Home » » পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ, ১৫৫৬ খ্রি.
হুমায়ুনের আকস্মিক মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে আকবর সিংহাসনে বসার সঙ্গে সঙ্গে আদিল শাহের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপতি হিমু দিল্লি ও আগ্রা দখল করে ভারতবর্ষ থেকে মুঘলদের বিতাড়িত করার জন্য অগ্রসর হন। আগ্রার মুঘল শাসনকর্তা ইস্কান্দার খান তাঁকে বাধা দিতে অসমর্থ হয়ে দিল্লিতে পালিয়ে আসেন। হিমু আগ্রা দখল করে আগ্রা থেকে দিল্লির দিকে অগ্রসর হন। দিল্লির শাসনকর্তা তার্দি বেগ হিমুর হামলা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে তিনিও দিল্লি থেকে পালিয়ে পাঞ্জাবে চলে আসেন। অতপর হিমু আদিল শাহের অধীনতা অস্বীকার করে নিজেকে স্বাধীন নরপতি হিসেবে ঘোষণা করেন এবং বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করে দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। মুঘল সেনাবাহিনীর নৈতিক শক্তি ও মর্যাদায় আঘাত হানে। পাঞ্জাবে অবস্থানরত আকবরের নিকট এই সংবাদ পৌঁছলে অধিকাংশ অভিজাত তাঁকে হিমুর কাছ থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে কাবুলে চলে যেতে পরামর্শ দেন। কিন্তু আকবরের অভিভাবক বিচক্ষণ রাজনীতিক বৈরাম খাঁ ঐসব পরাজয়প্রবণ অভিজাতগণের পরামর্শ অগ্রাহ্য করেন। তিনি বিনা যুদ্ধে হিমুকে দিল্লির সিংহাসন ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। বালক সম্রাট আকবর বৈরাম খাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং কাবুলে পালিয়ে না গিয়ে হিমুর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মুঘলদের ভাগ্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেন। অতপর সিকান্দার শূরকে দমন করার জন্য আকবর খিজির খানকে পাঞ্জাবে রেখে বৈরাম খাঁ সহ দিল্লি অধিকারের জন্য সসৈন্যে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে সিরহিন্দে আগ্রার পলাতক শাসনকর্তা ইস্কান্দার খান ও দিল্লির পলাতক শাসনকর্তা তার্দি বেগ তাঁদের সঙ্গে মিলিত হন। দিল্লি রক্ষা করতে না পারার অপরাধে বৈরাম খাঁ তার্দি বেগকে হত্যা করেন। কর্তব্যে অবহেলা ও কাপুরুষতার ফলস্বরূপ তাঁর এই পরিণতি হয়।

সিরহিন্দ থেকে আকবর ও বৈরাম খাঁ তাঁদের প্রধান শত্রু দিল্লি ও আগ্রা দখলকারী হিমুকে পরাজিত করে দিল্লি অধিকারের সংকল্প নিয়ে দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। ইতিহাসখ্যাত পানিপথের প্রান্তরে মুঘল সৈন্যবাহিনীকে হিমু বাধা প্রদান করলে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে হিমুর আফগান সৈন্যবাহিনী মুঘল সৈন্যবাহিনীকে স্থানচ্যুত করলে মুঘল সৈন্যবাহিনী ভীত হয়ে পড়ে। কিন্তু হঠাৎ হিমুর দক্ষিণ চক্ষু তীরবিদ্ধ হলে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। ফলে নেতৃত্বের অভাবে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং হিমুর আফগান সৈন্যবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে থাকে। হিমু শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ধৃত হন। অতপর বন্দি অবস্থায় তাঁকে আকবরের নিকট আনা হয়। বৈরাম খাঁ আকবরকে হিমুর শিরচ্ছেদ করতে অনুরোধ জানান। কিন্তু আকবর এতে অসম্মতি জানালে বৈরাম খাঁ নিজে হিমুর শিরচ্ছেদ করেন। আকবর বিজয়ীবেশে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ নভেম্বর দিল্লি প্রবেশ করেন। কালবিলম্ব না করে তিনি আগ্রা অধিকার করেন এবং সিকান্দার শূরের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে সিকান্দার শূর ১৫৫৭ খ্রি. বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন। আকবর তাঁকে বিহারে জায়গীর প্রদান করেন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে সিকান্দার শূর বিদ্রোহী হয়ে উঠলে তাঁকে জায়গীর চ্যুত করা হয়। তিনি আত্মরক্ষার্থে বাংলায় আশ্রয় নেন। বাংলায় অবস্থানকালে ১৫৫৯ খ্রি. তাঁর মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে ইব্রাহিম শূর মুঘল বিরোধিতা ত্যাগ করেন এবং আদিল শূর বাংলা অধিকারের বৃথা চেষ্টা করতে গিয়ে ইতোমধ্যে (১৫৫৬) নিহত হন। ফলে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ভারতের সার্বভৌম ক্ষমতা আকবরের নিকট দাবি করার মতো আর কোন প্রবল আফগান প্রতিদ্বন্দবী রইল না। ১৫২৬ খ্রি. পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বিজয় লাভ করার পর বাবুর যে সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে গিয়েছিলেন, ১৫৫৬ খ্রি. পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে আকবরের জয়লাভের ফলে সেই সাম্রাজ্য বিপদমুক্ত হয়ে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপর আফগানগণ আর কখনো সমগ্র ভারতব্যাপী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কল্পনাও করতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় পানিপথের জয়লাভই আকবরের এবং ভারতবর্ষে মুঘল ভাগ্য নির্ধারণ করে। এরপর থেকে মুঘলদের নতুন শক্তিতে যাত্রা শুরু হয়। এসব দিক বিবেচনা করলে সত্যিই পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ আকবর ও বৈরাম খাঁর অত্যন্ত বিবেচনাপ্রসূত ও সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। উপরন্তু বাবুরের সময়ে যে মুঘল-আফগান সংঘাতের সূচনা হয়েছিল, পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে এর অবসান ঘটে। প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধকে আকবর তথা মুঘলদের সর্বশেষ আত্মরক্ষার যুদ্ধ বলা যায়। এরপর আকবর যেসব যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন সেসব ছিল সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধ। মূলত মুঘলদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও সীমা-মীমাংসমূলক যুদ্ধ ছিল পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ।

0 comments:

Post a Comment

Comment below if you have any questions

Contact form

Name

Email *

Message *