জীবন ও বৃক্ষ - মোতাহের হোসেন চৌধুরী
লেখক পরিচিতি
মোতাহের হোসেন চৌধুরী নোয়াখালি জেলার কাঞ্চনপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে ১৯০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আব্দুল মজিদ ও মাতা ফতেমা খাতুন। শৈশবেই তাঁর পিতা মারা যাওয়ায় কুমিল্লায় নানবাড়িতেই তিনি বেড়ে ওঠেন। কুমিল্লার ইউসুফ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে তিনি আইএ ও বিএ পাশ করেন। ১৯৪৩ সালে বহিরাগত হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে চট্টগ্রাম কলেজে চাকরি করেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সাহিত্যিক জীবনের সূচনা হয় ১৯২৬ সালে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও শিখা গোষ্ঠির সংস্পর্শে এসে। এ কারণে তাঁর রচিত প্রবন্ধসমূহে যুক্তিনিষ্ঠা এবং মুক্তবুদ্ধির পরিচয় বিশেষভাবে বিধৃত। মুক্তবুদ্ধিমনা বিশেষ ব্যক্তিত্ব কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদির প্রমুখ ব্যক্তিদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছিলেন। একজন সংস্কৃতিবান ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি যুক্তিনিষ্ঠও মুক্তবুদ্ধিদীপ্ত সরস প্রবন্ধ রচনায় কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। তাঁর জীবন ও সাহিত্য প্রভাবিত হয়েছিল ক্লাইভ বেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বার্টান্ড রাসেলের দ্বারা।ক্লাইভ বেলএর Civilization গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত ‘সভ্যতা' (১৯৬৫) এবং বার্টান্ড রাসেলের Conquest of Happiness গ্রন্থের অনুবাদ ‘সুখ’ (১৯৬৮) তার দুটি বিশিষ্ট রচনা। তিনি তাঁর রচনায় সংস্কৃতি, ধর্ম, মানবতাবোধ ও মানুষের জীবনাচরণের মৌলিক বিষয়গুলো সংজ্ঞায়িত ও উন্মোচিত করতে চেয়েছেন এবং বিচিত্র ও সুন্দরভাবে বাঁচার মধ্য দিয়ে মহত্তম জীবনের সন্ধান করেছেন।তাঁর গদ্যশৈলীতে প্রমথ চৌধুরীর এবং মননে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব লক্ষণীয়। তিনি ছিলেন মূলত প্রবন্ধকার। গুণগ্রাহী বন্ধুরা মৃত্যুর পর তাঁর রচনাবলি সংকলিত করে সংস্কৃতি কথা (১৯৫৮) নামে একটি প্রবন্ধগ্রন্থ সংকলন বের করেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরী ছিলেন যুক্তিবাদী। তবে একই সাথে তিনি ছিলেন জীবনরসের রসিক। এ কারণেই বলা হয় তাঁর গদ্যরচনা ‘বুদ্ধির দীপ্তিতে পরিচ্ছন্ন এবং স্মিতরসে সিগ্ধ। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ভূমিকা
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘জীবন ও বৃক্ষ' প্রবন্ধটি সংস্কৃতি কথা' গ্রন্থ থেকে চয়ন করা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে লেখক বৃক্ষের পরিপূর্ণ বিকাশের সঙ্গে মানব জীবনের তুলনা করেছেন। অঙ্কুরোদগমের পর্যায় থেকে নানা রূপান্তর ও বৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে বৃক্ষের মতো মানব জীবনও পূর্ণতা পায়। শুধু বেঁচে থাকাই মানব জীবনের উদ্দেশ্য নয়। অন্যের প্রেমে ও সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেবার মাঝেই জীবনে যেমন পূর্ণতা আসে তেমনি বৃক্ষও ফল, ফুলে পরিপূর্ণ হয়ে তার জীবন সার্থক করে। এভাবেই লেখক এই প্রবন্ধেজীবনের সাথে বৃক্ষের তুলনা করেছেন ।
জীবন ও বৃক্ষ
-মোতাহের হোসেন চৌধুরী
সমাজের কাজ কেবল টিকে থাকার সুবিধা দেয়া নয়, মানুষকে বড় করে তোলা, বিকশিত জীবনের জন্য মানুষের জীবনে আগ্রহ জাগিয়ে দেয়া। স্বল্পপ্রাণ স্থূলবুদ্ধি ও জবরদস্তিপ্রিয় মানুষে সংসার পরিপূর্ণ। তাদের কাজ নিজের জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলা নয়, অপরের সার্থকতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ লাভ করেনি বলে এরা নিষ্ঠুর ও বিকৃতবুদ্ধি। এদের একমাত্র দেবতা অহঙ্কার। তারই চরণে তারা নিবেদিতপ্রাণ । ব্যক্তিগত অহঙ্কার, পারিবারিক অহঙ্কার, জাতিগত অহঙ্কার- এ সবের নিশান ওড়ানোই এদের কাজ। মাঝে মাঝে মানবপ্রেমের কথাও তারা বলে। কিন্তু তাতে নেশা ধরে না, মনে হয় আন্তরিকতাশূন্য, উপলব্ধিহীন বুলি। এদের স্থানে এনে দিতে হবে বড় মানুষ- সূক্ষ্মবুদ্ধি উদারহৃদয় গভীরচিত্ত ব্যক্তি, যাদের কাছে বড় হয়ে উঠবে জীবনের বিকাশ, কেবল টিকে থাকা নয়। তাদের কাছে জীবনাদর্শের প্রতীক হবে প্রাণহীন ছাঁচ বা কল নয়, সজীব বৃক্ষ- যার বৃদ্ধি আছে, গতি আছে, বিকাশ আছে, ফুলে ফলে পরিপূর্ণ হয়ে অপরের সেবার জন্য প্রস্তুত হওয়া যার কাজ। বৃক্ষের জীবনের গতি ও বিকাশকে উপলব্ধি করা দরকার, নইলে সার্থকতা ও পরিপূর্ণতার ছবি চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে না। বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয়। তাই, বারবার সেদিকে তাকানো প্রয়োজন। মাটির রস টেনে নিয়ে নিজেকে মোটাসোটা করে তোলাতেই বৃক্ষের কাজের সমাপ্তি নয়। তাকে ফুল ফোটাতে হয়, ফল ধরাতে হয়। নইলে তার জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই বৃক্ষকে সার্থকতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা সজীবতা ও সার্থকতার এমন জীবন্ত দৃষ্টান্ত আর নেই। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ অন্য কথা বলেছেন। ফুলের ফোটা আর নদীর গতির সঙ্গে তুলনা করে তিনি নদীর গতির মধ্যেই মনুষ্যত্বের সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছেন। তাঁর মতে মনুষ্যত্বের বেদনা নদীর গতিতেই উপলব্ধি হয়, ফুলের ফোটায় নয়। ফুলের ফোটা সহজ, নদীর গতি সহজ নয়- তাকে অনেক বাধা ডিঙানোর দুঃখ পেতে হয়। কিন্তু ফুলের ফোটার দিকে না তাকিয়ে বৃক্ষের ফুল ফোটানোর দিকে তাকালে বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ ভালো করতেন। তপোবন-প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ কেন যে তা করলেন না বোঝা মুশকিল। জানি, বলা হবে : নদীর গতিতে মনুষ্যত্বের দুঃখ যতটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বৃক্ষের ফুল ফোটানোয় তা তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। তাই কবি নদীকেই মনুষ্যত্বের প্রতীক করতে চেয়েছেন।
উত্তরে বলব : চর্মচক্ষুকে বড় না করে কল্পনা ও অনুভূতির চক্ষুকে বড় করে তুললে বৃক্ষের বেদনাও সহজে উপলব্ধি করা যায়। আর বৃক্ষের সাধনার যেমন একটা ধীর স্থির ভাব দেখতে পাওয়া যায়, মানুষের সাধনায়ও তেমনি একটা ধীরস্থির ভাব দেখতে পাওয়া যায়, আর এটাই হওয়া উচিত নয় কি? অনবরত ধেয়ে চলা মানুষের সাধনা হওয়া উচিত নয়। যাকে বলা হয় গোপন ও নীরব সাধনা তা বৃক্ষেই অভিব্যক্ত, নদীতে নয়। তাছাড়া বৃক্ষের সার্থকতার ছবি যত সহজে উপলব্ধি করতে পারি, নদীর সার্থকতার ছবি তত সহজে উপলব্ধি করা যায় না। নদী সাগরে পতিত হয় সত্য, কিন্তু তার ছবি আমরা প্রত্যহ দেখতে পাই না। বৃক্ষের ফুল ফোটানো ও ফল ধরানোর ছবি কিন্তু প্রত্যহ চোখে পড়ে। দোরের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে সে অনবরত নতি, শান্তি ও সেবার বাণী প্রচার করে। সাধনার ব্যাপারে প্রাপ্তি একটা বড় জিনিস। নদীর সাগরে পতিত হওয়ায় সেই প্রাপ্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। সে তো প্রাপ্তি নয়, আত্মবিসর্জন। অপরপক্ষে বৃক্ষের প্রাপ্তি চোখের সামনে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। ফুলে ফলে যখন সে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন আপনা থেকেই বলতে ইচ্ছা হয় : এইতো সাধনার সার্থকতা। বৃক্ষে প্রাপ্তি ও দান। সৃজনশীল মানুষেরও প্রাপ্তি ও দানে পার্থক্য দেখা যায় না। যা তার প্রাপ্তি, তাই তার দান। বৃক্ষের পানে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই অন্তরের সৃষ্টিধর্ম উপলব্ধি করেছেন। বহু কবিতায় তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু গদ্যে তিনি তা স্পষ্ট করে বলেননি। বললে ভালো হতো। তাহলে নিজের ঘরের কাছেই যে সার্থকতার প্রতীক রয়েছে, সে সম্বন্ধে আমরা সচেতন হতে পারতাম। নীরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদের সার্থকতার গান গেয়ে শোনায়। অনুভূতির কান দিয়ে সে গান শুনতে হবে। তাহলে বুঝতে পারা যাবে জীবনের মানে বৃদ্ধি, ধর্মের মানেও তাই। প্রকৃতির যে ধর্ম মানুষের সে ধর্ম; পার্থক্য কেবল তরুলতা ও জীবজন্তুর বৃদ্ধির ওপর তাদের নিজেদের কোনো হাত নেই, মানুষের বৃদ্ধির ওপরে তার নিজের হাত রয়েছে। আর এখানেই মানুষের মর্যাদা। মানুষের বৃদ্ধি কেবল দৈহিক নয়, আত্মিকও। মানুষকে আত্মা সৃষ্টি করে নিতে হয়, তা তৈরি পাওয়া যায় না। সুখদুখ-বেদনা উপলব্ধির ফলে অন্তরের যে পরিপক্বতা, তাই তো আত্মা। এই আত্মারূপ ফল স্রষ্টার উপভোগ্য। তাই মহাকবির মুখে শুনতে পাওয়া যায় : Ripeness is all- পরিপক্বতাই সব। আত্মাকে মধুর ও পুষ্ট করে গড়ে তুলতে হবে। নইলে তা স্রষ্টার উপভোগের উপযুক্ত হবে না। বিচিত্র অভিজ্ঞতা, প্রচুর প্রেম ও গভীর অনুভূতির দ্বারা আত্মার পরিপুষ্টি ও মাধুর্য। সম্পাদন সম্ভব। তাই তাদের সাধনাই মানুষের শিক্ষার প্রধান বিষয়বস্তু। বস্তু-জিজ্ঞাসা তথা বিজ্ঞান কখনো শিক্ষার প্রধান বিষয়বস্তু হতে পারে না। কেননা, তাতে আত্মার উন্নতি হয় না- জীবনবোধ ও মূল্যবোধে অন্তর পরিপূর্ণ হয় না; তা হয় সাহিত্য-শিল্পকলার দ্বারা। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের এতো মূল্য। উপরে যে বৃদ্ধির কথা বলা হলো বৃক্ষের জীবন তার চমৎকার নিদর্শন। বৃক্ষের অঙ্কুরিত হওয়া থেকে ফলবান হওয়া পর্যন্ত সেখানে কেবলই বৃদ্ধির ইতিহাস। বৃক্ষের পানে তাকিয়ে আমরা লাভবান হতে পারি- জীবনের গূঢ় অর্থ সম্বন্ধে সচেতন হতে পারি বলে। বৃক্ষ যে কেবল বৃদ্ধির ইশারা তা নয়- প্রশান্তিরও ইঙ্গিত। অতি শান্ত ও সহিষ্ণুতায় সে জীবনের গুরুভার বহন করে।
নির্বাচিত শব্দের অর্থ ও টীকা
অনুভূতিরচক্ষু সংবেদনশীল মনের চক্ষু। অন্তরায় বাধা। অভিব্যক্ত- প্রকাশিত। আত্মিক আত্মা সম্বন্ধীয়। আত্মবিসর্জন- পরের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন। উপলব্ধি গভীর অনুভূতি। গভীরচিত্ত গভীর চিন্তাচেতনা সম্পন্ন। গৃঢ় অর্থ- প্রচ্ছন্ন গভীর তাৎপর্য চর্মচক্ষু- দৈহিক চক্ষু (মানসিক বা দিব্যদৃষ্টির বিপরীত)। জবরদস্তি প্রিয় যে অন্যের ওপর জোর খাটাতে ভালবাসে। জীবনবোধ- জীবনের স্বরূপ সম্পর্কিত উপলব্ধি। জীবনাদর্শ- জীবনে অনুকরণের উপযুক্ত মহৎ ও শ্রেষ্ঠ দিকগুলো। ডিঙানো- লাফিয়ে পার হওয়া। তপোবন- তপস্যার জন্য যে বন। তাৎপর্য- অন্তর্নিহিত অর্থ, অন্তৰ্গঢ় ভাব, মর্ম। ধেয়ে চলা- এগিয়ে চলা। নতি- আনত, নম্র, নিচের দিকে নিবদ্ধ। নিশান- পতাকা। পতিত পড়ে যাওয়া, ঝরে যাওয়া। পরিপক্বতা- পূর্ণ পরিণতি। প্রতীক- কোনো কিছুকে বা জিনিসকে বোঝানোর জন্য যে চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। প্রশান্তি ধীর ও শান্ত ভাব। বিকৃত বুদ্ধি- অসত্যুদ্ধি। বম্ভজিজ্ঞাসা- বস্তুজগতের রহস্য উন্মোচন-অন্বেষা, বস্তুজগৎ সম্পর্কে জানার আগ্রহ। বিকশিত জীবন- উন্নত ও অগ্রগতিময় জীবন। বুলি- গৎবাঁধা, যথাযথ অর্থ বহন করে না এমন কথা যা অভ্যাসের বশে বলা হয়ে থাকে। বৃক্ষে প্রাপ্তি ও দান- বৃক্ষের অর্জন হচ্ছে তার ফুল ও ফল, এগুলো সে অন্যের হাতে তুলে দেয়, ফলে বৃক্ষ যুগপৎ প্রাপ্তি ও দানের আদর্শ। মনুষ্যত্ব-দয়া, ধর্ম, প্রেম ইত্যাদি মানবোচিত গুণ বা বৈশিষ্ট্য। মূল্যবোধ জীবনের মূল মর্যাদা সম্বন্ধে ধারণা। স্বল্পপ্রাণ-ক্ষীণজীবী। স্কুলবুদ্ধি- যাদের বুদ্ধি কম বা বোকা। সূক্ষ্মবুদ্ধি- তীক্ষ্মবুদ্ধি বা জ্ঞানসম্পন্ন, সূক্ষ্ম বিচার বিবেচনা আছে এমন জ্ঞান। সাদৃশ্য- মিল, অনুরূপ বৈশিষ্ট্য। সাধনা- সাফল্য বা সিদ্ধি অর্জনের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা। সৃজনশীল নির্মাণ সৃষ্টিতে তৎপর। সৃষ্টিধর্ম সৃষ্টি বা সৃজনের বৈশিষ্ট্য। সহিষ্ণুতা- সহ্য করতে পারার গুণ, সহনশীলতা। এদের প্রধান দেবতা অহংকার যথাযথ বিচার-বিবেচনা ও চিন্তাচেতনাহীন লোকেরা এত গর্বোদ্ধত হযে থাকে যে মনে হয় যেন অহংকারই তাদের প্রধান উপাস্য বা দেবতা।
তপোবন প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ :
প্রাচীন ভারতে মুনি-ঋষিরা বনের মাঝে আশ্রম তৈরি করে থাকতেন। সেখানেই সাধনা করতেন। আবার সেই আশ্রমে গুরুর শিষ্যদের (ছাত্র, শিক্ষার্থী) বিভিন্ন শাস্ত্রীয় বিষয় শিক্ষা দেয়া হত। কবি রবীন্দ্রনাথের প্রাচীন ভারতের তপোবন-জীবনের প্রতি যে আকর্ষণ তা তার বহু রচনায় বহুভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আধুনিক নগর সভ্যতা থেকে দূরে প্রকৃতির সান্নিধ্য পাবার উদ্দেশ্যে তিনি বোলপুরে শান্তি নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে প্রথম অবস্থায় আশ্রমের মতোই পড়াশোনা হত। তাই লেখক বলেছেন তপোবন প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ’ ।
সারসংক্ষেপ
মানুষকে বিকশিত হতে সাহায্য করাই সমাজের কাজ। পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষই কেবল নিজের জন্য চিন্তা করে। তাই তারা নিজের জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তো তোলেই না, বরং অন্যের সার্থকতার পথেও বাধা সৃষ্টি করে। এ সমস্ত মানুষ সব সময় অহঙ্কারে মত্ত থাকে। মাঝে মাঝে তারা মানব প্রেমের কথাও বলে, কিন্তু তা আন্তরিকতাশূন্য।
পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা কমিয়ে এদের জায়গায় আনতে হবে উদার হৃদয়ের ব্যক্তি। যাদের উদ্দেশ্য সমাজে কেবল টিকে থাকা নয়, বরং জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিত করা। লেখকের মতে, এদের জীবনাদর্শের প্রতীক হবে সজীব বৃক্ষ। কারণ মানব জীবনের আদর্শ হিসেবে বৃক্ষের মতো জীবন্ত উপমা আর নেই। বৃক্ষের কাজ শুধু মাটির রস টেনে নিয়ে নিজেকে মোটাসোটা করে তোলা নয়, বৃক্ষকে ফুল ফোটাতে হয়, ফল ধরাতে হয়। এ প্রবন্ধে বৃক্ষ মানুষের জীবনাদর্শের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফুলের ফোটা আর নদীর গতির সঙ্গে তুলনা করে নদীর গতির মধ্যেই মনুষ্যত্বের সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন নদীকে অনেক বাধা ডিঙানোর দুঃখ পেতে হয়, যা মানুষের জীবনের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু লেখকের মতে, নদীর মতো অনবরত ধেয়ে চলা মানুষের সাধনা হওয়া উচিত নয়। মানুষের জীবন গোপন ও নীরব সাধনা দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত, যা আমরা বৃক্ষের মধ্যে দেখতে পাই। পরের কল্যাণে নিজেকে গড়ে তোলার সাধনা ও চেতনার জন্য বৃক্ষের উদাহরণ দিয়ে লেখক বলেছেন, বৃক্ষের ন্যায় মানুষকেও জগতের কল্যাণে নীরবে ধূপের গন্ধের ন্যায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার সাধনা করতে হবে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions