঘ যে বৌদ্ধ সংঘ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ভারক লিপিতে তাঁকে বৌদ্ধ সংঘের ওপর কর্তৃত্বের সুরে কথা বলতে দেখা যায়। সেখানে তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ভিক্ষু ও সাধারণ উপাসকদের জন্য ধর্মগ্রন্থের বিশেষ কিছু অংশ পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ লিপিতে তিনি বৌদ্ধ ত্রিত্বে (বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ) তাঁর বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করেছেন।

সারনাথ, কৌশাম্বী এবং সাঁচীর অপ্রধান স্তম্ভলিপিতে তাঁকে ধর্মরক্ষকের ভূমিকায় দেখা যায়। এ সব লিপিতে তিনি মহামাত্রদের বিভেদ সৃষ্টিকারী ভিক্ষু বা ভিক্ষুনীদের সংঘ থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছেন। অষ্টম প্রস্তরলিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি বিহার যাত্রাকে ধর্মযাত্রায় পরিণত করেছিলেন। প্রথমে তিনি বুদ্ধগয়া পরিদর্শন করেন। পরবর্তীকালে তিনি বুদ্ধের জন্ম ও জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত তীর্থস্থানগুলো ভ্রমণ করেন। রুমিন্দী স্তম্ভলিপি থেকে জানা যায় যে, অভিষেকের বিংশতিতম বছরে তিনি এখানে এসে প্রার্থনা করেছিলেন এবং এ স্থান গৌতমবুদ্ধের জন্মস্থান হওয়ায় এখানে পাথরের দেওয়াল ও স্তম্ভ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। এ স্তম্ভলিপি থেকে আরো জানা যায় যে গৌতম বুদ্ধের জন্মভূমি হওয়ার কারণে তিনি লুম্বিনী গ্রামের অধিবাসীদের সব রকম ধর্মীয় কর থেকে মুক্তি দান করেন এবং ভূমি-রাজস্ব এক-অষ্টমাংশে হ্রাস করেন।

বৌদ্ধ সংঘের সংহতি বজায় রাখার জন্য অশোক বৌদ্ধ সম্মেলন বা সঙ্গীতি আহবান করেছিলেন। তাঁর রাজত্বের সপ্তদশ বছরে পাটলিপুত্রে এ সম্মেলন হয়েছিল। বৌদ্ধদের মধ্যে মতভেদ দূর এবং গৌতম বুদ্ধের শিক্ষাবলীর সংকলন করা ছিল এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য। মোগলিপুত্ত এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। এ সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো সারনাথ স্তম্ভলিপিতে উৎকীর্ণ করা হয়।

অশোকের কোনো কোনো লিপিতে হাতির প্রতিকৃতি বা গজোত্তম কথাটি উৎকীর্ণ দেখা যায়। বৌদ্ধ কিংবদন্তী অনুসারে গৌতম বুদ্ধ জন্মের আগে হাতির আকারে তাঁর মায়ের গর্ভে ছিলেন। এ থেকে মনে হয় যে অশোক তাঁর এ লিপিগুলো বুদ্ধের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন। ওপরের আলোচনা থেকে বলা যায় যে ব্যক্তিগত জীবনে অশোক বৌদ্ধ ছিলেন। অশোক নিজে বৌদ্ধ হলেও তাঁর প্রচারিত ধর্মমতের প্রকৃতি নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। কোনো কোনো পন্ডিত মনে করেন যে অশোকের প্রচারিত ধর্ম ছিল বৌদ্ধ ধর্ম। আবার অনেকেই এটাকে বৌদ্ধ ধর্ম বলে মনে করেন না।

অশোকের প্রচারিত ধর্মমতকে ফ্লিট বৌদ্ধ ধর্ম বলে স্বীকার করেন না। তাঁর মতে এটা ছিল ‘রাজধর্ম'- অর্থাৎ রাজাদের পালনীয় আচরণবিধি। কিন্তু এটা ঠিক বলে মনে হয় না। রাজা বা রাজর্কচারীদের পালনীয় আচরণবিধি এটা ছিল না- এটা ছিল সৎ জীবনযাপনের জন্য সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রচারিত কিছু নিয়ম। ম্যাকফাইলের মতে এটা বৌদ্ধ ধর্ম ছিল না, এটা ছিল সরল ধার্মিকতা যা অশোক তাঁর প্রজা সাধারণকে অনুশীলন করতে বলেছিলেন। ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ও বলেছেন যে, সেকালে দেশে প্রচলিত কোনো ধর্ম হিসাবে একে চিহ্নিত করা উচিৎ নয়; নিশ্চিতভাবেই এটা বৌদ্ধ ধর্ম ছিল না। ড. ভিনসেন্ট স্মিথও অনুরূপ ধারণা পোষণ করেন। তাঁর মতে অশোকের ধর্মে তেমন কোন স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য ছিল না। তাঁর ধর্মের নীতিমালা ভারতীয় প্রায় সব ধর্মেই ছিল।

ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় আরো বলেছেন যে অশোকের প্রচারিত ধর্ম বৌদ্ধধর্ম ছিল না কারণ এতে বৌদ্ধ ধর্মের মূল শিক্ষাবলীর কোন উল্লেখ নেই; এতে চার আর্য-সত্য, কার্য-কারণ সম্পর্ক, অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা নির্বাণ তত্ত্ব অনুপস্থিত।

অশোকের ধর্মে শুধু নৈতিক তত্ত্বই রয়েছে এমন নয়, এতে এগুলো অনুশীলনের পন্থাও বর্ণনা করা হয়েছে। বৌদ্ধদের মত অশোকের ধর্মের লক্ষ নির্বাণ ছিলনা। দ্বাদশ প্রস্তরলিপি থেকে মনে হয় যে অশোকের ধর্ম কোন নির্দিষ্ট ধর্ম নয়। এটা ছিল কতকগুলো নৈতিক অনুশাসন- যাকে সকল ধর্মের সারকথা বা নির্যাস বলা চলে। রিস ডেভিডের মতে অশোকের ধর্ম প্রকৃতপক্ষে কোন নির্দিষ্ট ধর্মমত নয়- এটি সহজ, সরল ও
সৎজীবন যাপন করার জন্য একটি নীতিমালা। অশোকের ধর্মে দেবতা ও স্বর্গের উল্লেখ রয়েছে। তিনি নিজেকে দেবতাদের প্রিয়রূপে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ বৌদ্ধ ধর্মে দেবতা বা স্বর্গের কোনো স্থান নেই।

ডি.ডি. কোশাম্বী মনে করেন যে, সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর সংঘাত দূর করা ছিল অশোকের এই ধর্মের লক্ষ। এ যুগে কৃষি ও বাণিজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল যার ফলে গৃহপতি, শ্রেষ্ঠী ও বণিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা এই পরিবর্তনকে রোধ করতে পারেনি। তাই শ্রেণী-সংঘাত এড়াতে অশোক তাঁর ধর্মপ্রচার করে রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন।

অধ্যাপক রোমিলা থাপার বলেছেন যে, মৌর্য শাসনব্যবস্থা ছিল ঘোরতর কেন্দ্র-প্রবণ। তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য এই কেন্দ্র-প্রবণতার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ এড়াবার জন্যই অশোক তাঁর ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তাঁর প্রচারিত ধর্ম ছিল ব্যবহারোপযোগী ও সুবিধাজনক। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে তাঁর সকল প্রজার কাছেই এটা ছিল একটা গ্রহণযোগ্য নীতিমালা এবং এর দ্বারা তিনি তাঁর প্রজাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন।

অশোকের ধর্ম ছিল সার্বজনীন। তাঁর প্রচারিত ধর্ম আনুষ্ঠানিক বৌদ্ধধর্মের চেয়ে অধিকতর উদার ও মানবধর্মী ছিল। কাজেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এটা ছিল সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। তদানীন্তন প্রচলিত অনেক ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে অশোকের প্রচারিত ধর্মের বেশ কিছু সাদৃশ্য ছিল। তবে বৌদ্ধধর্মের মূলনীতির সঙ্গে পার্থক্য থাকায় পন্ডিতরা মনে করেন যে, অশোকের প্রচারিত ধর্ম বৌদ্ধধর্ম ছিল না।

অশোক তাঁর ধর্মের শিক্ষাবলী প্রচারের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর ধর্মের বাণী সারা সাম্রাজ্য জুড়ে স্তম্ভ ও প্রস্তরগাত্রে উৎকীর্ণ করেন। তাঁর প্রচারিত ধর্মের মূল বিষয় ছিল গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা, জীবে দয়া, সত্যবাদিতা ইত্যাদি।

অশোক তাঁর ধর্মপ্রচারের জন্য ধর্মমহামাত্র নামে এক বিশেষ শ্রেণীর রাজকর্মচারী নিয়োগ করেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধি, রাজকীয় দান ও জনহিতকর কাজ পরিচালনা এবং অশোকের ধর্মের শিক্ষাবলী প্রচার করাই ছিল ধর্মমহামাত্রদের কাজ।তিনি সুত, রাজুক প্রভৃতি কর্মচারীদের জনগণের কাছে তাঁর ধর্মের বাণী প্রচারের নির্দেশ দান করেন। অশোক নিজেও তাঁর ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। ব্যক্তিগতভাবে ধর্মপ্রচার করার ফলে প্রজাদের মধ্যে তাঁর ধর্ম সহজেই প্রসার লাভ করে। তিনি অনেক জনহিতকর কাজ করেন। তিনি রাস্তা নির্মাণ, রাস্তার পাশে ছায়াবান বৃক্ষরোপন এবং ধর্মশালা স্থাপন করেন। ৭ম স্তম্ভলিপিতে তিনি বলেছেন যে তিনি ধর্মমাত্র নিয়োগ ও ধর্মস্তম্ভ স্থাপন করেছেন। ধর্মস্তম্ভ দ্বারা সম্ভবত তিনি এ সব জনহিতকর কাজকেই বুঝিয়েছিলেন।

অশোকের ধর্মপ্রচার শুধুমাত্র ভারতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভারতের বাইরেও তাঁর প্রচারকরা বিভিন্ন দেশে তাঁর ধর্মের বাণী প্রচার করেছিলেন। ত্রয়োদশ লিপিতে অশোক বলেছেন যে, তাঁর ধর্মের বাণী পাঁচটি গ্রিক শাসিত রাজ্য যথা সিরিয়া, মিশর, কাইরেনী, ম্যাসিডন এবং ইপিরাসে বিস্তার লাভ করেছিল। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর কন্যা সংঘমিত্রা ও পুত্র (মতান্তরে ভ্রাতা) মহেন্দ্রকে সিংহলে পাঠিয়েছিলেন। সিংহলী ইতিবৃত্ত থেকে জানা যায় যে, অশোক ব্রহ্মদেশ ও সুমাত্রায়ও ধর্ম প্রচারক পাঠিয়েছিলেন।

প্রায় ৪০ বছর রাজত্ব করার পর ২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অশোক মুত্যুবরণ করেন। তিব্বতীয় কাহিনী অনুসারে সম্রাট অশোক তক্ষশীলায় দেহত্যাগ করেন। তবে এ কাহিনীর সত্যতা সম্পর্কে অনেক পন্ডিতই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

0মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Basic Computer Course

MS Word
MS Excel
MS PowerPoint
Bangla Typing, English Typing
Email and Internet

Duration: 2 months (4 days a week)
Sun+Mon+Tue+Wed

Course Fee: 4,500/-

Graphic Design Course

Adobe Photoshop
Adobe Illustrator

Duration: 3 months (2 days a week)
Fri+Sat

Course Fee: 9,000/-

Web Design Course

HTML 5
CSS 3

Duration: 3 months (2 days a week)
Fri+Sat

Course Fee: 8,500/-

Digital Marketing Course

Facebook, YouTube, Instagram, SEO, Google Ads, Email Marketing

Duration: 3 months (2 days a week)
Fri+Sat

Course Fee: 15,000/-

Class Time

Morning to Noon

1st Batch: 08:00-09:30 AM

2nd Batch: 09:30-11:00 AM

3rd Batch: 11:00-12:30 PM

4th Batch: 12:30-02:00 PM

Afternoon to Night

5th Batch: 04:00-05:30 PM

6th Batch: 05:30-07:00 PM

7th Batch: 07:00-08:30 PM

8th Batch: 08:30-10:00 PM

Contact:

Alamin Computer Training Center

796, West Kazipara Bus Stand,

West side of Metro Rail Pillar No. 288

Kazipara, Mirpur, Dhaka-1216

Mobile: 01785 474 006

Email: alamincomputer1216@gmail.com

Facebook: www.facebook.com/ac01785474006

Blog: alamincomputertc.blogspot.com

Contact form

নাম

ইমেল*

বার্তা*

-->