বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা (Banking System in Bangladesh)
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। বিগত বছরগুলোতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশেব চমক সৃষ্টি করেছে। প্রতি বছর প্রায় ৭%-এর কাছাকাছি হারে প্রবৃদ্ধি ঘটছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে পালস্না দিয়ে বাড়ছে ব্যাংকের সংখ্যা। এখন পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থায় বড় ধরনের কোন বিপর্যয় ঘটেনি। বাংলাদেশে উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার জন্য আধুনিক ব্যাংকের কার্যকর ভূমিকা একান্ত প্রয়োজন।
নিচে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের ভূমিকা/গুরুতব বর্ণনা করা হলোঃ
১. সঞ্চয়ের সৃষ্টিতে উৎসাহ প্রদানঃ বাংলাদেশের জনগণের আয় ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু বাড়তি আয় সঞ্চয় করার একমাত্র ব্যবস্থা ব্যাংকিং ব্যবস্থা হলেও অনেক গ্রাম এলাকায় ব্যাংকের শাখা ছিল না। বিগত কয়েক বছরে গ্রাম এলাকায় অনেক ব্যাংক-শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত ব্যাংকগুলো জনগণকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে জনগণ কিছু কিছু সঞ্চয় করে নিজেদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এতে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
২. মূলধন গঠনঃ ব্যাংক জনগণের বিক্ষিপ্ত সঞ্চয়গুলোকে বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে সংগ্রহ করে মূলধন গঠনে সাহায্য করে। দিন দিন ব্যাংকের এ ধরনের মূলধনের পরিমাণ বাড়ছে। উলেস্নখ্য যে, মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা করে দেওয়ায় বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মূলধন গঠনে আমূল পরিবর্তন এসেছে।
৩. ঋণদানঃ দেশের শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নতির জন্যে ব্যাংক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় ঋণ দিয়ে থাকে। এতে বাংলাদেশে নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
৪. ঋণ নিয়ন্ত্রণঃ দেশের মুদ্রা বাজারকে সচল রাখার জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৫. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যঃ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনা ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইতোমধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক শাখার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
৬. অর্থের আদান-প্রদানঃ ব্যাংক বাংলাদেশের একস্থান হতে অন্যস্থানে অর্থ আদান-প্রদানেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং এর প্রচলনের কারণে গ্রামীন অর্থনীতিতে তারল্য বেড়েছে এবং লেনদেনের পরিমাণও বেড়েছে।
৭. শিল্প উন্নয়নঃ ব্যাংক শিল্পের প্রয়োজনীয় পুঁজি সরবরাহ করে এবং প্রযুক্তিগত পরামর্শ প্রদান করে। ফলে বাংলাদেশের শিল্প উন্নয়ন দ্রম্নততর হয়। শিল্পের উন্নয়নে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংক বিশাল ভূমিকা রাখছে।
৮. কৃষির উন্নয়নঃ বাংলাদেশ কৃষি-প্রধান দেশ। এদেশের কৃষি উন্নয়নে ব্যাংক অনন্য ভূমিকা পালন করে। কৃষকদের প্রয়োজনে ব্যাংক কীটনাশক ঔষধ, সার, বীজ, হালের বলদ, নলকূপ ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে। কৃষিব্যাংক কৃষকদের এ ধরনের ঋণ দেয়। এ ছাড়া অন্যান্য সরকারী ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকেও বাধ্যতামূলকভাবে কৃষি খাতে ঋণ প্রদান করতে হয়।
৯. কৃষি-নির্ভর শিল্পের সম্প্রসারণঃ ব্যাংক কৃষিনির্ভর শিল্প স্থাপন ও উন্নয়নের জন্য মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে। ব্যাংকগুলো এ ধরনের সেবা প্রদান করে কৃষিশিল্পের প্রভূত উন্নয়ন করছে।
১০. কুটির শিল্পে সাহায্যঃ ব্যাংক দেশের তাঁতী, কামার, কুমার, হসত্মশিল্প প্রভৃতি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য প্রদান করে। বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এ ধরনের ঋণের প্রচলন থাকায় কুটির শিল্প খাতের উন্নয়ন হচ্ছে।
১১. বিনিময় মাধ্যম সৃষ্টিঃ লেনদেন ও টাকার স্থানান্তরের সুবিধার্থে ব্যাংক চেক, ভ্রমণকারীর চেক, পে-অর্ডার, হুন্ডি প্রভৃতি সহজ বিনিময় মাধ্যম সৃষ্টি করে বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রাকে সহজ করে তুলছে।
১২. বৈদেশিক বিনিময়ঃ জনগণের প্রয়োজনে ব্যাংক বৈদেশিক বিনিময় কার্য সম্পাদন করে।
১৩. কর্ম সংস্থানঃ দেশের বেকার লোকদের কর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতেও বাংলাদেশের ব্যাংকসমূহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ (Controlling of Banking System in Bangladesh)
বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের পুরো দায়িতব কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকে। তবে এ নিয়ন্ত্রণ প্রচলিত ব্যাংকিং কোম্পানি আইন ১৯৯১ অনুযায়ী হয়ে থাকে। এ ছাড়া বিশেষ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক directive বা আদেশ জারি করে ব্যাংকিং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ব্যাংকের পাশাপাশি Non-bank আর্থিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এগুলো হলো মূলত: Lending কোম্পানি। যেমন- আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিঃ। Non-bank আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সকল ব্যাংক এবং Non-bank আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তফসিলভুক্ত সকল ব্যাংকের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নানা বিধান প্রবর্তন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের বিভিন্ন ধারা ব্যবহারের মাধ্যমে তফসিলী ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।
জেনে রাখা ভালো যে, ব্যাংকিং কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এ নিচের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে-
১. ব্যাংকের সংজ্ঞা ও গঠন প্রণালী।
২. ব্যাংকের কাজের আওতা
৩. ব্যাংকের কার্যপ্রণালী
৪. লাইসেন্স পাওয়ার বিধান
৫. তালিকাভুক্তির বিষয়
৬. তালিকাভুক্ত ব্যাংকের দায়-দায়িতব
৭. ব্যাংকের মূলধন তহবিল ব্যবস্থাপনা
৮. ব্যাংকের হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি
৯. ব্যাংকের বিলোপ সাধনের বিধান
এছাড়াও, ব্যাংকের হিসাব কার্য নিয়ন্ত্রণের জন্য BASEL পদ্ধতিতে ব্যাংকের হিসাবরক্ষণ করার বিধান প্রচলন রয়েছে। আসুন, BASEL সম্পর্কে জেনে নিই।
‘ব্যাসেল সম্মতি’ (BASEL Accords) হলো একটি আন্তর্জাতিক নির্দেশনা। এর মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততা নিরূপণ করা হয়। সুইডেনের ব্যাসেলে শহরে পৃথিবীর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধিরা এ নির্দেশনা বা মানদন্ড তৈরি করেছেন। এ পর্যন্ত তিনটি মানদন্ড ঘোষণা করা হয়েছে: ব্যাসেল-১, ব্যাসেল-২ এবং ব্যাসেল-৩।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ব্যাসেল সম্মতি মেনে চলতে হয়। ব্যাসেল-৩ বাসত্মবায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালে একটি রোডম্যাপ তৈরি করে দিয়েছে। ব্যাসেলের মাধ্যমে ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততা (Capital adquacy), ধকল পরীক্ষা (stress testing), তারল্য ঝুঁকি (liquidity risk) ইত্যাদি পর্যালোচনা করা হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions