মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি
আট শতকে আরবের বণিক মোসলমানরা বাংলার সমুদ্র উপকূলীয় কোনো কোনো অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। কিন্তু সে পর্যায়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা তেমন বাড়ে নি। মুসলিম সমাজ বিস্তারের ঘটনাও তেমন ঘটে নি। এ অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ করা যায় এগার শতক থেকে। এ সময় আরব, সমরখন্দ, গজনী, আফগানিস্তান থেকে উত্তর ভারত ঘুরে সুফি সাধকদের কেউ কেউ বাংলায় আসতে থাকেন। গ্রাম-গঞ্জে খানকাহ স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। এ পর্যায়ে তারা অনেকটা সফল হন। হিন্দু-বৌদ্ধ ও অন্তঃজ শ্রেণির অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। ধীরে ধীরে মুসলিম সমাজ বিস্তার লাভ করে। এই গতি ধারা আরও বৃদ্ধি পায় তের শতকের শুরু থেকে। এ সময় বাংলার শাসন ক্ষমতা চলে আসে মুসলমানদের হাতে। রাজ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ধর্ম প্রচারের গতি বৃদ্ধি পায়। ইসলামের সাম্যনীতি, সেই সঙ্গে রাজ অনুগ্রহ লাভের আশা-আশ্বাসে পিছিয়ে পড়া জাতিগােষ্ঠীর অনেকে ধর্মান্তরিত হয়। এভাবে মুসলিম সমাজ ছড়িয়ে পড়ে।
মুসলমান সুফি সাধকদের এদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমনের ফলে ইসলামের সাম্যের বাণী তৎকালীন সাধারণ মানুষ বিশেষত ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার বঞ্চিত নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। তাই বর্ণ-বৈষম্যের শিকার সাধারণ বাঙালির এক উল্লেখযোগ্য অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। দিল্লির সুলতানদের প্রেরিত গভর্নর ও বাংলা স্বাধীন সুলতানদের নেতৃত্বে ও অঞ্চলে রাজ্য সম্প্রসারণের মধ্যদিয়ে মুসলিম সমাজ বিস্তার প্রক্রিয়াও অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলে।
মুসলমানরা আসার পর প্রথম বৈপ্লবিক পরিবর্তন হিসেবে দেখা গেল সমাজে দীর্ঘদিন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার বঞ্চিত নিম্ন শ্রেণির হিন্দুরা নতুন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এরই পথ ধরে মধ্যযুগের শুরু থেকেই হিন্দু সমাজের অবহেলিত শ্রেণির মধ্যে শিক্ষার প্রসারতা দেখা যেতে পারে। এ যুগে এতকালের বঞ্চিত ও অবহেলিতরা লেখাপড়া করার সমান সুযোগ পায়। শুধু তাই নয় নিম্নশ্রেণির অনেকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ধারণা করা যায় রাজ আনুকূল্যের কারণে হিন্দু সমাজ তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটিয়ে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার মতো সামর্থ অর্জন করতে | পেরেছিল। এটা সমাজ গঠনের জন্য নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
সুফিবাদ প্রসারে শংকিত এদেশের হিন্দুদের এক বিরাট অংশ নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠে। তার প্রকাশ বলা চলে শ্রী চৈতন্যের নব্য বৈষ্ণব আন্দোলন। মুসলমানদের ধর্ম ও জীবনের আলোকে হিন্দু সমাজ সংস্কার করে | হিন্দু সমাজে ইসলাম প্রচারের পথ বন্ধ করার জন্য বৈষ্ণব ধর্মের আবির্ভাব হয়। ভক্তিধর্মের অনুসারীরা হিন্দুসমাজকে রক্ষা করার জন্য ইসলামী মূল্যবোধের অনেক কিছু গ্রহণ করে।
প্রজারঞ্জক হিসেবে মোগল সম্রাটদের সুনাম ছিল। তারা প্রজা মঙ্গলের কথা ভাবতেন। প্রদেশের শাসনকর্তা বা সুবাদারদের মনোভাবও ছিল একই ধরনের। এর ফলে মোগল যুগে বাংলার সমাজ আরও সুগঠিত ও সমৃদ্ধ হয়। শিক্ষা-সংস্কৃতি ও | অর্থনীতির ক্ষেত্রগুলোতে মানুষের উন্নতির পথ সুগম হয়। এ পর্যায়ে তাই বাঙালির সমাজজীবনে মোগল প্রভাব লক্ষ করা যায়। হিন্দু ধনী ও জমিদার শ্রেণির পোশাক-পরিচ্ছদ বিশেষভাবে পাল্টে যেতে থাকে। তাঁরা পছন্দ করতে থাকেন মোগল পোশাক। জরিদার মুক্তা বসান ঝলমলে পোশাক, সালোয়ার কামিজ শোভা পেতে থাকে এদেশের হিন্দু-মুসলমানের গায়ে। খাওয়া-দাওয়ায়ও কিছুটা পরিবর্তন আসে। বাঙালির মাছ, ভাত আর ব্যাঞ্জনের পাশাপাশি কাবাব, রেজালা, কোর্মা, আর ঘিয়ের রান্না যাবতীয় মোগলাই খাবার জায়গা করে নেয়। মোগলযুগে বাংলার ধনী এবং মধ্যবিত্ত মহিলারাও আকর্ষণীয় পোশাক পরত। কখনো কখনো তাদের বাহন ছিল পালকি। গ্রামের মানুষ সাধারণ পোশাক পরত। পায়ে ব্যবহার করত কাঠের খড়ম। সুলতানি যুগের মতো মোগল আমলের বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক মধুর ছিল। মোগলযুগের শেষ দিকে নবাব মুর্শিদ কুলী খান ও আলীবর্দী খানের সময়ে উত্তর ভারত ও মধ্য এশিয়া থেকে ব্যবসায়ী, কর্মচারী, কবি, চিকিৎসক অনেকেই এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এদের অনেকেই ছিলেন শিয়া মুসলমান। তাদের প্রভাবে বাংলার সমাজে শিয়া আচার অনুষ্ঠান প্রবেশ করে। মহররমের নানা অনুষ্ঠান এসময় জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে।
মোগল যুগে বাঙালি সমাজে সকল ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারত। তবে ইসলামের প্রভাবে অমুসলিম সমাজের একেশ্বরবাদী ধারণার প্রভাব প্রতিফলিত হয়। এর আলোকে বাংলার হিন্দু সমাজে কিছুটা পরিবর্তনের ধারা দেখা যায়। সুলতানি যুগ থেকেই শ্রী চৈতন্যের নব্য বৈষ্ণব আন্দোলনের প্রভাব হিন্দুদের সামাজিক ধর্মীয় জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল। এই প্রভাব মোগল যুগে আরও বৃদ্ধি পায়। ভক্তিবাদ ও সাম্যবাণী মানুষ গ্রহণ করতে থাকে। ফলে ব্রাহ্মণদের গোঁড়ামীর মূলে আঘাত আসে। সাধারণ হিন্দুরা গোঁড়া হিন্দুদের দেখানো ধর্মের বদলে মনসা, চণ্ডী ও শক্তির | পূজায় মনোনিবেশ করে। মোগল যুগে পারস্যের সুফিবাদের সঙ্গে বাংলার ভক্তিবাদ মিশে একটি মিশ্র সুফিবাদের সৃষ্টি করে। এভাবে বাঙালি সমাজে ফকিরি, দরবেশিয়া ও বাউল প্রভৃতি মরমী মতবাদের উৎপত্তি হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions