অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি (What is economic system)
মানবজীবন ও সমাজের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক আজন্ম এবং শাশ্বত। জীবিকার তাগিদে মানুষ যখন বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত, ফলমূল সংগ্রহ কিংবা পশু ও মৎস্য শিকার করে খাদ্যাভাব পূরণ করত, সে সময় থেকেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সূচনা। মৌলিক অর্থে অর্থনীতির গোড়াপত্তন হয়েছে আজ হতে প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বে। খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। এ সময় ব্যক্তিগত মালিকানারও সূচনা হয়, যা অর্থনীতিকে দ্রুত শক্তিশালী করে তোলে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলতে মূলত উৎপাদন ব্যবস্থা, ভোগ, বণ্টন তথা এগুলোর সাথে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে বুঝায়। এক্ষেত্রে সম্পত্তি, সম্পত্তির মালিকানা ইত্যাদি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণত মানুষ তার প্রয়োজন ও অভাব পরিপূরণের জন্য উপযোগ সমৃদ্ধ পণ্যের উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের যে ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে তাই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Economic system)।
Dalton-এর মতে, “অর্থনীতি হচ্ছে কিছু প্রতিষ্ঠিত কার্যক্রম, যা প্রাকৃতিক সম্পদ, মানুষের শ্রম এবং প্রযুক্তির সংমিশ্রণে পণ্য অর্জন, উৎপাদন এবং বণ্টন করে।” (An economy is a set of institutionalized activities which combine natural resources, human labour and technology to acquire, produce and distribute goods...)
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি নির্দিষ্ট স্থানে থেমে থাকেনি। মানুষ সর্বদা নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবনে সচেষ্ট থাকে। তাই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও বিবর্তিত হয়ে উন্নতি লাভ করেছে। মানুষের মেধা, মনন, সভ্যতা যেমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি অর্থনীতিও মানুষের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্ব (Importance of economic system)
আদিম সমাজে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। কিন্তু মানুষের জীবন-জীবিকা ছিল। মানব জীবনের এ স্তরে শিকার এবং খাদ্য সংগ্রহভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিরাজমান ছিল। পর্যায়ক্রমে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশ এবং সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। মানব জীবন, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্ব ও প্রভাব অনেকখানি। এখানে সমাজে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:
১) জীবিকার উৎস: যেকোনো সময়, সমাজ ও স্থানে জীবিকার উৎস হচ্ছে এর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই মানুষের জীবিকা নির্ধারিত হয়। কৃষি কিংবা শিল্প, সামন্ত কিংবা পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা-ই হোক না কেন তা মানুষের জীবিকার উৎস হিসেবে কাজ করে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কেউ শ্রমজীবী আবার কেউ মালিক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু সবার প্রধান লক্ষ্য থাকে সেখান থেকে জীবিকা নির্বাহ করা।
২) সভ্যতা বিকাশের হাতিয়ার: অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সভ্যতা বিকাশের প্রধান হাতিয়ার। কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সভ্যতার সূচনা ও বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। কৃষিতে উদ্বৃত্ত উৎপাদন ব্যবস্থাই শিল্পভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সভ্যতার আরাে উৎকর্ষ দান করেছে। রাষ্ট্র কাঠামো, মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনে সমৃদ্ধিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
৩) সামাজিক অসমতা ও স্তরবিন্যাসের অন্যতম নিয়ামক: অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান স্তম্ভ হচ্ছে সম্পত্তির মালিকানা। সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা সামাজিক অসমতা ও স্তরবিন্যাস সৃষ্টি করেছে। সমাজে উঁচু-নিচু ভেদাভেদ, অসমতা ও স্তরবিন্যাসের মূলে মালিকানা এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তির ভূমিকা বিশেষভাবে কাজ করে। সম্পত্তিতে যখন ব্যক্তিগত মালিকানা এবং শ্রমবিভাজন ছিল না তখন সমাজও ছিল সমতাভিত্তিক। সুতরাং সামাজিক অসমতা ও স্তরবিন্যাসের মূলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভূমিকা অন্যতম।
৪) সামাজিক শ্রেণি কাঠামো নির্ধারণ করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা: সমাজের শ্রেণি কাঠামো নির্ধারণ করে সম্পদের মালিকানা, উৎপাদন ব্যবস্থায় ভূমিকা ও শ্রমবিভাজন সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির বিকাশ ঘটায়। সরল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সামাজিক শ্রেণি ও পেশাজীবীর সংখ্যা খুব সীমিত। কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিকাশের মাধ্যমে সমাজে নানা পেশাজীবী শ্রেণির আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। ভূমিমালিক-ভূমিহীন, মালিক-শ্রমিক, বিত্তশালী-বিত্তহীন, ধনী-দরিদ্র, উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত-বিত্তহীন ইত্যাদি শ্রেণির মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
৫) ক্ষমতা কাঠামোর প্রধান শক্তি: ক্ষমতা কাঠামোর প্রধান শক্তি বা উপাদান হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সম্পত্তির মালিকানা, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্ক ইত্যাদি ক্ষমতা কাঠামো নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। গ্রামীণ সমাজে ভূমির মালিকানা, সার-কীটনাশকের ডিলারশিপ, সেচ ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রমশক্তি সরবরাহের সক্ষমতা ইত্যাদি ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির পূর্বশর্ত। আধুনিক নগর জীবনেও শিল্প-মালিকানা, নগদ অর্থের প্রাচুর্য, শ্রমিক সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি ক্ষমতা কাঠামোয় প্রভাব বিস্তার করে।
৬) নিরাপদ জীবনের অবলম্বন: নিরাপদ জীবনের জন্য চাই অর্থ এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা নিশ্চিত করা না গেলে নিরাপদ জীবন অর্থহীন। উল্লিখিত প্রতিটি বিষয়ই মানুষের নিরাপদ জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট। এসবের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংশ্লিষ্টতা। বস্তুত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ব্যতীত মানুষের জীবন অকল্পনীয়। আদিম হতে আজ পর্যন্ত কোনো না কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই মানুষ নিরাপদ জীবন-যাপনের স্বাদ গ্রহণ করছে।
৭) সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাবশালী উপাদান: কার্ল মার্কসের মতে, সমাজের মৌল কাঠামো (অর্থনীতি) উপরি কাঠামোকে (রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি ইত্যাদি) প্রভাবিত করে। বস্তুত সামাজিক পরিবর্তনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দাস ও সামন্ত সমাজের পৃষ্ঠপােষক। শিল্পভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নগর সমাজের গোড়াপত্তন করে। সেবাখাতের বিকাশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মুদ্রা বিনিময় ও প্রযুক্তির ব্যবহার অধিকতর শক্তিশালী হয়। ফলে সামাজিক সম্পর্ক, পেশা, শ্রেণি ও ক্ষমতা কাঠামোতে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়। সুতরাং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সামাজিক পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
৮) আধুনিকায়ন ও নগরায়নকে ত্বরান্বিত করে: অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই আধুনিকায়ন ও নগরায়নের সূচনা হয়েছিল। শিল্প ও সেবা নির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উৎকর্ষ আধুনিকায়ন ও নগরায়নকে সমৃদ্ধ করেছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হলে মানুষের চাহিদা, রুচি, মূল্যবোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নানা মাত্রা ও জটিলতা পরিলক্ষিত হয়। এগুলো আধুনিক ও নগরায়িত সমাজের বৈশিষ্ট্য বলে পরিগণিত। সুতরাং পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই আধুনিকায়ন ও নগরায়নকে অনিবার্য করে তোলে।
৯) শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রার সহায়ক: অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রার পূর্বশর্ত। মানুষ যখন শিকার ও খাদ্য সংগ্রহভিত্তিক জীবন-যাপন করত তখন মূলত কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই ছিল না। ফলে সেখানে শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চার চিন্তাও মানুষের মধ্যে বিকশিত হয়নি। কিন্তু কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিকাশের ফলে মানুষ ক্রমশ শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চায় মনোনিবেশ করে। শিল্প ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রাকে অনেক বেশি গতিশীল করেছে। বস্তুত শিক্ষা ও বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশের নিবিড় সম্পর্ক অনস্বীকার্য।
১০) শশাষণ-বঞ্চনা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জন্ম দেয়: অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজে অসমতার জন্ম দেয়। ফলে শ্রেণিভিত্তিক সমাজে শোষণ-বঞ্চনা এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত পরিলক্ষিত হয়। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনিবার্য নিয়মে সমাজে মালিক শ্রেণি ও শ্রমজীবী শ্রেণির উদ্ভব হয়। মালিক শ্রেণির মুনাফা লাভের প্রবণতা থেকে শ্রমজীবীদের উপর শোষণ ও বঞ্চনা হয়। শোষণ থেকে সচেতনতা, সচেতনতা থেকে সংগ্রাম এমনকি দ্বন্দ্ব-সংঘাত। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণিরও জন্ম দেয়।
সমাজে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির মূলেও রয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সুতরাং শ্রেণিভিত্তিক সমাজ, শ্রেণিশোষণ এবং বিভিন্ন শ্রেণির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত মূলত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনিবার্য ফল।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions