খতিয়ান কাকে বলে
খতিয়ানের অর্থ হলো ‘হিসাব’। সাধারণভাবে স্বত্ব সংরক্ষণ ও রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে জরীপ বিভাগ কর্তৃক প্রত্যেক ও মৌজার ভূমির মালিক বা মালিকগণের নাম, পিতা অথবা স্বামীর নাম, ঠিকানা, হিস্যা (অংশ) এবং তাদের স্বত্বাধীন দাগসমূহের নম্বরসহ ভূমির পরিমাণ, শ্রেণী, এদের জন্য দেয় খাজনা ইত্যাদি বিবরণসহ ক্রমিক সংখ্যা অনুসারে যে স্বত্ব তালিকা বা স্বত্বের রেকর্ড প্রস্তুত করা হয় তাদের প্রত্যেকটিকে খতিয়ান বলা হয় এবং উক্ত রেকর্ডকে স্বত্ত্বের রেকর্ড বা রেকর্ড অব রাইটস (ROR) বলা হয়।
এক বা একাধিক দাগের সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিমাণ ভূমি নিয়ে এক বা একাধিক ব্যক্তির নামে স্মরণীয় বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যে ভূমি স্বত্ব প্রস্তুত করা হয় তাকে “খতিয়ান” বলে।
খতিয়ানগুলো ১, ২, ৩, ৪, ৫ ইত্যাদি ক্রমিক সংখ্যা দ্বারা সাজানো হয়ে থাকে। প্রত্যেক খতিয়ানে একটি সংখ্যা রয়েছে। ইহাদেরকে খতিয়ান নম্বর বলা হয়। প্রত্যেক মৌজার খতিয়ান ১ (এক) হতে শুরু হয়। কোনো কোনো মৌজার (একশত) ১০০ খতিয়ানের কম থাকতে পারে আবার কোনো কোনো মৌজার কয়েক হাজারের বেশি থাকতে পারে। কোন মৌজার কতটি খতিয়ান রয়েছে তা উক্ত স্বত্বের রেকর্ড পাওয়া যাবে।
জমির খতিয়ান তৈরির ইতিহাস
১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অর্জন ও প্রজাতন্ত্র আইনের চতুর্থ অধ্যায় অর্থাৎ ১৭ হতে ৩১ ধারায় খতিয়ান প্রস্তুতকরণ সম্পর্কিত বিধিবিধান রয়েছে। ১৭ নম্বর ধারার ১ নম্বর উপধারা অনুযায়ী সরকারকে কোনো জেলা, জেলার অংশ অথবা স্থানীয় এলাকার ক্ষেত্রে খতিয়ান প্রস্তুত করার জন্য অথবা ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইন অনুসারে প্রস্তুতকৃত ও চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত খতিয়ান পরিমার্জন করার জন্য ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
২নং উপধারায় বলা হয়েছে যে, যদি ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন অনুসারে প্রস্তুতকৃত ও চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত খতিয়ান পরিমার্জন করার জন্য ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
২নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে যে, যদি ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাতন্ত্র আইন অথবা ১৯৩৬ সালের সিলেট প্রজাতন্ত্র আইন অনুযায়ী খতিয়ান প্রস্তুতের জন্য আদেশ প্রদান করা হয়ে থাকে কিন্তু খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়নি কিংবা ঐ খতিয়ান চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হয়নি তাহলে ঐ কার্যক্রম স্থগিত থাকবে এবং এ আইনের বিধান অনুযায়ী প্রস্তুত করতে হবে। আরও একটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, ১৯৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইনে আমরা ১৯৩৬ সালের সিলেট প্রজাস্বত্ত্ব আইনে যদি খতিয়ান প্রস্তুতকরণের কোনো কার্যক্রম আরম্ভ করা হয়ে থাকে তাহলে তা এ অধ্যায় অনুসারে আরম্ভ করা হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে।
এ আইনে ১৯ ধারায় খতিয়ান প্রকাশ করার বিভিন্ন পদক্ষেপ বর্ণনা করা হয়েছে। একটি খতিয়ানে কি কি বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা হবে তার বিবরণ ১৮ ধারায় রয়েছে। সে মোতাবেক খতিয়ান প্রস্তুত করা হলে বা সংশোধন করা হলে রাজস্ব অধিকার খসড়া খতিয়ান জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করবেন। অতঃপর এ সম্পর্কে কোনো আপত্তি থাকলে রাজস্ব অধিকার তা নিষ্পত্তি করবেন।
রাজস্ব কর্মকর্তার আদেশে সন্তুষ্ট না হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সরকারী সেটেলমেন্ট অফিসারের পদের নিচে নয় এমন রাজস্ব কর্মকর্তার নিকট আপিল করবেন। তার সিদ্ধান্তেও সন্তুষ্ট না হলে ৫৩ ধারা অনুযায়ী বিশেষ জজের নিকট আপিল করা যাবে এবং সেখান থেকে দেওয়ানী কার্যবিধির ১১৫ ধারা অনুযায়ী সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করা যাবে।
সকল ধরনের আপত্তি ও আপিল নিষ্পত্তি করা হলে রাজস্ব কর্মকর্তা চূড়ান্তরূপে খতিয়ান প্রকাশ করবেন। রাষ্ট্রীয় অর্জন বিধিমালা ২৫ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে যে, রাজস্ব কর্মকর্তা চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত খতিয়ান বিনামূল্যে পরিদর্শনের জন্য সুবিধাজনক স্থানে কিছু দিনের জন্য উন্মুক্ত রাখবেন।
রাজস্ব কর্মকর্তা চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত খতিয়ান ও তারিখ বর্ণনা করে সার্টিফিকেট প্রদান করেন যা খতিয়ানের চূড়ান্ত সাক্ষ্যরূপে পরিগণিত হবে।
জমির খতিয়ানের প্রকারভেদ:
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৪ ধরনের খতিয়ান রয়েছে। যথা:
১। সি,এস খতিয়ান
২। এস,এ খতিয়ান
৩। আর এস খতিয়ান
৪। বি, এস খতিয়ান / সিটি জরিপ।
নিম্নে এ ৪ প্রকার জমির খতিয়ানের বর্ণনা দেয়া হলো:
১। সি, এস খতিয়ান: ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪০ সালে সরকার জরিপের মাধ্যমে যে খতিয়ান প্রস্তুত করেন তাকে সি,এস (Cadastral Survey) খতিয়ান বলে।
২। এস এ খতিয়ান: ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ২৭ হতে ৩১ ধারা অনুযায়ী ১৯৫৬-৬০ সালে যে খতিয়ান প্রস্তুত করা হয় তাকে এস, এ (State Acquision) খতিয়ান বলে।
৩। আর, এস খতিয়ান: এই আইনের ১৪৪ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার খতিয়ান প্রস্তুত করার উদ্যোগ নেন এরূপ খতিয়ানকে বলা হয় আর, এস (Renisional Survey) খতিয়ান।
৪। বি,এস খতিয়ান/সিটি জরিপ: ১৯৯৮-৯৯ সাল হতে বর্তমানে চলমান জরিপকে বি,এস খতিয়ান বা সিটি জরিপ বলে। যাহা এখনো চলমান।
জমির খতিয়ানে অন্তর্ভূক্ত বিষয়সমূহ:
খতিয়ানে কি কি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে সে সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় অর্জন বিধিমালার ১৮ নম্বর বিধিতে বিবৃত করা হয়েছে। এ বিধি অনুযায়ী নিম্নলিখিত বিবরণসসূহ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ক) প্রজা বা দখলদারের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা।
খ) প্রজা বা দখলদার কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
গ) প্রজা বা দখলদার কর্তৃক অধিকৃত জমির অবস্থান, শ্রেণী, পরিমাণ ও সীমানা।
ঘ) প্রজার জমির মালিকের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা।
ঙ) এষ্টেটের মালিকের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা।
চ) খতিয়ান প্রস্তুতের সময় খাজনা এবং ২৮, ২৯, ৩০ বিধি মোতাবেক নির্ধারিত খাজনা।
ছ) গোচরণ, ভূমি, বনভূমি ও মৎস খামারের জন্য ধারণকৃত অর্থ।
জ) যে পদ্ধতিতে খাজনা ধার্য করা হয়েছে তার বিবরণ।
ঝ) যদি খাজনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে তাহলে যে সময়ে ও যে যে পদক্ষেপে বৃদ্ধি পায় তার বিবরণ।
ঞ) কৃষি কাজের উদ্দেশ্যে প্রজা কর্তৃক পানির ব্যবহার এবং পানি সরবরাহের জন্য যন্ত্রপাতি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কিত প্রজা ও জমির মালিকের মধ্যে অধিকার কর্তব্যের বিবরণ।
ট) প্রজাস্বত্ব সম্পর্কিত বিশেষ শর্ত ও তার পরিণতি।
ঠ) পথ চলার অধিকার ও জমি সংলগ্ন অন্যান্য ইজমেন্টের অধিকার।
ড) নিস্কর জমি হলে তার বিবরণ।
ঢ) ২৬নং ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত ও ন্যায়সঙ্গত খাজনা।
এছাড়া একটি খতিয়ানে তার নিজস্ব নম্বর, দাগ নম্বর, বাট্টা নম্বর, এরিয়া নম্বর, মৌজা নম্বর ও জে,এল নম্বর থাকে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions