Home » » সৌদামিনী মালো

সৌদামিনী মালো

সৌদামিনী মালো - শওকত ওসমান

লেখক-পরিচিতি 

শওকত ওসমান ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সবলসিংহপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম  শেখ আজিজুর রহমান। তাঁর পিতা শেখ মোহাম্মদ এহিয়া ও মাতা গুলজান বেগম। শওকত ওসমান প্রথমে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ও পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে লেখাপড়া করেন। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ও বাংলা বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন পেশায় চাকরির পর ১৯৫৮ থেকে ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করে ১৯৭২ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে যান। চাকরিজীবনের প্রথমদিকে তিনি কিছুদিন ‘কৃষক' পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। তিনি একাধারে গল্প, উপন্যাস, নাটক, রম্যরচনা, অনুবাদ ও শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন। সবমিলে তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ৮০টিরও বেশি। বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক হিসেবে তাঁর সাহিত্যকর্ম সমাজ-সচেতনতামূলক ও প্রগতিশীল ভাবধারার  শৈল্পিক ফসল। সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬২), আদমজি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৬), একুশে পদক (১৯৮৩), মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৭) ও ফিলিপস। সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৮ সালের ১৪ মে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।  

শওকত ওসমানের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম : 

উপন্যাস : বনি আদম (১৯৪৩), জননী (১৯৫৮), ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২), চৌরসন্ধি (১৯৬৮), জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১), রাজা উপাখ্যান (১৯৭১), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩); 

ছোটগল্প : পিজরাপোল (১৯৫০), জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প (১৯৫২), প্রস্তর ফলক (১৯৬৪), জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৭৫), মনিব ও তাহার কুকুর (১৯৮৬); 

শিশুতোষ : ওটেন সাহেবের বাংলো (১৯৪৪), ক্ষুদে সোশালিস্ট (১৯৭৩), পঞ্চসঙ্গী (১৯৮৭); 

প্রবন্ধগ্রন্থ : ভাব ভাষা ভাবনা (১৯৭৪), সংস্কৃতির চড়াই উত্রাই (১৯৮৫)।

ভূমিকা:

‘সৌদামিনী মালো’ গল্পটি শওকত ওসমান রচিত ‘নির্বাচিত গল্প' (১৯৮৪) থেকে চয়ন করা হয়েছে। গল্পটিতে বর্ণভিত্তিক হিন্দু সমাজে জাতভেদ, ধর্মানুভূতির নামে মাতৃহৃদয়ের অবমাননার দিকটি ফুটে উঠেছে। অর্থ সম্পদের লালসায় ধর্মকে ব্যবহার করে মানবতার বিরুদ্ধে সমাজের মানুষের অবস্থানই এ গল্পের আলোচ্য বিষয়।

সৌদামিনী মালো

-শওকত ওসমান

একটু দাঁড়াও।

আমার বন্ধু নাসির মোল্লা কোর্টের প্রাঙ্গণে হাঁটতে হাঁটতে হাতে হেঁচকা টান দিয়ে বললে। কী ব্যাপার? ব্যাপার আছে। কোর্টের পেছনে একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। দেখে আসা যাক। আমার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা। খাজনাসংক্রান্ত একটা মামলা ছিল, তার পরের দিন। নচেৎ এখানে এই টন্নি-দালাল উকিল-মোক্তারের দঙ্গলে আর এক তিল দাঁড়াতে মন চায় না। কিন্তু আমার মামলায় তদবির, যুক্তি-পরামর্শ উকিলের দরদস্তুর নাসিরই করে। এদিকে আমার মগজ দৌড়ায় না। অগত্যা মোগলের সঙ্গে খানা খেতে হয়। আমার আরও আপত্তি ছিল অন্য কারণে। আদালতের পেছনে যাওয়া কতটা বিলাত ঘুরে মক্কা আসার মতো। কোর্ট টিলার ওপর। পেছনে যেতে হলে এক ধাপ নিচে নেমে আবার ওপরে উঠতে উঠতে জান খারাপ। রীতিমতো হাঁপানি ধরে যায়। তবু নাসিরের অনুরোধ এড়াতে পারলাম না। আমরা দুজনেই চাকরি থেকে রিটায়ার করেছি। এখনও সংসারের গেরো কাটেনি। আর সময় কাটাবে কী করে? কিছু না কিছু কাজে লেগে থাকতেই হয়। নাসির পাকাপোক্ত লোক। তার হাতে হাত সঁপেই আমি নিশ্চিন্ত। এই ক্ষেত্রে আর ঘাড় বাকিয়ে জোয়ালের ভার আরও বাড়াতে রাজি নই। কিন্তু টিলাপথে যথারীতি নেমে আবার ওপরে ওঠার সময় তামাশা দেখা গেল। আদালতের পেছনে এক ফালি মাঠের ওপর বেশ ভিড় জমে গেছে একটা পাদ্রিকে ঘিরে। যিশুখ্রিষ্টের সেবকটিকে আমরাও দেখতে পাচ্ছি। সামনে টাক-পড়া মাথা, ফরসা লম্বাটে চেহারা। গলায় ক্রস ঝুলছে। এ তো আমার চেনা লোক! ব্রাদার জন। নাসির হঠাৎ বলে উঠল। আমরা ক্রমশ ওপরে উঠছি। ধাপে ধাপে পা ফেলতে ফেলতে নাসির উচ্চারণ করে, আরে তুমি চিনবে না। এ হচ্ছে ব্রাদার জন। একবার কেরোসিন ব্ল্যাকমার্কেট করার অপরাধে আমার কোর্টে ব্যাটা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিল। পরে সে কাহিনি বলব।

এখন পা চালাও, দুজনে হাঁপিয়ে উঠছিলাম। বৃদ্ধকালে পাহাড়-চড়া অত সহজ নয়। অকুস্থলে দেখা গেল, লোকজন কম জমেনি। ব্যাপার কী? ব্রাদার জন তখন চিৎকার করছে, এই সম্পত্তি খুব ভালো আছে। Very good ভেরি গুড। আমরা দুই কৌতুহলী দর্শক। গিজগিজ ভিড়ের কিনারায় দাড়িয়ে শুনতে লাগলাম। পাদ্রি হাঁকছে, দর্শকমণ্ডলী। আমি তখন নাসিরকে বললাম, বেশ বাংলা বলে তো। বহুদিন এই দেশে আছে, বলবে না কেন? নাসির জবাব দিয়েই আবার পাদ্রির ওপর চোখ ফেলল। পাদ্রি হাঁকতে লাগল, দর্শকমণ্ডলী! এই সম্পত্তি খুব ভালো সম্পত্তি আছে। এক প্লটে বারো ‘কানি জমি। পুকুর। আরও আছে তিন একর জমির ওপর বসতবাড়ি, পুকুর, গাছপালা, দশটা নারিকেল গাছ, লিচুগাছ পাঁচটা আরও ফুট-ফলের গাছ আছে। এখন নিলাম ডাকা হবে। প্রস্তুত। ব্রাদার জন দম নিল।

কৌতুহলী শ্রোতা দর্শক এবার উৎকর্ণ। একজন নেপথ্যে জানতে চাইল, সম্পত্তি কার? এই সম্পত্তির মালিক হচ্ছে সৌদামিনী মালো সিস্টার। আজব নাম! পাদ্রি ব্যঙ্গ স্বর শুনে আরও বিনয় সহকারে ঈষৎ জোর-গলায় বলে উঠল, সৌদামিনী মালো চার্চের সিস্টার- বহেন, ভগ্নী ছিল। তিনি এক মাস হয় মারা গেছেন। চার্চ তার সম্পত্তি নিলাম করছে। শ্রোতাদের মধ্যে এবার একটু চাঞ্চল্য দেখা যায়, কারণ আকাশের রোদুর বেশ নির্দয়। হঠাৎ গরম পড়ছে। নেপথ্যে একজন বললে, সাহেব জলদি করো। অলরাইট উচ্চারণের পর ব্রাদার জন হেঁকে উঠল, সৌদামিনী মালো, সৌদামিনী মালো, তারই সম্পত্তি এবার নিলাম শুরু হবে। আমাদের পয়লা ডাক পাঁচ হাজার। তারপর আপনারা বিডিং করুন। হায়েস্ট বিডার’ উচ্চতম মূল্যে যিনি ডাকবেন, তিনিই পাবেন। পাদ্রির সঙ্গে দুজন কুলি শ্রেণির যুবক ছিল। তাদের দিকে চোখ ইশারামতো একজন হেঁকে উঠল, পাঁচ হাজার, পাঁচ হাজার, পাঁচ হাজার। তার ডাকের মধ্যে জনান্তিকে একজন ডাক দিলে, পাঁচ হাজার পাঁচশ। পাদ্রির সহকারী হাঁকলে পাঁচ হাজার পাঁচশ। আর কেউ ডাকবেন। কিন্তু আর কারো হাঁকডাক শোনা যায় না। অবিশ্যি দর্শক-মধ্যে গুজগুজুনি চলছে নানা কথা। পাদ্রি-সহকারী আবার হাঁক দিলে, পাঁচ হাজার পাঁচশ- এক পাঁচ হাজার পাঁচশ- দুই-। হঠাৎ একজন ডাক বাড়ালে, ছ-হাজার। ভেরি গুড, ব্রাদার জন বলে উঠল। তার সহকারী ছ-হাজার ছ-হাজার রবে আরও কয়েকবার হাঁক দিলে। শেষে আর একজন ডাকিয়ে বাড়াল। সে সাত হাজার দাম তুলে দিলে। আমরা বেশ মজা দেখছিলাম। কিন্তু বাড়তি টাকা তো নেই। পেনশনে যে কটা টাকা পাই তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে। নচেৎ এত বড় সম্পত্তি পাওয়া যেত। বড় আফসোস হতে লাগল। দাড়িয়ে ছিলাম, সম্পত্তি কোন ভাগ্যবানের পাতে যায় তা দেখার জন্যে। নিলাম জমে উঠল কিছুক্ষণের মধ্যে। কিন্তু ন-হাজারের পর আর দাম শতে শতে লাফ দিয়ে যায় না। একজন ডাকলে নহাজার ন-শ পঞ্চাশ। আরও পঞ্চাশ টাকা বাড়ল। দশ হাজার।

পাদ্রি-সহকারী হাঁক দিতে লাগল দশ হাজার এক- দশ হাজার দুই-। তারপর সে স্তব্ধ। জনতা নীরব। তিন বলার আগে একজন মাত্র পঁচিশ টাকা যোগ দিলে। দশ হাজার পঁচিশ। ওদিকে রোদুর বাড়ছে। বৃদ্ধকালে তবু কেন দাঁড়িয়েছিলাম? আজ বলতে লজ্জা নেই। হয়ত সম্পত্তির লোভে। ক্ষুধার্ত কালেভদ্রে অপরের খাওয়া দেখেও নাকি শান্তি পায়।  শেষ পর্যন্ত আরও পঁচাত্তর টাকা দাম বাড়ল। অর্থাৎ দশ হাজার একশ। বোঝা গেল, নিলাম ডাকিয়েদের পকেট শুকিয়ে যাচ্ছে। রস নাদারা। যিনি শেষ পঁচিশ টাকা বাড়িয়েছিলেন, ভিড়ে তাঁকে দেখা গেল না। তবে হাত নাড়ছিল সে অপরের কাঁধের ওপর দিয়ে। পাদ্রি-সহকারী হাঁক দিলে, দশ হাজার একশ- এক, দশ হাজার একশ- দুই-। সে থামলে তারপর। পাঁচ ছ-মিনিট কেটে গেল। আর তিন উচ্চারণ করে না সে। এবার লোকটাকে দেখলাম, যে দশ হাজারের ওপর একশ বাড়িয়েছিল। মাঝবয়সী লোক, কিন্তু বুড়োবুড়ো ঠেকে। প্যান্ট-কোট-টাই সমন্বিত। মাথায় মখমলের টুপি। বাজি মেরে দিয়েছে, এই ভাব চোখেমুখে। কতক্ষণ আর নিলাম-ঘর চুপ থাকতে পারে? কিন্তু ‘তিন’ আর উচ্চারিত হয় না। দর্শক অধৈর্য। সেও জবাব চেয়ে বসল। এখন বেশ মজা বেধে গেছে। কৌতূহলী দর্শক তাই দাঁড়িয়ে থাকে। রোদুর সত্ত্বেও নড়ে না। ব্রাদার জনের মুখের দিকে তাকাই। সেখানে কালো আর ফিকে সবুজ রং খেলা করছে মুহূর্তে মুহূর্তে। কিন্তু একটা কাশি দিয়ে হঠাৎ অপ্রতিভ হয়ে উঠে সে হাঁক মারলে, দর্শকমণ্ডলী। কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। নিলামদাতা এবার কী করবে।

ব্রাদার জন মুখ খুললে, যেন গির্জার পুলপিট অর্থাৎ প্রচারবেদি থেকে সার্মান দিচ্ছে এমনই কণ্ঠস্বর : ভ্রাতৃগণ, আজ নিলাম। এখানেই রহিত থাকবে। আগামীকল্য পুনরায় ডাকা হবে। আজ লোক খুবই কম। কাল দশ হাজার এক শ হইতেই আরম্ভ হইবেক। আমেন। দর্শকদের মধ্যে অনেক গুলতানি শুরু হলো। আর টুপিপরা সেই শেষ পোঁচ-মারা নিলাম-শিল্পী তো রেগেই খুন। ব্রাদার জনের চারদিকে জটলা পেকে গেছে। সেখানে ভদ্রলোক জোর গলায় বলছে, This is sheer hypocrisy এটা জোচ্চুরি... ইত্যাদি। আমার কৌতূহলের মাত্রা আরও বেড়ে গিয়েছিল। ভিড়ের সান্নিধ্য এই ক্ষেত্রে আরামদায়ক। আমি তাই পা বাড়াই। নাসির আমার হাত ধরে হেঁচকা টান মেরে বললে, আরে ভিড়ে সেঁধিও না। একটু মজা দেখে যাই। -মজা দেখে আর কাজ নেই। যা গরম সর্দিগর্মি হয়ে মরব, চলো বাড়ি যাই। -একটু দেখে যাই না। -দেখে কাজ নেই। আমার কাছ থেকেই সব বৃত্তান্ত শুনে নিও। আকাশে সূর্য তখন দোজখের পিণ্ড বললেই চলে। আমি নাসিরের কথা মেনে নিলুম। আবার চড়াই-উত্রাই। ওঠানামার ব্যাপারটা এমন কষ্টকর। নাসির হেসে বললেন, আরও মজা দেখতে গেলে আমাদের মাজা ভেঙে যেত। রসিকতার দিকে আমার খেয়াল ছিল না। আমি বললাম, নাসির, ব্যাপার কী? সে বেশ মাথা দুলিয়ে হঠাৎ ব্যঙ্গ আর ক্রুরতা-মাখানো এক রকমের হাসি ছাড়িয়ে শেষে মুখ খুলল, বাবা, এর নাম ব্রাদার জন। জন? হাঁ, ও এক জন বটে। আমার কোর্টে কেরোসিন ব্ল্যাকমার্কেটের দায়ে অভিযুক্ত। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, What have you to say তোমার কী বলার? জন জবাব দিল End justifies the means, উদ্দেশ্য দিয়েই উপায়ের বিচার করা উচিত। আমি ব্ল্যাকমার্কেট করিয়াছি ভিক্ষুকদের লঙ্গরখানায় ভাত প্রদানের জন্য।

-অপরাধ স্বীকার করলে? -হ্যা। প্রথম অপরাধ। তাই ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ব্যাটা পাকা বদমাশ। আজ দেখলে না, কীভাবে ম্যানেজ করলে। -কী ম্যানেজ? -ওই সম্পত্তির দাম কমসে কম পঁচিশ হাজার। দশ হাজারে ছাড়তেই পারে না। নাসির আমার দিকে মুখ কুঁচকে চোখ নাচিয়ে, জনের বাহাদুরির অবস্থাটা ফোটাতে চাইলে। -কিন্তু সৌদামিনী মালোর সম্পত্তি, আর নিলাম করছে ব্রাদার জন? এ ব্যাপারটা কী? নাসির তার সাদাচুল মাথা দুলিয়ে চোখের কোনায় হাসি মাখিয়ে জবাব দিলে, সেটাই তো মজা। -মজা? -শোনো। সে অনেক কথা। ব্রাদার জনের মতো চিজকে ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেক বয়ান প্রয়ােজন। -তো বয়ান করো। বেলার দিকে খেয়াল আছে? খেয়েদেয়ে এসো সন্ধ্যায় আমার বাড়ি, তখন সব সবিস্তার বলব ব্রাদার জন-সৌদামিনী মালো উপাখ্যান। -না, অত দেরি করতে পারব না। খেয়ে একটু জিরিয়েই বিকেলে আসছি। বিকেলের চা তোমার ওখানেই খাব। -বেশ। কথায় কথায় আমরা রাস্তায় এসে পড়েছি। উত্রাই শেষ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা চালাতে লাগলুম। জানো সাজ্জাদ, ভাবছি কোথা থেকে আরম্ভ করব। ব্যাপারটা বেশ জটিল। নাসির মোল্লা এখন বুড়ো হয়ে এসেছে বলতে পারো । তাই ভয় পাচ্ছে। তবে শুরু করতে হয়।

সৌদামিনী মালো নবীগঞ্জের অধিবাসিনী। নবীগঞ্জে যে ব্যাপটিস্ট মিশন আছে, তারই কাছাকাছি। তুমি ওই অঞ্চলে কত দিন সার্কেল অফিসার ছিলে, জায়গাটা তো চেনই। অবিশ্যি তখন ওখানে মিশনের পাদ্রি ছিল ফাদার জনসন। লোকটা ভালোই। এদের আবার ভালোমন্দ কী? ব্রিটিশ রাজত্বের ভিত পাকা করতে এদের এখানে সেখানে ছড়িয়ে দেওয়া হতো, যেন দরকার মতো আউটপোস্টের কাজ করতে পারে। গরিব দেশে এখানে ওখানে দু-চারটে দাতব্য ডিসডেন্সারি কী এক-আধটা স্কুল চালায়। লোকেরা ভাবে, আহা কী সব দয়ার প্রাণ; ব্রিটিশরা ভালোই জানত, The nearest way to poor man's heart is down their throat- ইংরেজেরই প্রবাদ। ওরা এইভাবে কিছু কিছু খ্রিষ্টানও বানায়। তারা তো ইংরেজের খয়ের খা বনে যেত। বলতে পারো- ইংরেজ করে ফেলে। পড়েনি নজরুলের মৃত্যু-ক্ষুধা’? আসলে এরা কেউ যিশুখ্রিষ্টের ভৃত্য নয়, এরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভৃত্য। হ্যা, কোথা থেকে কোথা এসে পড়লাম। একটু ধৈর্য ধরে শোনো। বৃদ্ধকালে তাল রাখা দায়। কথায় কথায় অনেক দূর চলে গেছি। হ্যা, সৌদামিনীর স্বামী জগদীশ মালো ছিল পেশায় আরদালি। কিন্তু বেজায় তুখোড় লোক। প্রভুর মন জুগিয়ে চলা শিল্প সে বেশ রপ্ত করেছিল। যে কোনো অফিসারকেই খুশি করার পন্থা আবিষ্কারে দক্ষ জগদীশ মালো। ফলে, কলা-মুলো ভালোই পেত। বশিসে মোটা পেট, এমন আরদালি তুমি দুটি খুঁজে বের করতে পারবে না। আমি অবশ্যি তাকে দেখিনি। আমারও শোনা কথা। সস্তার বাজার। পুরা বেতন বাঁচল, তার ওপর উপরি ইনকাম। আর সে তো মিশরের সম্রাট হতে চায়নি।  চেয়েছিল, গ্রামে দু-চার বিঘে জমি-জিরেত, একটু অনটন-মুক্ত দিন-যাপন। পনের-বিশ বছরের চাকরিতে জগদীশ তা পুষিয়ে নিলে। কিন্তু বেচারার একটা বেশ দুঃখ ছিল। ছেলেপুলে নেই। সৌদামিনীর স্বামী স্থির করলে, আর একটা বিয়েই যুক্তিযুক্ত; অন্তত চেষ্টা করে দেখা যাক। বংশ তো গুম করে দেওয়া চলে না? কিন্তু বেচারা বর সাজার অবসর পায়নি। হঠাৎ মরে গেল। অথচ বিয়ের কথাবার্তা ঠিক। তার মৃত্যুটা আজও রহস্য রয়ে গেছে। কু-লোকেরা রটিয়ে দিলে সৌদামিনী তাকে বিষ খাইয়েছে। বংশ রক্ষা হােক, কিন্তু অপরের সন্তানে নয়। সৌদামিনী ভিতরে ভিতরে হয়ত এমন একটা দুর্জয় পণ করে বসেছিল। এসব খোদাকেই মালুম। এসব ক্ষেত্রে কোনো মেয়ে কী করে, বোঝা দায়। কিন্তু তুমি বলছ, স্বামীকে হত্যা করবে- তা অনুমান করা মুশকিল। মুশকিল কিছুই নয়। এমন হতে তো পারে। আমিও বলছি, গুজবের কথা। কারণ, এসব নিয়ে আর কোনো তদারক হয়নি। তখন সৌদামিনীর বয়স চল্লিশ পার। জগদীশ পঞ্চাশের সামান্য এদিক কি ওদিক। হয়ত যৌবনের খাই নেই, তবু সতীন বা সতীনের ছেলে আসবে- তা সৌদামিনী মনের সঙ্গে মেলাতে পারেনি। এতএব ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গােয়াল’ আচ্ছা। আমিও বলছি, অনুমানের কথা। যাক, ও-পাট চুকল। সৌদামিনী তখন একা। কিন্তু সেও হুঁশিয়ার মেয়ে। আর রদব ছিল জোর। তখনও দেহ আছে, তার ওপর সম্পত্তি। গ্রামের দু-চার জন ছুঁচোর মতো হয়ত হে হে শব্দে ঘুরঘুর করছিল। কিন্তু সৌদামিনী গােপনেও জগদীশেরই বউ হয়ে থাকল। অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। অবিশ্যি জগদীশ একটা কাজ করে যেতে পারত। কোনো আত্মীয়ের নামে সম্পত্তি লিখে পড়ে সৌদামিনীকে জীবনস্বত্বের অধিকারিণী করে দিতে পারত। কিন্তু তা হওয়ার জো ছিল না। এক নিকট আত্মীয় ছিল জেঠতুতো দাদা। সে স্বদেশি করত। জগদীশ সরকারের পেয়ারের লোক। অন্য দিকে স্বদেশি বাবু। সাপে-নেউলে আর কী দিয়ে বন্ধুত্ব হবে। এসব কথা তোমাকে শোনাচ্ছি, তাহলে সব বুঝতে পারবে। জগদীশ তো মরল। কিন্তু জের কাটল না। বিধবার সম্পত্তির দিকে ওই আত্মীয়ের লোভ সহজে কি মেটে! অবশিষ্ট আট দশ বছর এইভাবে কেটে গেছে। স্বদেশি বাবুর নাম মনোরঞ্জন মালো। তারও বয়স হয়ে গিয়েছিল।

ছেলেপুলে আছে। জেল-টেল খেটে গ্রামে ফিরে সে নামে স্বদেশি বাবু রইল। সাদা টুপিটা পকেটে গুঁজে অথবা দরকার হলে। মাথায় দিয়ে সেও মন দিলে সংসার গােছাতে। গ্রাম্য দলাদলির মধ্যে মাথা গলান এবং তৎ-মত্ততার দুচার পয়সার দালালি বা টন্নিগিরি কমিশনে একটা আয়ের পথ তো খোলা যায়। এককথায়, স্বদেশি বাবুর শুভ্রতা তার টুপির মধ্যেই নিবদ্ধ রইল। পাশাপাশি বাড়ি, সুতরাং বিধবা বৌদির দিকে নজর পড়া স্বাভাবিক। ভুল বললাম, বৌদি নয়, সম্পত্তির দিকে। কিন্তু সৌদামিনীর শরীর গৌর আর মুখ সুন্দর হলেও, কঠোর হওয়ার মতো যথেষ্ট তেজ ছিল। অবরে-সবরে এই মানুষ আবার হীরার চেয়ে শক্ত হতে পারে। যত বাগড়া তো সেইখানে। নচেৎ মনোরঞ্জন মালো কবে দুর্গ ফতে করে ফেলত। মনোরঞ্জন মালো প্রথম প্রথম কতগুলো স্ট্রাটেজি- পাঁয়তারা কষে নিলে। একদিন হয়ত সকালে দেখা গেল, সৌদামিনির কলাবাগান থেকে কয়েক কঁাদি পাকা ফল গায়েব। কিছু চারাগাছ মাড়ানো। কিন্তু পাড়াপড়শিদের খুব মিষ্ট ভাষায় ব্যাপারটা জানিয়ে এল। আর কিছু না। তারপর মাঝে মাঝে রাত্রে সে বন্দুক ছুড়ত। কমিশনার সাহেব জগদীশকে নিজের বন্দুক দিয়েছিলেন বখশিসরূপে। অস্ত্রখানা তখনও সৌদামিনীর কাছে আছে। তাছাড়া তার তাক আশ্চর্য। বাড়ির উঠানে চিল ঢুকতে সাহস পায়। মনোরঞ্জন ফেল মারলে। বৌদির চেহারা সুন্দর, কিন্তু তেজ তেমনি অপর্যাপ্ত। অবিশ্যি সৌদামিনীর হাতে কয়েকটা লোক ছিল। তার জমিনের চাষি, কয়েকজন। তারা বলত, মায়ের অন্নে প্রতিপালিত, মার তো অপমান হতে দিতে পারি নে। স্বদেশি বাবুর সেও একটা ভয়। ছোটো লোকগুলো কখন কী করে বসে, বলা যায় না। আর সৌদামিনীর অন্তর ছিল। বিপদে-আপদে সে বহু মানুষকেই সাহায্য করত। বেড়ার মধ্যে গেরস্থর মুরগি দেখলে জিভে জল-সরা শেয়াল যেমন ঘন ঘন তাকায় আর লোভের চোটে ছটফট করে, মনোরঞ্জন মালো সেই রকম অবস্থায় নতুন পাঁয়তারা ভজতে লাগল। কী করা যায়, কী করা যায়। অবিশ্যি সময়ও এদিকে গড়িয়ে যাচ্ছে, তা মনে রেখো। বছর যাচ্ছে বছর আসছে। সৌদামিনীর চুল ক্রমশ সাদা, দেহে প্রৌঢ়ত্বের রেখা। কিন্তু আদাওতি ঠিক চলছে। সৌদামিনী বনাম স্বদেশি বাবু। ঠিক এই পর্যায়ে দেখা দিল ব্রাদার জন। সে তো পরকালের চেয়ে ইহকালের খবর ঢের বেশি রাখে। তারপর মিশনের অবস্থা ভালো নয়। ইউরোপে মহাযুদ্ধ বেধেছিল। ফলে ডােনাররা আর খাত-মতো চাঁদা পাঠায় না বা হার দিয়েছে কমিয়ে। সুতরাং আয়বৃদ্ধির উপায় একটা করতেই হয়। ব্রাদার জন এলাকার খবর জানত। মনোরঞ্জনের সঙ্গে তার বিলক্ষণ পরিচয় ছিল। কারণ, বাবু এলাকার সবচেয়ে ভালো ইংরেজি কইয়ে-বলিয়ে। ভাষা মারফত একটা অদৃশ্য যোগসূত্র গড়ে ওঠে। অবিশ্যি তখন পাদ্রির ভূমিকা তত প্রকট হয়নি। আর বাবুর সঙ্গে কী কথাবার্তা হতো তা খোদকেই মালুম। কিন্তু সৌদামিনী সকলের মুখে ছাই দিয়ে বসল।

ব্যাপারটা বলছি। সৌদামিনী মাঝে মাঝে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে যায়। আট-দশ-বিশ-মাইল দূরে দূরে তার মাতৃকুলের কিছু ভাইবোন কুটুম আছে। এক জায়গায় থেকে থেকে মানুষের প্রাণ তো হাঁপিয়ে ওঠে। সৌদামিনী বছরে এমন দু-একবার দম ফেলতে বেরুত। তখন ঘর পাহারা দিত তার চাষি এবং কামিনেরা। সৌদামিনী এই ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিল। কারণ, ওরা রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিলে আর কোনো আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু এবার সে শুধু বেড়িয়ে এলো না, সঙ্গে নিয়ে এলো একটা বছর দুয়েকের শিশু। এক আত্মীয়ের কাছ থেকে আনা। পোষ্যপুত্র রাখবে সৌদামিনী। পোষ্যপুত্র? সম্পত্তির দিকে যারা চোখ রাখছিল, তারা এবার আকাশের দিকে চোখ তুললে। সম্পত্তির নতুন শরিক জুটে গেছে। আর শুধু মালিক নয়, চিরস্থায়ী উত্তরাধিকারী। যেন সদ্য আঁতুড়ঘর-ছাড়া। চব্বিশ প্রহর চোখে চোখে রাখতে লাগল ছেলেটাকে। নাম রাখলে হরিদাস। হরিদাস বেড়ে উঠতে লাগল। চেহারাটা ফরসা, বেশ খাড়া নাক। আর চোখ দুটো ঝিলিকে ঠাসা। সৌদামিনী হরিদাসের মধ্যে জীবনের সমস্ত পূর্ণতার একটা প্রতীক খুঁজে পেলে যেন। বেশি বাইরে যেতে দিত না তাকে। কারণ, পাড়াপড়শির চক্ষুশূল। ওর জন্যে আলাদা একটা শিক্ষকই রেখে দিলো বাড়ি এসে পড়িয়ে যাওয়ার জন্যে। আরও পাঁচ-ছ বছর এভাবেই কেটে গেল। সৌদামিনীর অবিশ্যি চুল পেকে গেছে। চেহারা নিষ্প্রভ। কিন্তু তার মুখাবয়বে একটা পরিতৃপ্তির আভা ছিল। সেই মুখের দিকে তাকালে তোমার চোখ খুঁজে পাবে স্নিগ্ধতা, দয়াসঞ্জাত এক রকমের তাপহর স্পর্শ। অবিশ্যি মনোরঞ্জন বসে নেই। তারও বয়স বাড়ছে। আর তৎসঙ্গে সংসার। অর্থাৎ সর্ব রকমের বোঝা। সম্পত্তির দিকে চাইলে এখন চোখ পুড়ে যায়। নতুন শরিক এসে জুটেছে। হরিদাসের বয়স বারো। একটা মেয়ে মানুষের কাছে হেরে যাবে মনোরঞ্জন মালো? একটা কিছু করতে হয়। ব্রাদার জনের মিশন চলছে না ঠিকমতো। রুজি-রোজগার প্রয়ােজন। একদিন ওদিকে গেলে কিছু একটা যুক্তি করা যায়। মনোরঞ্জন মনে মনে এসব লঙ্কাভাগ করেছিল নিশ্চয়। আঁচ করতে পারো সাজ্জাদ। ... হ্যা, জ্ঞাতি শত্ৰু বড় শত্রু। মনোরঞ্জন মালো এবার একটা বোম ফাটালে, স্বদেশি আমলে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে থেকেও যা সে করতে সাহস পায়নি।

সে গ্রামময় প্রচার করে দিলে সৌদামিনীর পোষ্যপুত্র জাতে নমশুদ্র নয়, ব্রাহ্মণ। ব্যাপারটা তলিয়ে দেখ। কী ভয়ানক শাস্ত্রবিরুদ্ধ পাপকর্ম। ব্রাহ্মণের জাত মেরেছে এক শূদ্রাণী। রাম, রাম। মনোরঞ্জন এই ঢিলে পাখিকে কাত করে ছাড়লে। আগে শত্রুতা বা ঈর্ষা যা বলো, ছিল ব্যক্তিগত। এবার তা সমাজগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। গ্রামে দু-চার ঘর ব্রাহ্মণকায়েত-মাহিষ্য ছিল, তারা দাঁতে আঙুল কাটলে। ছি ছি, এমন কথা কে কোনদিন শুনেছে। যাদের বয়স বেশি তারা মন্তব্য। করল : কলি কাল। সৌদামিনীকে গ্রাম্য-সমাজের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো। সে বেশ জোর দিয়ে হলপ করে বললে, হরিদাস শূদ্র- তার দূরসম্পৰ্কীয় এক গরিব আত্মীয়ের ছেলে। পরিস্থিতি আপাতত এখানে চুকল। কিন্তু সৌদামিনীর বিরুদ্ধে তো মনোরঞ্জন একা নয়। আরও ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির আছে। সুতরাং গ্রামের অচল নিষ্কর্মা প্রহর তারা সহজে যেতে দিলে না। খোজ নিয়েই দেখা যাক। যদিও বিশ মাইল দূরে, কিছু রাহা খরচ যাবে, যাক। আহা, ভগবান যাকে ডাক দেয় সে তো হেঁটে হেঁটে বারানসি চলে যায় তীর্থ করতে। এই দশ ক্রোশ পথ আর তারা সামাল দিতে পারবে না? বোঝা গেল ওদের সেবার ভগবান ডাক দিয়েছিল। একজন দেব-উৎসর্গিত প্রাণ বারোয়ারি রাহা-খরচে সৌদামিনীর সেই আত্মীয় বাড়ি থেকে খোজ নিয়ে ফিরল। বাজিমাতা মজকুর ব্যক্তির কোনো ছেলেই নেই। সব মেয়ে। সৌদামিনী ঝুট বলেছে, মিথ্যাবাদিনী। সমস্ত গ্রাম তোলপাড়। ধর্মের কল বাতাসে নড়ছিল, সেটা যুধিষ্ঠিরের দল থামাতে চায়। তো নচেৎ কল তো ভেঙে যেতে পারে। সৌদামিনী এবার তো বেশ রোয়াবের সঙ্গে জবাব দিলে কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করলে না। সমস্ত গ্রাম তার বিরুদ্ধে। আর জুলুম শুরু হলো। তার ছাগল মাঠ থেকে আর ফিরল না, দুধেল দুটো গাই হারিয়ে গেল। এমন ছোটোখাটো নিত্য নির্যাতন। একদিন ব্রাদার জন এই সময় গ্রামে এল। ইহকালের খবর সে পরকালের চেয়ে কম রাখে না, আগেই বলেছি। ব্রাদার জন সব শুনে গ্রামবাসীদের মিটিয়ে ফেলতে বলল ব্যাপারটা, সৌদামিনীর সামনেই। একটা ছেলে মানুষ করছে ... মানুষ ... সে শূদ্র আছে না কায়েস্ত আছে গড় এসব দেখিতে বারণ করিয়াছে ... এই জাতীয় নানা বাণী ছাড়লে। সৌদামিনী কাঁদতে কাঁদতে ব্রাদার জনকে উকিল পাকড়ালে একটা মিটমাটের জন্যে। মনোরঞ্জন মালোর সঙ্গেও একপাশে চুপি চুপি কী কথা হলো তা ব্রাদার জনের গড়ই জানে। বিষয় নিস্পত্তি প্রয়ােজন। কিন্তু মনোরঞ্জন মালো তো সম্পত্তি নিষ্পত্তি চায়। ব্রাদার জন বললে, দুদিন সবুর করো, আমি ফয়সালা করিয়ে দিবে। আর মনে রেখ, সৌদামিনী এখন কোণঠাসা। এক হপ্তায় তার চুল শন হয়ে গেছে। আগে তো বুড়ি মনে হতো না, এখন তো শ্মশানযাত্রীর শামিল ধরে নিতে পার। বুড়ি সেই অবস্থায় ওকে যারা দেখেছিল, তাদের কাছেই শুনেছি। হরিদাস আর বাড়ির বাইরে যেত না। যেতে চাইলে সৌদামিনী কেঁদেকেটে বাধা দিত। চতুর্দিকে ঘােলাটে আবহাওয়া। ব্রাদার জন এই গ্রামে আসে কিন্তু সৌদামিনীর সঙ্গে দেখা করে না।

শেষে কয়েকজন মরিয়া-ধর্মপুত্র তো একদিন সৌদামিনীর বাড়ি হামলা করে বসল। কিন্তু শান্ত প্রকৃতির বুড়ো মানুষ এই ঈশ্বর-প্রাণ ব্যক্তিদের থামাল। সৌদামিনী বাপের বেটি। বাঘের দুধ খেয়েই বোধ হয় মানুষ বেরিয়ে এল একদম নিরস্ত্র, যদিও বাড়িতে বন্দুক আছে। ক্ষিপ্ত জান্তার সামনে সে এবার বোমা ফাটাল। বোমাও বোধ হয় এত শব্দ তুলতে পারত না। সৌদামিনী চোখ থেকে শিবের মতো আগুন ছড়িয়ে বললে... কী বললে শোন। তার কথাটাই মুখজবানি পেশ করতে হয়। সৌদামিনীর ওপর তখন যেন কিছু ভর করেছিল। -শোন অভাগির ব্যাটারা, ধর্মপুর যুধিষ্ঠিরের দল ... আমার হরিদাস শূদ্রও নয়, ব্রাহ্মণও নয়। শোন, কী। তোরা তো জানিস। আমি বছরে একবার-দুবার আত্মীয়বাড়ি যাই। তখন পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ, একদম পুরো কোটাল। গায়ে গায়ে হাজার দু-হাজার লোক মরছে হপ্তায়। আমি ফিরছিলাম হরিশ্চক থেকে ... আলোকডাঙার কাছাকাছি আসতে বেহারাদের তেষ্টা লাগল। একটা আমগাছের তলায় পালকি রেখে ওরা গেল খেতে। পুকুর আছে, বিঘে দুই জমি দূরে। আমার সামনে আবার একটা ধানক্ষেত, ধান পেকে গেছে। আর পনের দিন বাঁচলে কত লোক বেঁচে যেত নিজের ক্ষেতের চাল খেয়ে; কিন্তু তার আর হলো কই। হঠাৎ শুনলাম, ধানক্ষেত থেকে শিশুর কান্না আসছে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম। দেখলাম একটা লোক জমিন আঁকড়ে মরে পড়ে আছে। মুখে দাড়ি। তার পাশে একটা মরা মেয়ে। তার পাশে একটা ছেলে বসে মরা মায়ের বুকে মাথা রেখে কাদছে থেকে থেকে; আবার উঠে বসছে। কিন্তু সেও চিচি করছে। ধুকছে। ছেলেটার পানে চাইতে আমার দিকে হাত বাড়াল। চোখের চাউনি কী করুণ। আমিও অজানিতে হাত বাড়িয়ে দিলাম। বছর তিনেকের ছেলে, কিন্তু অনাহারে অনাহারে দেড় বছরের বেশি দেখায় না। কোলে তুলে নিলাম... নিয়ে এলাম... পালকির ভেতরে লুকিয়ে রাখলাম... আফিম খাই, সঙ্গে দুধ ছিল... দুধ দিতে ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়ল। বেহারারা টের পেলে না। এক আত্মীয়ের কাছে তিন মাসের জন্যে রেখে এলাম দুশ টাকা দিয়ে। ভালো খাওয়া দাওয়ায় ছেলেটা বেশ তাজা হয়ে উঠল। তার পর নিয়ে এলাম। ওর আসল বাবা সেই মুসলমান চাষি ... আমার হরিদাস মুসলমান ... যেন বাজ পড়ল উপস্থিত জনতার ওপর।

রেশ কাটল কয়েক মুহূর্ত পর। কিন্তু সৌদামিনীকে কেউ একটা উচ্চবাচ্য করতে সাহস পেল না। তামাশা দেখতে দু-চার জন মুসলমান পর্যন্ত জুটেছিল। এখন ব্যাপার আরও গন্ডগােলে গড়াতে পারে, তাই ধর্মপুত্ররা যে যার মানে মানে বাড়ি ফিরলে। বুঝল আর গােলমাল বিধেয় নয়। ব্যাপার আরও থিতিয়ে দেখা যাবে। মনোরঞ্জন অন্তত তাই-ই ভেবেছিল। তাই ভেগেছিল। সেই রাত্রে হরিদাস বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল। সৌদামিনী ব্রাদার জনকে ডাকিয়ে আনলে এক হপ্তা অপেক্ষার পর। সে খ্রিষ্টান হবে। ব্রাদার জন প্রথমে বারণ করলে, উপদেশ দিলে, ধর্ম ত্যাগ ভালো নয়। শোনা কথা বলছি। ধরে নাও তা হতেও পারে। নৌকা ঠেলে দিয়ে বিয়াইকে আজ থাকলে হতো’ বলার মতো। সৌদামিনী খ্রিষ্টান হয়ে গেল। তিন চার দিনের মধ্যে তার সমস্ত সম্পত্তি মিশনের নামে লিখেপড়ে দিলে পর্যন্ত। নিজে উঠে গেল মিশনের বাড়িতে। ব্রাদার জন সম্পত্তি দেখার জন্যে নতুন লোক নিয়ােগ করলে। সৌদামিনী এক মাসের মধ্যে পাগল হয়ে গেল। বদলি হওয়ার আগে এক সিন্টারের মুখে শুনেছিলাম, সৌদামিনী কাঁদত আর চিৎকার দিত : ...আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেলে- হে যিশু, ও হরি, হে আল্লা, আমার যবন হরিদাসকে ফিরিয়ে দে- ফিরিয়ে দে- ফিরিয়ে দেআজই জানতে পারলাম, এতদিনে হতভাগিনীর হাড় জুড়িয়েছে।


নির্বাচিত শব্দের অর্থ ও টীকা:

অকুস্থল ঘটনাস্থল। উৎকর্ণ- কান খাড়া করে আছে এমন। গেরো- বন্ধন, বাধন। গুজগুজুনি- গুঞ্জন। জনান্তিকে আড়ালে থেকে, একপাশে থেকে বা নেপথ্যে। জান খারাপ অবস্থা ভালো নয়। টন্নি- টর্নি, আমমোক্তার। নাদারাতবিহীন, শূন্য, অভাব, নাই। বয়ান- বিবরণ, বর্ণনা। বিডিং- নিলামে দাম হাঁকা। মোগলের সাথে খানা খেতে হয় বাধ্য হয়ে নতি স্বীকার করতে হয়, পরিস্থিতির চাপে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্মতি দিতে হয়। পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে’-প্রবাদটির অনুসরণে রচিত বাক্যবন্ধ। লঙ্গরখানা- বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণের স্থান। সার্মান- গির্জার বেদি থেকে প্রদত্ত ধর্মীয় বা নৈতিক অভিভাষণ। হায়েস্ট বিডার সবচেয়ে বেশি দাম হাঁকিয়ে,জনগণের আড়ালে। hypocrisy- কথায় এক কাজে আরেক, ভণ্ডামি। sheer- পুরোদস্তুর, নির্ভেজাল।

অবরে-সবরে- সময়ে-অসময়ে। আদাওতি শত্রুতা, বিদ্বেষ। কামিন- স্ত্রী-মজুর, মজুরনি।কায়েত- কায়স্থ। কোটালঅমাবস্যা বা পূর্ণিমায় সমুদ্র বা নদীতে জলস্ফীতি, ভরা জোয়ার। এখানে সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থা বোঝাতে ব্যবহৃত। খাই- কামনা-বাসনা। ডােনার- দাতা। তাপহর- উত্তাপ দূর করে এমন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির- মহাভারতের চরিত্র, অত্যন্ত সত্যবাদী ও ন্যায়নিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। পঞ্চপাণ্ডবের প্রথম পাণ্ডব। ধর্মদেবতার ঔরসে কুন্তির গর্ভজাত সন্তান। এই গল্পেব্যঙ্গার্থে সত্যবাদিতার ভানকারী, অতিশয় মিথ্যাবাদী বা রটনাকারী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফতে- জয়। বারোয়ারি রাহা খরচে- সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে সংগৃহীত পথ খরচে। ব্যাপটিস্ট মিশন- খ্রিষ্টধর্ম সম্প্রদায়ের প্রচার ও দীক্ষা  কেন্দ্র। মুখজবানি মুখের ভাষায়। মজকুর- পূর্ববর্ণিত। মালুম- অনুভূত, বোধগম্য। মাহিষ্য- কৈবর্ত জাতি। রোয়াব সম্রম। জান্তা- জোর করে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক চক্র, এখানে আক্রমণকারী। সার্কেল অফিসার- এক ধরনের সরকারি কর্মকর্তা,কার্যক্রম পরিমণ্ডলের কর্মকর্তা। রবদব- জাঁকজমক। স্ট্রাটেজি লক্ষ্য ও সাফল্য অর্জনের কৌশল বা নীতি।


সারসংক্ষেপ:

গল্পকার গল্পের এ-অংশে অর্থ-সম্পদের মোহ মানুষকে কীভাবে মানবিক গুণ থেকে দূরে সরিয়ে অন্যায় ও খারাপ কাজের  দিকে ধাবিত করে তা দেখিয়েছেন। গল্পের প্রথমে ব্রাদার জনের মাধ্যমে বৃটিশদের মানসিকতা, এদেশে তাদের দু-একটা  ভালো কাজে হাত দেবার উদ্দেশ্য, সর্বোপরি খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার প্রয়াস দেখিয়েছেন। গল্পের শুরুতে সৌদামিনী মালো নামের এক নিঃসন্তান ধর্মান্তরিত নারীর বিরাট বসতবাড়িসহ  সৌদামিনীর স্বামী জগদীশ মালো পেশায় আরদালি ছিল। সে অফিসারকে খুশি করে পনের-বিশ বছরের চাকরিতে ভালো অবস্থা করেছে। সৌদামিনীর ছেলেপুলে না থাকায় জগদীশ মালো আর একটা বিয়ে করার চিন্তা করে। কিন্তু জগদীশ বর  সাজার আগে কেন মারা গেল তা অজানা রয়ে গেল। এ সুযোগে মনোরঞ্জন মালো সুন্দরী সৌদামিনীর সম্পত্তি দখলের চেষ্টা শুরু করে। সৌদামিনী উত্তরাধিকারসূত্রে ধানি জমি, বসতবাড়ি, পুকুর, ফলের বাগানসহ কয়েক একর সম্পত্তির মালিক হয়। সৌদামিনীর সাহস ও লোকপ্রীতির কারণে জ্ঞাতি দেবর মনোরঞ্জন সৌদামিনীর কিছুই করতে পারেনি। সন্তানহীন প্রৌঢ়া সৌদামিনী মাতৃহৃদয়ের সুপ্ত আকাক্ষা পরিতৃপ্ত করার জন্য দূরদেশ থেকে আনা একটি শিশুকে সন্তানের মতো পালন করতে থাকে। মনোরঞ্জন তখন নমশূদ্রর ঘরে ব্রাহ্মণ সন্তান পালিত হচ্ছে বলে অপবাদ দিয়ে বর্ণবিভক্ত হিন্দু সমাজে ধর্মানুভূতির ধুয়া তুলে সৌদামিনীকে সমাজচ্যুত করার উদ্যোগ নেয়। সমাজের চাপে সৌদামিনী তার পালিত পুত্র যে মুসলমানের ঔরসজাত- এ সত্য প্রকাশ করে। এদিকে সৌদামিনীর পালিত সন্তান হরিদাস নিজের পরিচয় জানতে পেরে নিরুদ্দেশ হয়, আর এই শোকে সৌদামিনীর মানসিক বিকৃতি ঘটে। ব্রাদার জনের প্ররোচনায় স্বধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হতে বাধ্য হয়। মানুষের লোভ ও ধর্মান্ধতার কাছে মাতৃহৃদয় চূর্ণ হলেও মানবতার জয়গান ধ্বনিত হয়। মাতৃত্বের কাছে ধর্ম ও অর্থের পরাজয় ঘটে।

0 comments:

Post a Comment

Comment below if you have any questions

Contact form

Name

Email *

Message *