ইন্টারনেটের জনক কে?
উত্তর: ভিন্টন গ্রে কার্ফ
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জনক কে?
উত্তর: টিম বার্নার্স লি।
ইন্টারনেট আবিষ্কার হয় কত সালে?
উত্তর: ১৯৬৯ সালে।
ইন্টারনেট আবিষ্কারের ইতিহাস:
ইন্টারনেটের উৎপত্তি ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা একটি অত্যন্ত জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইন্টারনেটের জনক কে বা কাকে বলা যায় সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই, এটি একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাজ নয়, বরং এটি বহু বছরের গবেষণা, উন্নয়ন, এবং প্রচেষ্টার ফলাফল। নিম্নে ইন্টারনেটের ইতিহাস, এর জনকদের অবদান, এবং তাদের বৈশিষ্ট্যগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
ইন্টারনেটের শুরুর দিনগুলি
ইন্টারনেটের ধারণা প্রথম উদ্ভাবিত হয়েছিল ১৯৬০-এর দশকে, যখন মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর একটি প্রকল্প চালু করেছিল যা শেষ পর্যন্ত ইন্টারনেটের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এই প্রকল্পটি ছিল ARPANET (Advanced Research Projects Agency Network), যা প্রথমে কেবল কিছু বৈজ্ঞানিক এবং সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো।
- ARPANET: ARPANET ছিল প্রথম বড় স্কেল নেটওয়ার্ক যা প্যাকেট সুইচিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল। এটি মূলত গবেষণাগারগুলির মধ্যে দ্রুত তথ্য আদান প্রদান করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল।
- প্যাকেট সুইচিং: এটি একটি প্রযুক্তি যা একটি মেসেজকে ছোট ছোট প্যাকেটে বিভক্ত করে এবং প্রতিটি প্যাকেটকে আলাদাভাবে গন্তব্যস্থলে প্রেরণ করে। এটি আজকের ইন্টারনেটের মৌলিক প্রযুক্তি।
ইন্টারনেটের মূল নকশা
ইন্টারনেটের উন্নয়ন চলতে থাকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত, যখন বব কাহন এবং ভিন্টন সের্ফ দুটি মৌলিক প্রটোকল ডিজাইন করেন, যা টিসিপি/আইপি (Transmission Control Protocol/Internet Protocol) নামে পরিচিত। এই প্রোটোকলগুলি ইন্টারনেটের ভিত্তি স্থাপন করে এবং বিভিন্ন নেটওয়ার্কের মধ্যে ডেটা আদান প্রদানের জন্য একটি মানক ব্যবস্থা প্রদান করে।
- বব কাহন: ইন্টারনেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রটোকল, TCP/IP এর সহ-উদ্ভাবক। তিনি ARPANET প্রকল্পের নেতৃত্বে ছিলেন এবং এই প্রটোকলের উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করেন।
- ভিন্টন সের্ফ: TCP/IP প্রটোকলের আরেক সহ-উদ্ভাবক। তাকে প্রায়শই "ইন্টারনেটের জনক" বলা হয় কারণ তিনি TCP/IP প্রোটোকল এবং ARPANET নেটওয়ার্ককে একত্রিত করার জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
ইন্টারনেটের বিকাশ ও বিস্তার
ইন্টারনেটের সংযোগ বৃদ্ধি
১৯৮০-এর দশকে ইন্টারনেটের বিকাশ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এটি শিক্ষাগত ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রাথমিকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। পরবর্তীতে এটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্যও উন্মুক্ত করা হয়।
- NSFNET: ১৯৮৫ সালে, ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন একটি ব্যাকবোন নেটওয়ার্ক তৈরি করে যা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্রুত সংযোগ প্রদান করে। এই নেটওয়ার্কটি ইন্টারনেটের মূল অংশ হয়ে ওঠে।
- ডোমেইন নেম সিস্টেম (DNS): ১৯৮৪ সালে, DNS প্রবর্তিত হয় যা ডোমেইন নামগুলিকে আইপি ঠিকানার সাথে যুক্ত করে এবং এটি ইন্টারনেটকে আরও ব্যবহারযোগ্য করে তোলে।
ইন্টারনেটের বাণিজ্যিক ব্যবহার
১৯৯০-এর দশকে ইন্টারনেট বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে শুরু করে, এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) এর আবির্ভাব ঘটে।
- ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব: ১৯৮৯ সালে টিম বার্নার্স-লি প্রথম ওয়েব ব্রাউজার এবং ওয়েব সার্ভার তৈরি করেন, যা WWW নামে পরিচিত হয়। এটি একটি বৈশ্বিক ওয়েবসাইট তৈরির সিস্টেম যা ব্যবহারকারীদের হাইপারলিঙ্কের মাধ্যমে ডকুমেন্ট এবং অন্যান্য মিডিয়াতে নেভিগেট করতে দেয়।
- মোজাইক: ১৯৯৩ সালে, প্রথম ব্যবহারকারী-বান্ধব ওয়েব ব্রাউজার মোজাইক চালু হয়, যা সাধারণ মানুষের কাছে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস সহজ করে তোলে। এটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
ইন্টারনেটের প্রধান ব্যক্তিত্ব ও তাদের অবদান
পল বারান
পল বারান ছিলেন একজন মার্কিন ইঞ্জিনিয়ার এবং গবেষক যিনি প্যাকেট সুইচিং ধারণার প্রবর্তক। তার কাজটি ইন্টারনেটের ভিত্তি হিসাবে গৃহীত হয়।
- প্যাকেট সুইচিং: বারান প্রথম প্যাকেট সুইচিং ধারণাটি উপস্থাপন করেন যা ডেটাকে ছোট প্যাকেটে ভেঙে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রেরণ করে। এটি ইন্টারনেটের কাঠামো তৈরিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি।
ডোনাল্ড ডেভিস
ডোনাল্ড ডেভিস ব্রিটিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানী যিনি পল বারানের স্বতন্ত্রভাবে প্যাকেট সুইচিং ধারণার উন্নয়ন করেন।
- NPL Network: ডেভিস তার NPL Network এর মাধ্যমে প্যাকেট সুইচিং প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করেন, যা ARPANET এর উন্নয়নে সহায়ক হয়।
লরেন্স রবার্টস
লরেন্স রবার্টস ছিলেন ARPANET প্রকল্পের পরিচালক এবং ইন্টারনেটের মূল নকশা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
- ARPANET Design: রবার্টস ARPANET এর স্থাপত্য এবং নকশা তৈরিতে মূল ভূমিকা পালন করেন, যা পরে ইন্টারনেটের ভিত্তি হয়ে ওঠে।
টিম বার্নার্স-লি
টিম বার্নার্স-লি WWW-এর জনক হিসাবে পরিচিত। তিনি প্রথম ওয়েব ব্রাউজার এবং ওয়েব সার্ভার তৈরি করেন।
- ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব: বার্নার্স-লি প্রথম HTML, HTTP, এবং URL তৈরি করেন, যা ওয়েব পেজ তৈরি এবং ইন্টারনেটে নেভিগেট করার জন্য মূল প্রযুক্তি। তিনি WWW এর মাধ্যমে ইন্টারনেটকে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেন।
ইন্টারনেটের প্রভাব ও ভবিষ্যত
সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব
ইন্টারনেট সমাজ এবং সংস্কৃতিতে বিশাল পরিবর্তন এনেছে। এটি তথ্যপ্রাপ্তি, যোগাযোগ, শিক্ষা, এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।
- তথ্যপ্রাপ্তি: ইন্টারনেট তথ্যের জন্য একটি বিশাল উৎস হয়ে উঠেছে। এটি ব্যবহারকারীদের দ্রুত এবং সহজে তথ্য অনুসন্ধান এবং সংগ্রহ করতে সহায়তা করে।
- যোগাযোগ: ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ এবং কার্যকর হয়েছে। ইমেল, সোশ্যাল মিডিয়া, এবং মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনগুলি যোগাযোগের পদ্ধতিগুলিকে পরিবর্তন করেছে।
- শিক্ষা: ইন্টারনেট শিক্ষার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। অনলাইন কোর্স, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, এবং শিক্ষামূলক ভিডিওগুলি শিক্ষাকে আরও সহজ এবং অ্যাক্সেসযোগ্য করেছে।
- বাণিজ্য: ই-কমার্স ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাণিজ্যকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। অনলাইন শপিং, ডিজিটাল পেমেন্ট, এবং ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে ওঠার সুবিধাগুলি ইন্টারনেট বাণিজ্যকে দ্রুত বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছে।
ইন্টারনেটের ভবিষ্যত
ইন্টারনেটের ভবিষ্যত সম্ভাবনা প্রচুর এবং এর সাথে যুক্ত রয়েছে বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি এবং উন্নয়ন।
- ফাইভজি (5G): 5G প্রযুক্তি ইন্টারনেটের গতিতে বিপ্লব আনবে এবং ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) এবং অন্যান্য উন্নত সেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে।
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI): AI এবং মেশিন লার্নিং ইন্টারনেট সেবাগুলিকে আরও বুদ্ধিমান এবং ব্যবহারকারী-বান্ধব করবে।
- ব্লকচেইন: ব্লকচেইন প্রযুক্তি ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাণিজ্য এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করবে।
ইন্টারনেটের জনক বলা যায় একক ব্যক্তি নয় বরং বিভিন্ন বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। ARPANET থেকে শুরু করে WWW পর্যন্ত, বব কাহন, ভিন্টন সের্ফ, পল বারান, ডোনাল্ড ডেভিস, এবং টিম বার্নার্স-লি সহ অনেকেই ইন্টারনেটের বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions