চলিত ভাষা কাকে বলে
বাংলার মানুষের মুখের ভাষার পাঁচটি প্রধান উপভাষা- রাঢ়ি, বঙ্গালি, বরেন্দ্রী, কামরূপী ও ঝাড়খন্ডী। এ গুলির মধ্যে রাঢ়ী কলকাতা ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলের হুগলি, নদীয়া, উত্তর চবিবশপরগণার শিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণীর মানুষের মুখের ভাষা; আর এই ভাষার উপর ভিত্তি করে যে বাংলা ভাষারীতি (Standard Colloquial Bengoli=SCB) গড়ে উঠেছে তাকে বলা হয় চলিত ভাষা বা চলিত গদ্যরীতি।
চলিত ভাষার শব্দভান্ডারে বিশুদ্ধ কিছু সংস্কৃত শব্দ আছে। কিন্তু এর মূল শব্দ হল সংস্কৃত থেকে প্রাকৃতির মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে আসা বিপুল তদ্ভব শব্দ ভান্ডার, আর এ দেশের আর্যপূর্ব জাতিদের ভাষা থেকে স্বাভাবিকভাবে গৃহীত দেশী শব্দসমূহ। এ ভাষা শুধু সাহিত্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ ভাষা বর্তমানে যেমন সাহিত্যের ভাষা তেমনি শিক্ষিত জনের মৌখিক ভাববিনিময়েরও মাধ্যম।
বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের পর শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসের বর্ণনায় সাধু ভাষা ব্যবহার করলেও পাত্র-পাত্রীর সংলাপে চলিত গদ্য ব্যবহার করেছেন। বিভুতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের ধারাই অনুসরণ করেছেন। উল্লেখযোগ্য, উইলিয়াম কেরীর কথোপকথোনের বিভিন্ন শ্রেণীর সংলাপে ব্যবহৃত গদ্য যদিও আদর্শ চলিত বাংলা ছিল না, তবুও এখানেই মৌখিক গদ্য সাহিত্যের প্রথম প্রবেশাধিকার বলে ধরে নেয়া হয়। বিদ্যাসাগরের শকুন্তলার সংলাপ অংশে কিছু চলিত গদ্য ব্যবহার করেন। কলকাতা অঞ্চলের চলিত ভাষাকে কিঞ্চিৎ সাধুভাষার মিশ্রণসহ সাহিত্যে প্রথম রূপ দেন প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮) উপন্যাসে। কিন্তু পুরোপুরি চলিত ভাষার ব্যবহার করেন কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ (১৮৬২) গ্রন্থে। বঙ্কিমচন্দ্র, প্যারীচাঁদ মিত্রের ব্যবহৃত কথ্য ভাষাকে স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং এই ভাষাকে ‘অপর ভাষা’ নামে অভিহিত করেছিলেন। একটি প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকে ‘‘প্রচলিত ভাষা’’ বলেছিলেন। সম্ভবত এই ‘প্রচলিত ভাষা’ থেকেই পরে ‘চলিত ভাষা’ কথাটির প্রচলন হয়। ১৯১৪ সালে প্রমথ চৌধুরী ‘সবুজপত্র’ পত্রিকা প্রকাশ করে চলিত গদ্যের পক্ষে ব্যাপক সাহিত্যিক আন্দোলন শুরু করেন। তখন রবীন্দ্রনাথও তাতে উৎসাহিত হয়ে পুরোপুরি চলিত গদ্য লেখা আরম্ভ করেন এবং এভাবে সাহিত্যে ক্রমে চলিত গদ্য একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions