শিলা
ভূ-ত্বক যেসব উপাদান দ্বারা গঠিত তাদের সাধারণ নাম শিলা। ভূ-তত্ত্ববিদগণের মতে, দুই বা ততোধিক খনিজ দ্রব্যের সংমিশ্রণে এসব শিলার সৃষ্টি হয়। ভূ-ত্বক গঠনকারী সকল কঠিন ও কোমল পদার্থই শিলা।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- নুড়ি, কাঁকর, গ্রানাইট, কাদা, বালি প্রভৃতি শিলা। অন্যভাবে বলা যায় যে, এক বা একাধিক খনিজের একত্রিত রূপই হচ্ছে শিলা। খনিজের এই মিশ্রণ প্রাকৃতিক অবস্থায় পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে প্রতিটি শিলার গঠনকারী খনিজের বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে। কোনো কোনো শিলা একটি মাত্র খনিজ পদার্থ দিয়েও গঠিত হতে পারে। এক্ষেত্রে খনিজ ও শিলা একই পদার্থ। যেমন: কেলসাইট একটি খনিজ এবং শিলা হিসাবে এটি চুনাপাথর।
শিলার প্রকারভেদ
ভূ-ত্বক বিভিন্ন প্রকার শিলা দ্বারা গঠিত এবং প্রত্যেক ধরনের শিলা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। কোনো শিলা কাঁদার মত নরম এবং কোনো শিলা গ্রানাইট পাথরের মত শক্ত। সব ধরনের শিলাই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট। উৎপত্তি ও গঠনের দিক থেকে শিলাকে তিনভাগে ভাগ করা যায়।
যথা:
ক) আগ্নেয় শিলা: উদাহরণ- গ্রানাইট।
খ) পাললিক শিলা: উদাহরণ-চুনাপাথর।
গ) রূপান্তরিত শিলা : উদাহরণ-মার্বেল।
আগ্নেয় শিলা
সৃষ্টির প্রথমে পৃথিবী উত্তপ্ত গ্যাসীয়পিন্ড ছিল। এই গ্যাসপিন্ড ক্রমান্বয়ে তাপ বিকিরণ করে তরল হয়। পরে আরো তাপ বিকিরণ করে উপরিভাগ শীতল ও কঠিন আকার ধারণ করে। এভাবে গলিত অবস্থা থেকে ঘনীভূত বা কঠিন হয়ে যে শিলা গঠিত হয় তাকে আগ্নেয় শিলা বলে। ভূ-অভ্যন্তরে উত্তপ্ত ম্যাগমা শীতল ও কেলাসিত হয়ে আগ্নেয় শিলা গঠিত হয়। অগ্নিময় অবস্থা থেকে এই শিলার সৃষ্টি বলে একে আগ্নেয় শিলা বলা হয়। ইংরেজিতে এ ধরনের শিলাকে Igneous Rock বলে। Igneous শব্দের অর্থ আগুন। আগ্নেয় শিলা পৃথিবীর প্রথম পর্যায়ের শিলা বলে একে প্রাথমিক শিলাও বলা হয়। এ শিলায় কোনো স্তর নেই, তাই এই শিলার অপর নাম অস্তরীভূত শিলা। এই শিলায় কোনো জীবাশ্ম নেই। আগ্নেয়গিরি বা ভূমিকম্পের ফলে অনেক সময় ভূ-ত্বকের দুর্বল অংশে ফাটলের সৃষ্টি হয়। তখন পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে উত্তপ্ত গলিত লাভা নির্গত হয়ে আগ্নেয় শিলার সৃষ্টি করে। এভাবে ব্যাসল্ট ও গ্রানাইট শিলার সৃষ্টি হয়েছে।
আগ্নেয় শিলার বৈশিষ্ট্য
১। স্তরবিহীন : উত্তপ্ত গলিত অবস্থা থেকে ঠান্ডা হয়ে জমাট বেঁধে এই জাতীয় শিলার সৃষ্টি হয় বলে এতে কোনো স্তর থাকে না।
২। জীবাশ্মবিহীন : উত্তপ্ত গলিত পদার্থ থেকে আগ্নেয় শিলার উৎপত্তি বিধায় কোনো প্রাণি বা উদ্ভিদের অসিত্মত্ব আশা করা যায় না। এ কারণে এ জাতীয় শিলার মধ্যে জীবাশ্ম পাওয়া যায় না।
৩। কেলাসিত : উত্তপ্ত গলিত অবস্থা থেকে তাপ বিকিরণ করে এ জাতীয় শিলা তৈরি হয় বলে ক্ষেত্রবিশেষে কেলাসিত হয় বা নির্দিষ্ট আকারে দানা বাঁধে।
৪। অপ্রবেশ্য : আগ্নেয় শিলার দানাগুলির মধ্যে কোনো ছিদ্র না থাকায় এই শিলায় পানি প্রবেশ করতে পারে না। তাই আগ্নেয় শিলা অপ্রবেশ্য।
৫। সুদৃঢ় ও সুসংহত : উত্তপ্ত গলিত অবস্থা থেকে তাপ বিকিরণ করে উৎপন্ন হয় বলে এ শিলা সুদৃঢ় ও সুসংহত।
৬। প্রাচীনতম : আগ্নেয় শিলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম শিলা। এই শিলা থেকে অন্যান্য শিলার উৎপত্তি হয়েছে।
৭। অপেক্ষাকৃত ভারী : আগ্নেয় শিলা অন্যান্য শিলার চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী।
আগ্নেয় শিলার বুনট
আগ্নেয় শিলার প্রধান উপাদান ম্যাগমা। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় উত্তপ্ত গলিত পদার্থ ভূ-অভ্যন্তরের গভীর তলদেশ থেকে (প্রায় ২০০ কি.মি.) ভূ-ত্বকের অভ্যন্তরেই জমাটবদ্ধ হয় যা ম্যাগমা নামে পরিচিত। এই ম্যাগমা যখন ভূ-ত্বকের গভীর থেকে ফাঁটল বরাবর সজোরে ভূ-পৃষ্ঠে উঠে এসে প্রবাহিত হয় তখন তাকে লাভা বলে। শিলার বুনট এই ম্যাগমা বা লাভার বৈশিষ্ট্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শিলার বুনট বলতে এর গঠনকারী খনিজ উপাদানের আকার, আকৃতি, বিন্যাস বুঝায়। শিলার বুনট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিলার উৎপত্তির সময় কী ধরনের পরিবেশ এবং প্রক্রিয়া কাজ করেছে তা বুনটের বৈশিষ্ট্যে প্রতিফলিত হয়। যেমন- ম্যাগমা খুব দ্রুত শীতল ও কেলাসিত হলে মিহি বুনটের শিলা গঠন করে। যেমনরায়োলাইট। ম্যাগমা ধীরে ধীরে শীতল হলে মোটা বুনটের শিলা গঠন করে। যেমন- গ্রানাইট।
আগ্নেয় শিলায় প্রধানত ৫ ধরনের বুনট দেখা যায়।
যথা:
ক) কাঁচের মত দানাহীন, যেমন- গ্যাস।
খ) এফানিটিক, অতি সূক্ষ্ম দানা এবং খালি চোখে দেখা যায় না। যেমন- ব্যাসল্ট, অ্যান্ডেসাইট।
গ) ফেনারেটিক, ক্ষুদ্র দানা, কিন্তু খালি চোখে দেখা যায়। যেমন- গ্রানাইট।
ঘ) পরফাইটিক, দুই ধরনের দানা বিশিষ্ট (বড় ও ছোট)। যেমন- পরফাইটিক রায়োলাইট।
ঙ) পাইরোক্লাষ্টিক, বৃহৎ আকৃতির দানা বিশিষ্ট আগ্নেয় শিলা। যেমন- টাফ ও ছাই-ধুম্র।
আগ্নেয় শিলার শ্রেণিবিভাগ : আগ্নেয় শিলাকে দুইভাবে ভাগ করা যায়।
যথা:
ক. উৎপত্তি ও গঠন অনুসারে এবং
খ. গঠনকারী খনিজ উপাদান অনুসারে ।
ক. উৎপত্তি ও গঠন অনুসারে : উৎপত্তি ও গঠন অনুসারে আগ্নেয় শিলাকে পুনরায় দুইভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা-
১. বহিঃজ বা নিঃসারী আগ্নেয় শিলা এবং
২. অন্তঃজ বা উদবেধী আগ্নেয় শিলা।
১. বহিঃজ বা নিঃসারী আগ্নেয় শিলা : পৃথিবীর অভ্যন্তরে গলিত পদার্থ জ্বালামুখ বা ফাঁটল দিয়ে বাইরে নির্গত হয়ে ক্রমে ঠান্ডা হয়ে যে শিলা গঠিত হয় তাই বহিঃজ আগ্নেয় শিলা। যেমন- ব্যাসল্ট, পিউমিস। ভূ-অভ্যন্তরের গলিত পদার্থগুলোর উৎক্ষিপ্ত হওয়ার উপর ভিত্তি করে এ শিলাকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
যথা-
১.১। বিস্ফোরক প্রকৃতির : অগ্ন্যুৎপাতের সময় কিছু পদার্থ প্রচন্ড বেগে বাইরে উৎক্ষিপ্ত হয়ে পতিত হয় এবং পরে জমাট বেঁধে শিলায় পরিণত হয়, একে বিস্ফোরক আগ্নেয় শিলা বলে।
১.২। শান্তপ্রকৃতির আগ্নেয় শিলা: অগ্ন্যুৎপাতের সময় অপেক্ষাকৃত ভারী গলিত পদার্থ ধীরে ধীরে ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হয়ে শিলায় পরিণত হয়, একে শান্ত আগ্নেয়শিলা বলে।
২. অন্তঃজ বা উদ্বেধী আগ্নেয় শিলা : কোনো কোনো সময় তরল ম্যাগমা ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছাতে না পেরে পৃথিবীর অভ্যন্তরেই জমাট বেঁধে যে শিলা গঠন করে তাকে অন্তঃজ শিলা বলে। অবস্থানের উপর ভিত্তি করে এ শিলাকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়।
যথা-
২.১। পাতালিক: ভূ-পৃষ্ঠের বহু নিচে অবস্থিত এই শিলা কেলাসিত। যেমন- গ্যাব্রো।
২.২। উপ-পাতালিক: ভূ-গর্ভস্থ ম্যাগমা উপরে আসার সময় ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি এসে জমাট বেঁধে এই শিলা গঠন করে। যেমন- ডলোরাইট।
খ. গঠনকারী খনিজ উপাদান অনুসারে আগ্নেয় শিলা : এ শিলাকে আবার চারভাগে ভাগ করা যায়।
যথা-
১. ফেলাপসিক: অধিক পরিমাণে ফেলস্পার, সিলিকা মিশ্রিত থাকে। এরা হালকা বর্ণের হয়ে থাকে। যেমন- গ্রানাইট, রায়োলাইট।
২. মেফিক : এতে ম্যাগনেসিয়াম ও লোহার পরিমাণ বেশি থাকে। এরা ব্যাসল্ট জাতীয়। এসব ধূসর কালো বর্ণের হয়। যেমন- ব্যাসল্ট, গ্যাব্রো।
৩. উচ্চ মাত্রার মেফিক : অধিক মাত্রায় লোহা ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে। প্রধান খনিজ হলো অলিভিন, পাইরাক্সিন। গাঢ় সবুজ থেকে কালো বর্ণের। যেমন- পেরিডোটাইট, কমাডোটাইট।
৪. ফেলসিক ও মেফিকের মাঝামাঝি : এই জাতীয় শিলা এ্যান্ডেসাইট ধরনের। প্রধান খনিজ হলো- হর্নবোন্ড, সোডিয়াম ফেলসপার। বর্ণ গাঢ়। যেমন- ডাইয়োরাইট, অ্যান্ডেসাইট।
পাললিক শিলা
পলি সঞ্চিত হয়ে যে শিলা গঠন করে তাকে পাললিক শিলা বলে। এ শিলার পলি সাধারণত স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়। ভূ-পৃষ্ঠের প্রাথমিক শিলাগুলো যুগ যুগ ধরে রৌদ্র, বৃষ্টি, বায়ুপ্রবাহ সাগর তরঙ্গ প্রভৃতি নানা প্রকার ঘাতপ্রতিঘাত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং খন্ড-বিখন্ড ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বালি, কাঁকর, কাঁদা প্রভৃতিতে পরিণত হয়। ক্ষয়িত শিলাকণা জলস্রোত, বায়ু এবং হিমবাহ দ্বারা পরিবাহিত হয়ে পলল বা তলানিরূপে কোনো নিম্নভূমি, হ্রদ এবং সাগরগর্ভে সঞ্চিত হতে থাকে। পরবর্তীতে ঐসব পদার্থ ভূ-গর্ভের উত্তাপে ও উপরের শিলাস্তরের চাপে জমাট বেঁধে কঠিন শিলায় পরিণত হয়। পাললিক শিলা ভূ-ত্বকের মোট আয়তনের শতকরা ৫ ভাগ। তবে মহাদেশীয় ভূ-ত্বকের উন্মুক্ত অংশের প্রায় ৭৫ ভাগই পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত। পলল বা তলানি থেকে গঠিত হয় বলে এরূপ শিলাকে পাললিক শিলা বলে। স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয় বলে একে স্তরীভূত শিলাও বলে। চুনাপাথর, বেলেপাথর, পাথুরিয়া কয়লা, সৈন্ধব লবণ, খড়িমাটি প্রভৃতি পাললিক শিলার উদাহরণ। ভূ-পৃষ্ঠের ক্রিয়ারত বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াই পাললিক শিলার উৎপত্তির জন্য কাজ করে। তবে, বিচুর্ণীভবন, পরিবহন, সঞ্চায়ন, সুদৃঢ়করণ ও জোড়ন ইত্যাদি প্রক্রিয়া সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। পাললিক শিলা আমাদের শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতির উন্নয়নে একটি নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। আদি মানব জাতি অসিত্মতে বর জন্য পাললিক শিলা ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার তৈরি করে। বর্তমান সভ্যতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ পাললিক শিলা থেকে পাওয়া যায়। যেমন- কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি। দালান-ইমারত, রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ ইত্যাদি নির্মাণে ব্যবহৃত ইট, সিমেন্ট, বালু সবাই আসে শিলা থেকে। গ্যাস তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কোয়ার্টজও এ শিলার অবদান।
পাললিক শিলার বৈশিষ্ট্য
ক) স্তরীভূত : পাললিক শিলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এরা স্তরীভূত অর্থাৎ খনিজ উপাদানসমূহ স্থুল বা সূক্ষ্ম স্তরে স্তরে বিন্যস্ত থাকে। এই স্তরগুলো সাধারণত আনুভূমিকভাবে সজ্জিত থাকে।
খ) জীবাশ্ম বিশিষ্ট : পাললিক শিলাস্তরে জীবাশ্মের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যে সকল জীব এই শিলাঞ্চলে বাস করে তাদের মৃতদেহ কালক্রমে পলির নিচে চাপা পড়ে। এর ফলে এদের দেহের কঠিন অংশ প্রস্তরীভূত হয়ে জীবাশ্মে পরিণত হয়।
গ) অকেলাসিত : এটি কখনও উত্তপ্ত অবস্থা হতে শীতল হয়ে সৃষ্টি হয় না, বিধায় এই শিলা অকেলাসিত (NonCrystalline) শিলা।
ঘ) তরঙ্গচিহ্ন : এটি তরঙ্গ চিহ্নযুক্ত শিলা। জলভাগের তলদেশে এই জাতীয় শিলার সৃষ্টি হয় বলে এর মধ্যে তরঙ্গচিহ্ন (Ripple Marks) বর্তমান থাকে। আবার বায়ু দ্বারা গঠিত পাললিক শিলায়ও বাতাসের দ্বারা তরঙ্গ চিহ্নের সৃষ্টি হয়।
ঙ) কোমলতা : আগ্নেয় শিলার ভগ্নাংশ সঞ্চিত হয়ে পাললিক শিলার সৃষ্টি হয় বলে এই শিলা অন্য শিলা থেকে অপেক্ষাকৃত কোমল থাকে।
পাললিক শিলার প্রকৃতি : পাললিক শিলার বিশেষ উপাদান পলি। এটি বিভিন্ন পর্যায়ের সংমিশ্রণে হতে পারে। যেমন-
১. অন্য শিলা বা খনিজের টুকরা। যেমন- নদীবাহিত নুড়ি।
২. রাসায়নিক অব:ক্ষেপন, যেমন- লবণ, চুন ইত্যাদি।
৩. জৈব পদার্থ, যেমন- প্রবাল, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি।
৪. পাললিক শিলার পুরানো পলির বয়স নিম্নস্তরে বেশি এবং উপরের দিকের স্তরে কমতে থাকে।
পাললিক শিলার শ্রেণিবিভাগ : গঠনকারী উপাদানের আকৃতি, আকার এবং গঠনগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পাললিক শিলাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। নিম্নে এগুলো বর্ণনা করা হলো।
১) যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গঠিত পাললিক শিলা : এই শিলা দুই ধরনের হতে পারে। যেমন- আগ্নেয় লাভাজাত এবং পূর্ববর্তী পাললিক বা রূপান্তরিত শিলার ক্ষয়িত চূর্ণ। এ জাতীয় পলিসমূহের আকার ও শিলা গঠনকারী খনিজে অনেক তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ- বেলেপাথর।
২) রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় গঠিত পাললিক শিলা : রাসায়নিক বিচূর্ণীভবন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট পলি অবেক্ষপ থেকে এ শিলার উদ্ভব হয়। এ প্রক্রিয়ায় পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকা পদার্থসমূহ বিভিন্ন অজৈব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরাসরি তলায় পতিত হয় এবং অবশেষে জমাটবদ্ধ হয়। যেমন- কোথাও আটকে পড়া পানি বাষ্পীভূত হলে এর সাথে দ্রবীভূত লবণ থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে বাষ্পায়ন একটি অজৈব প্রক্রিয়া এবং থিতানো লবণকে পলি হিসাবে ধরা হয়। উদাহরণ- চুনাপাথর।
৩) জৈবিক উপায়ে গঠিত পাললিক শিলা : উদ্ভিদ বা প্রাণির দেহাবশেষজাত পলি থেকে এ শিলার উৎপত্তি হয়। চুনাপাথর এ জাতীয় শিলা। জলজ পরিবেশে অতীতে যে গাছ ছিল তা ভূ-প্রাকৃতিক কারণে ভূ-অভ্যন্তরে চাপা পড়ে যায় এবং ওপরের পলির প্রচন্ড চাপে এর পরিবর্তন হয় এবং কালক্রমে কয়লায় পরিণত হয়। বাংলাদেশের জামালগঞ্জের কয়লা এবং গোপালগঞ্জের পিট কয়লা এ জাতীয় শিলার উদাহরণ।
রূপান্তরিত শিলা
অনেক সময় প্রচন্ড তাপ ও চাপের জন্য রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আগ্নেয় ও পাললিক শিলা নতুন এক ধরনের শিলায় রূপান্তরিত হয় এবং আগের তুলনায় কঠিন ও কেলাসিত হয়, এই শিলাকে রূপান্তরিত শিলা বলে। পূর্বের রূপ ও অবস্থার পরিবর্তন হয় বলে একে রূপান্তরিত শিলা বলে। রূপান্তরিত শিলা মূলত আগ্নেয় ও পাললিক শিলার পরিবর্তিত রূপ। যেমন- চুনাপাথর পরিবর্তিত হয়ে মার্বেল, বেলেপাথর পরিবর্তিত হয়ে কোয়ার্টজাইট, কাঁদা পরিবর্তিত হয়ে শ্লেট, গ্রানাইট পরিবর্তিত হয়ে নীসে, কয়লা পরিবর্তিত হয়ে গ্রাফাইটে পরিণত হয় । রূপান্তরিত শিলা বিশেষভাবে গুরুত বপূর্ণ। কারণ এটি আগ্নেয় শিলার সাথে একত্রে ভূ-ভাগের শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ গঠন করেছে। ভূ-ত্বাত্তিক সময় ব্যাপী মহাদেশের যে সঞ্চারণ এবং ঊত্থান-পতন হয়েছে এ শিলা থেকে তা জানা যায়। এ শিলা সূদুর অতীতকালের প্লেট সঞ্চারণের সাক্ষ্য বহন করে। রূপান্তরিত শিলা মার্বেল পাথর, শ্লেট, গার্নেট ইত্যাদির মত মূল্যবান খনিজ সম্পদ ধারণ করে।
রূপান্তরিত শিলার রূপান্তর প্রক্রিয়া : শিলার রূপান্তরে তাপ, চাপ ও রাসায়নিক ক্রিয়া প্রধান ভূমিকা রাখে। নিম্নে এগুলো বর্ণনা করা হলে।
তাপ : শিলার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে খনিজ এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত হতে শুরু করে। এ অবস্থায় শিলার ভিতর তরলের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং রাসায়নিক ক্রিয়াও ত বরান্বিত হয়। এ অবস্থায় স্ফটিকের আদি গঠন কাঠামো ভেঙ্গে যায় এবং নতুন করে ভিন্নভাবে তা সংগঠিত হতে থাকে। এভাবেই নতুন শিলার সৃষ্টি হয়।
চাপ : ভূ-পৃষ্ঠস্থ শিলার ভারে এর তলদেশের শিলার চাপ বৃদ্ধি পায়। ফলে শিলার খনিজসমূহ সংকুচিত হয়। এ অবস্থায় খনিজ আবার কেলাসিত হয়ে আরো ঘন সন্নিবেসিত পরমাণু কাঠামো বিশিষ্ট নতুন শিলার সৃষ্টি করে।
রাসায়নিক ক্রিয়া : রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় নিম্ন তাপমাত্রাসম্পন্ন খনিজসমূহ গলতে থাকে। এ অবস্থায় পরমাণু সহজেই এ সমস্ত তরলের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হতে পারে। যদিও শিলার বেশির ভাগ অংশই কঠিন অবস্থায় থাকে। অধিকতর তাপ ও চাপের কারণে খনিজের বহু পরমাণু কেলাস কাঠামো থেকে মুক্ত হয়ে খনিজ কণায় তরলের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে পরমাণুর এ প্রক্রিয়া ক্রমাগত চলতে থাকে। এ অবস্থায় পুরানো কেলাস কাঠামো ভেঙ্গে নতুন কেলাস গঠন হয়। এভাবে রূপান্তরিত শিলা গঠিত হয়।
রূপান্তরিত শিলার বৈশিষ্ট্য
ক) কেলাসিত : তাপ ও চাপে আগ্নেয় ও পাললিক শিলার পরিবর্তন হয়ে রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হয় বলে এটি
সাধারণত কেলসিত।
খ) কাঠিন্য : তাপ ও চাপে আগ্নেয় এবং পাললিক শিলা পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হয় বলে এই শিলার কাঠিন্য অন্যান্য শিলার চেয়ে বেশি। ফলে এটি অধিকতর শক্ত ও মজবুত।
গ) জীবাশ্মহীন: পাললিক শিলার জীবাশ্ম রূপান্তরের ফলে বিলুপ্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে, আগ্নেয় শিলায় থেকে রূপান্তরিত হলেও জীবাশ্ম থাকে।
ঘ) সমান্তরাল: রূপান্তরিত শিলার উপাদানগুলো সাধারণত সমান্তরালভাবে অবস্থান করে বলে এটি সমান্তরাল শিলা। এই সমান্তরাল, আনুভূমিক, তির্যক বা বক্র যে কোনোভাবেই হতে পারে।
ঙ) তরঙ্গচিত্র: তাপ ও চাপে এ শিলা তৈরি হয় বলে তরঙ্গচিত্র থাকে না।
রূপান্তরিত শিলার প্রকারভেদ : রূপান্তরিত শিলাকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথাক. উৎসের উপর ভিত্তি করে : এ শিলা আবার দুই প্রকার।
যথা-
১. আগ্নেয় রূপান্তরিত শিলা : আগ্নেয় শিলা থেকে রূপান্তরিত হয়ে এই শিলায় পরিণত হলে একে আগ্নেয় রূপান্তরিত শিলা
বলে। যেমন- গ্রানাইট থেকে নিস বা নাইস।
২. পাললিক রূপান্তরিত শিলা : পাললিক শিলা থেকে রূপান্তরিত হয়ে এই শিলায় পরিণত হয় বলে একে পাললিক রূপান্তরিত শিলা বলে। যেমন- বেলেপাথর থেকে কোয়ার্টজাইট।
খ. খনিজের বুনট ও গঠন উপাদানের উপর ভিত্তি করে : এ শিলা দুই প্রকার।
যথা-
১. পত্রায়িত শিলা : আগ্নেয় ও পাললিক শিলা তাপ ও চাপে পরিবর্তিত হয়ে সমান্তরাল পাতার মত চ্যাপ্টা আকৃতি বিশিষ্ট হলে তাকে পত্রায়িত শিলা বলে। এ ধরনের শিলা খনিজ পাতার মত চ্যাপ্টা বুনট বিশিষ্ট। যেমন- সিস্ট, শ্লেট ইত্যাদি।
২. অপত্রায়িত শিলা : আগ্নেয় ও পাললিক শিলা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়ে পাতার মত চ্যাপ্টা আকৃতি ধারণ না করলে তাকে অপত্রায়িত শিলা বলে। এ ধরনের শিলার খনিজের বিন্যাসে কোনো দল থাকে না। যেমন- মার্বেল, কোয়ার্টজাইট ইত্যাদি।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions