টেলিভিশন আবিষ্কার করেন কে
বিনা তারে শব্দ প্রেরণ আবিষ্কৃত হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা চিন্তা করতে শুরু করেন, কি ব্যবস্থা অবলম্বন করলে যন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের গলার শোনা যাবে সেই সঙ্গে দেখা যাবে তার অবয়বখানা।
প্রথম দূরবর্তী স্থানে কেবলমাত্র ছবি পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন বিশিষ্ট জার্মান বিজ্ঞানী ফর্ণ। তিনি ১৯২২ সালে বিনা তারে ইতালি থেকে যুক্তরাজ্যে কতগুলো ছবিকেই শুধু প্রেরণ করেছিলেন। বক্তার কন্ঠস্বর সহ তার প্রতিমূর্তিকে পাঠাতে সক্ষম হননি।
এই ঘটনার দু’বছর পরে ১৯২৪ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী রেঞ্জার আরও একটু এগিয়ে যান। তিনি বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে আটলান্টিক মহাসাগরে এপারে থেকে ওপারে কতকগুলো ছবিকে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত করতে সমর্থ হন। ওদের এই প্রচেষ্টাগুলিকে ঠিক ঠিক টেলিভিশন বলা যায় না, তবে টেলিভিশনের সূচনা বলা যেতে পারে। কথিত আছে, সেকালে ইংল্যান্ডের বেতার কেন্দ্রগুলো রেঞ্জারের পদ্ধতিতে ছবি আদান প্রদান করতো।
টেলিভিশন বলতে আমরা যা বুঝি, তার “প্রথম প্রবর্তন হয়েছিল ইংল্যান্ডে ১৯২৭ সালে। আবিষ্কার কর্তার নাম জন লোগি বেয়ার্ড। ভদ্রলোক ছিলেন স্কটল্যান্ডের অধিবাসী।”
বেয়ার্ড অবশ্য প্রথমে খুব দূরে কোন মানুষ বা কোন দৃশ্যাবলীকে প্রেরণ করতে সমর্থ হননি। প্রথম যে পরীক্ষাটি দেখিয়েছিলেন তখন দূরত্বটা ছিল কয়েক গজ মাত্র। তাঁর পরীক্ষার জায়গা থেকে কিছু দূরে একটি ঘরের মধ্যে দর্শকদের বসিয়েছিলেন। দর্শকদের সামনে ছিল একটা যন্ত্র ও একটা পর্দা। তারপর পরীক্ষাগারে চলে যান। এক সময় দর্শকরা দেখতে পায় সিনেমার পর্দার মত সচল মানুষের মূর্তি। সেদিন সত্য সত্যই বিস্মিত হয়েছিলেন দর্শকরা এবং টেলিভিশন আবিষ্কারের গৌরবও লাভ করেছিলেন বেয়ার্ড।
অতঃপর ঐ বেয়ার্ডই গবেষণার মাধ্যমে টেলিভিশনের আরও উন্নতি করেন। ফলে দূরত্বকে আরও কিছুটা বাড়াতে সক্ষম হন। অতঃপর “মার্কিন বিজ্ঞানী জোরকিন বেয়ার্ডের পদ্ধতি কিছূটা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেন। আর ঐ জোরকিনের পদ্ধতি অবলম্বন করেনই আমেরিকার রেডিও কর্পোরেশন প্রথম টেলিভিশন প্রদর্শনের সূচনা করে। আজকের টেলিভিশন ঐ পদ্ধতিরই উন্নত রূপ।”
বেয়ার্ড মূল যে যন্ত্রটির সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন, সেটির নাম ফটো ইলেকট্রিক সেল। গোটা ছবিটাকে সরাসরি চালান করার চেষ্টা না করে ছবিকে বা কোন দৃশ্যকে কতকগুলো ভাবে ভাগ করেছিলেন। ছবি বা দৃশ্যের কোন বিন্দুতে আলো ফেলে যদি সে আলোককে ফটো ইলেকট্রিক সেলে পাঠানো যায়, তাহলে সেই বিন্দুর আলো তার ক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ প্রবাহে রুপান্তরিত হবে। এই সত্যকে কাজে লাগিয়ে বেয়ার্ড সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অসংখ্য ছিদ্রবিশিষ্ট একটা গোলাকার ধাতব চাকতিকে ব্যবহার করেছিলেন। সেই চাকতিটিকে আবার ছবির উপর রেখে অতি দ্রুত ঘোরানোর ব্যবস্থা করেছিলেন এবং আর্কল্যাম্প থেকে আগত আলোকরশ্মিকে লেন্সের সাহায্যে চাকতির উপর ফেলেছিলেন। সেই আলো চাকতির ছিদ্রপথে গিয়ে ছবির উপর পড়েছিল।
যেহেতু চাকতিটিকে অতি দ্রুত ঘোরানোর ব্যবস্থা ছিল এবং ঘোরাবার এমন ব্যবস্থা ছিল যে আলো ছবির উপর প্রতিটি ছিদ্রের ভেতর দিয়ে ক্রমিক পর্যায়ে পর পর গোটা ছবিটাকে আলোকিত করেছিল। ছবির বিভিন্ন বিন্দু থেকে যে আলো নির্গত হয়েছিল, তার পরিমাণ ছিল বিভিন্ন। কম শক্তির আলো ফটো ইলেকট্রিক সেলে কম শক্তির বিদ্যুৎপ্রবাহ সৃষ্টি করেছিল এবং বেশী শক্তির আলো সৃষ্টি করেছিল বেশি শক্তির বিদ্যুৎ প্রবাহ। ভিন্ন ভিন্ন শক্তিসম্পন্ন সেইসব বিদ্যুৎস্পন্দনের উপর চাপিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল মিশ্র বিদ্যুৎ তরঙ্গ। আর এখানেও ব্যবহার করা হয়েছিল প্রেরক যন্ত্র, আকাশ তার এবং মাইক্রোফোন। দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গে গান-বাজনা কিংবা কথাকে প্রেরণ করার জন্য বেয়ার্ড দ্বিতীয় একটি প্রেরক যন্ত্র, একটি আকাশতার এবং একটি মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন-ঠিক সেই প্রেরকযন্ত্রের মতই।
একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল গ্রাহক যন্ত্রের ক্ষেত্রেও। এক্ষেত্রে যে আকাশতারের ব্যবস্থা ছিল তাতে ধরার ব্যবস্থা হয়েছিল প্রেরকযন্ত্র কর্তৃক প্রেরিত মিশ্র বিদ্যুৎ তরঙ্গ। এখানকার প্রধান কাজ ছিল মিশ্র বিদ্যুৎ তরঙ্গ থেকে কম ও বেশি শক্তিসম্পন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহকে পৃথক করে নেওয়া এই উদ্দেশ্যে বিদ্যুৎপ্রবাহকে বিশেষ একধরণের বায়ুশূণ্য টিউবের ভেতর দিয়ে চালনা করা হয়েছিল।
প্রেরক যন্ত্রের মত গ্রাহকযন্ত্রে একটি সূক্ষ্ম ছিদ্রবিশিষ্ট ধাতব চাকতিকে ঘোরাবার ব্যবস্থা ছিল। টিউব থেকে আলোক রশ্মি এখানেও চাকতির ছিদ্র পথে চালিত হয়ে পূর্বের মত পরপর ক্রমিক পর্যায়ে পর্দার উপর পড়েছিল। গান ও কথাকে শোনার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল বেতার গ্রাহকযন্ত্র, আকাশতার ও মাইক্রোফোন।
জোরিকিনের পদ্ধতিতে প্রেরক যন্ত্রে ফটো ইলেকট্রিক সেলের পরিবর্তে ইকনোস্কোপ নামে যন্ত্র এবং গ্রাহক যন্ত্রে বায়শুন্যে টিউবের পরিবর্তে কিনোস্কোপ নামে আর একটি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। বর্তমানে উক্ত পদ্ধতিকেই অনুসরণ করা হয়, তবে উন্নত হয়ে অনেকখানি।
টেলিভিশনের উন্নতি সম্ভব হয়েছে অর্থিকন, ইমেজ অর্থিকন, টিভিকন প্রভৃতি যন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। উক্ত যন্ত্রগুলি ব্যবহারের ফলে ছবি বা দৃশ্যের সুস্পষ্ট রূপতো পাওয়া যায়ই, অধিকন্তু স্বাভাবিক রঙও দেখা যায়। তবে টেলিভিশন পর্দার উপর অনেক বড় আকারের ছবি পাওয়া এখনও সম্ভব হয়নি।
টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে গ্রাহক যন্ত্রের দূরত্ব অধিক হলে ছবি অস্পষ্ট হয়ে উঠে। এর কারণ প্রেরক যন্ত্র থেকে ১০ সেন্টিমিটারের কম তরঙ্গ দৈর্ঘের হ্রস্ব-তরঙ্গের মিশ্র বিদ্যুৎস্পন্দনের সৃষ্টি করা হয়। হ্রস্ব তরঙ্গের অসুবিধা অনেক। সাধারণত আয়নমন্ডলে প্রতিফলিত হয়ে এগুলি খুব বেশী দূরে যেতে পারে না। তবে এই কাজে বর্তমানে কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহারের মাধ্যমে আরো আধুনিক ও ডিজিটাল ব্যবস্থার উন্নয়ন চলমান রয়েছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions