কুরবানীর মাসায়েল
কুরবানীর মাসায়েল
কুরবানীর নিয়ম কানুন, কুরবানী কার উপর ফরজ ও কুরবানীর মাসায়েলসহ বিস্তারিত জানুন!
কুরবানীর ফযীলত :
* কুরবানীর জন্তুর শরীরে যত পশম থাকে, প্রত্যেকটা পশমের পরিবর্তে এক একটি নেকী পাওয়া যায় ।
* কুরবানীর দিনে কুরবানী করাই সবচেয়ে বড় ইবাদত।
বি:দ্র: কুরবানী আসলে ফরজ নয় ওয়াজিব।
কাদের উপর কুরবানী দেয়া ওয়াজিব:
* ১০ই যিলহজ্জের ফজর থেকে ১২ই যিলহজ্জের সন্ধা পর্যন্ত অর্থাৎ, কুরবানীর দিনগগুলোতে যার নিকট সদকায়ে ফিতর/ফিতরা ওয়াজিব হওয়া পরিমাণ অর্থ/সম্পদ থাকে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
* মুসাফিরের উপর (সফরের হালতে থাকলে) কুরবানী করা ওয়াজিব হয়না।
* কুরবানী ওয়াজিব না হলেও নফল কুরবানী করলে কুরবানীর ছওয়াব পাওয়া যাবে।
* কুরবানী শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয়-সন্তানাদি, মাতা-পিতা ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয় না, তবে তাদের পক্ষ থেকে করলে তা নফল কুরবানী হবে।
* যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয় সে কুরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় করলে সেই পশু কুরবানী করা তার উপর ওয়াজিব হয়ে যায় ।
* কোন মকসূদের জন্য কুরবানীর মান্নত করলে সেই মকসূদ পূর্ণ হলে, তার উপর (গরীব হোক বা ধনী) কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
* যার উপর কুরবানী ওয়াজিব সে কুরবানী না করলে কুরবানীর দিনগগুলো চলে যাওয়ার পর একটা বকরীর মূল্য সদকা করা ওয়াজিব।
কোন্ কোন্ জন্তু দ্বারা কুরবানী করা যায়েজ:
* বকরী, পাঠা, খাসী, ভেড়া, ভেড়ী, দুম্বা গাভী, ষাড়, বলদ, মহিষ, উট। | এই কয় প্রকার গৃহপালিত জন্তু দ্বারা কুরবানী করা দুরস্ত।
কুরবানীর জন্তুর বয়স প্রসঙ্গ :
* বকরী, খাসী, ভেড়া, ভেড়ী, দুম্বা কম পক্ষে পূর্ণ এক বৎসর বয়সের হতে হবে। তবে ভেড়া, ভেড়ী ও দুম্বার বয়স যদি কিছু কমও হয় কিন্তু এরূপ মোটা তাজা হয় যে, এক বৎসর বয়সীদের মধ্যে ছেড়ে দিলেও তাদের চেয়ে ছোট মনে হয় না, তাহলে তার দ্বারা কুরবানী দুরস্ত আছে; তবে অন্ততঃ ছয় মাস বয়স হতে হবে । বকরীর ক্ষেত্রে এরূপ ব্যতিক্রম নেই । বকরী কোন অবস্থায় এক বৎসরের কম বয়সের হতে পারবে না।
* গরু ও মহিষের বয়স কম পক্ষে দুই বৎসর হতে হবে ।
* উট-এর বয়স কম পক্ষে পাঁচ বৎসর হতে হবে।
কুরবানীর জন্তুর স্বাস্থ্যগত অবস্থা প্রসঙ্গ :
* কুরবানীর পশু ভাল এবং হৃষ্ট-পুষ্ট হওয়া উত্তম।
* যে প্রাণী লেংড়া অর্থাৎ, যা তিন পায়ে চলতে পারে –এক পা মাটিতে রাখতে পারে না বা রাখতে পারলেও তার উপর ভর করতে পারে না- এরূপ পশু দ্বারা কুরবানী জায়েয নয়।
* যে পশুর একটিও দাঁত নেই তা দ্বারা কুরবানী দুরস্ত নয়। তবে দাঁত না থাকা সত্ত্বেও ঘাস খেতে সক্ষম হলে তা দ্বারা কুরবানী দুরস্ত আছে।
* যে পশুর কান জন্ম থেকেই নেই তা দ্বারা কুরবানী দুরস্ত নয়। তবে কান ছোট হলে অসুবিধা নেই।
* যে পশুর শিং মূল থেকে ভেঙ্গে যায় তা দ্বারা কুরবানী দুরস্ত নয়। তবে শিং ওঠেইনি বা কিছু পরিমাণ ভেঙ্গে গিয়েছে এরূপ পশুর কুরবানী দুরস্ত আছে।
* যে পশুর উভয় চোখ অন্ধ বা একটি চোখ পূর্ণ অন্ধ বা একটি চোখের দৃষ্টি শক্তি এক তৃতীয়াংশের বেশী নষ্ট তা দ্বারা কুরবানী দুরস্ত নয়।
* যে পশুর একটি কান বা লেজের এক তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশী কেটে গিয়েছে তা দ্বারা কুরবানী দুরস্ত নয়।
* অতিশয় কৃশকায় ও দুর্বল পশু যার এতটুকু শক্তি নেই যে, জবেহের স্থান পর্যন্ত হেটে যেতে পারে তা দ্বারা কুরবানী দুরস্ত নয়।
* ভাল পশু ক্রয় করার পর এমন দোষ ত্রুটি দেখা দিয়েছে যার কারণে কুরবানী দুরস্ত হয় না-এরূপ হলে ঐ জন্তুটি রেখে আর একটি ক্রয় করে কুরবানী করতে হবে । তবে ক্রেতা গরীব হলে সেটিই কুরবানী দিতে পারবে।
* যার সমস্ত উপার্জন বা অধিকাংশ উপার্জন হারাম, তাকে শরীক করে কুরবানী করলে অন্যান্য সকল শরীকের কুরবানী অশুদ্ধ হয়ে যাবে ।
কুরবানীর পশু জবেহ করা প্রসঙ্গ:
* নিজের কুরবানীর পশু নিজেই জবেহ করা উত্তম। নিজে জবেহ না করলে বা করতে না পারলে জবেহের সময় সামনে থাকা ভাল। মেয়েলোকের পর্দার ব্যাঘাত হওয়ার কারণে সামনে না থাকতে পারলে ক্ষতি নেই।
* কুরবানীর পশুকে মাটিতে শুইয়ে তার মুখ কেবলামুখী করে নিম্নের দুআ পাঠ করা উত্তম:
انى وهت وجهي للذي فطر السموات والارض حنيفا وما أنا من المشركين - ا صلوتی ونشكی ومحياي ومماتي لله رب العلمين ؟ شريك له وبذلك أمرت وأنا من الممملمين اللهم منك ول۔
অতঃপর জবেহ করবে। কেউ দুআ পড়তে না পারলে শুধু ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার' বলে জবেহ করলেও চলবে।
* কুরবানী দাতা বা কুরবানী দাতাগণের নাম মুখে উচ্চারণ করা বা কাগজে লিখে পড়া জরূরী নয়। আল্লাহ পাক জানেন এটা কার কুরবানী। সে অনুযায়ীই সে কুরবানী গৃহীত হবে।
* কুরবানীর পশু রাতের বেলায়ও জবেহ করা জায়েয তবে ভাল নয়।
* ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী করা জায়েয নয়। তবে যেখানে জুমুআ ও ঈদের নামায দুরস্ত নয় সেখানে সুবহে সাদেকের পর থেকেই কুরবানী করা দুরস্ত আছে।
গোশত বন্টনের তরীকা:
* অংশীদারগণ সকলে একান্নভুক্ত হলে গোশত বন্টনের প্রয়োজন নেই । অন্যথায় বন্টন করতে হবে।
* অংশীদারগণ গোশত অনুমান করে বন্টন করবে না বরং বাটখারা দিয়ে ওজন করে বন্টন করতে হবে। অন্যথায় ভাগের মধ্যে কমবেশ হয়ে গেলে গোনাহগার হতে হবে। অবশ্য কোন অংশীদার মাথা, পায়া ইত্যাদি বিশেষ কোন অংশ গ্রহণ করলে তার ভাগে গোশত কিছু কম হলেও তা দুরস্ত হবে। কিন্ত যে ভাগে গোশত বেশী সেভাগে মাথা পায়া ইত্যাদি বিশেষ অংশ দেয়া যাবে না।
* অংশীদারগণ সকলে যদি সম্পূর্ণ গোশত দান করে দিতে চায় বা সম্পূর্ণটা রান্না করে বিলাতে বা খাওয়াতে চায় তাহলে বন্টনের প্রয়োজন নেই।
কুরবানীর গোশত খাওয়া ও দান করার মাসায়েল:
* কুরবানীর গোশত নিজে খাওয়া, পরিবারবর্গকে খাওয়ানো, আত্মীয়স্বজনকে দেয়া এবং গরীব মিসকীনকে দেয়া সবই জায়েয। মোস্তাহাব ও উত্তম তরীকা হল তিনভাগ করে একভাগ নিজেদের জন্য রাখা, একভাগ আত্মীয়স্বজনকে দেয়া এবং একভাগ গরীব মিসকীনকে দান করা।
* মান্নতের কুরবানীর গোশত হলে নিজে খেতে পারবে না এবং মালদারকেও দিতে পারবে না বরং পুরোটাই গরীব মিসকীনদেরকে দান করে দেয়া ওয়াজিব।
* যদি কোন মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে কুরবানীর জন্য ওছিয়াত করে গিয়ে। থাকে তবে সেই কুরবানীর গোশতও মান্নতের কুরবানীর গোশতের ন্যায় পুরোটাই খয়রাত করা ওয়াজিব।
* কুরবানীর গোশত বা বিশেষ কোন অংশ (যেমন মাথা) পারিশ্রমিক রূপে দেয়া জায়েয নয়।
* কুরবানীর গোশত শুকিয়ে (বা ফ্রীজে রেখে) দীর্ঘ দিন খাওয়াতে কোন অসুবিধা নেই।
কুরবানীর পশুর চামড়া সম্পর্কিত মাসায়েল:
* কুরবানীর পশুর চামড়া শুকিয়ে বা প্রক্রিয়াজাত করে নিজেও ব্যবহার করা জায়েয।
* কুরবানীর চামড়া খয়রাতও করা যায় তবে বিক্রি করলে সে পয়সা নিজে ব্যবহার করা যায় না- খয়রাতই করা জরূরী এবং ঠিক ঐ পয়সাটাই খয়রাত করতে হবে। ঐ পয়সাটা নিজে খরচ করে অন্য পয়সা দান করলে আদায় হবে বটে, তবে অন্যায় হবে।
* কুরবানীর চামড়ার দাম মসজিদ মাদ্রসার নির্মাণ কাজে বা বেতন বাবত বা পারিশ্রমিক বাবত বা অন্য কোন নেক কাজে খরচ করা দুরস্ত নয়। খয়রাতই করতে হবে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions