বাংলায় সুবাদারি শাসন
সুবাদার ইসলাম খান ১৬১০ সালে বার ভূঁইয়াদের দমন করে সমগ্র বাংলায় সুবাদারী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৬১৩ সালে ইসলাম খানের মৃত্যুর পর বেশ কয়েকজন সুবাদার বাংলার শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। তবে ১৬৬০ সালে সুবাদার মীর জুমলা ক্ষমতা গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত কোনো সুবাদারই তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন নি। এঁদের মধ্যে ১৬১৩ সাল থেকে ১৬১৭ সাল পর্যন্ত ইসলাম খান চিশতি এবং ১৬১৭ সাল থেকে ১৬২৪ সাল পর্যন্ত দিল্লির সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভাই ইব্রাহীম খান ফতেহজঙ্গ বাংলার সুবাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর খুব অল্প সময়ের জন্য সুবাদার নিযুক্ত হন দারার খান, মহব্বত খান, মুকাররম খান এবং ফিতাই খান। সম্রাট শাহজাহান মোগল সিংহাসনে আরোহন করার পর বাংলার সুবাদার হিসেবে ১৬২৮ সালে নিয়োগ দেন কাসিম খান জুয়িনিকে। সুলতানি শাসনপর্বে হুসাইন শাহী যুগ থেকে বাংলায় পর্তুগিজরা বাণিজ্য করতো। এ সময় পর্তুগিজ বণিকদের প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে যায়। ক্রমে তা বাংলার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কাশিম খান জুয়িনী শক্ত হাতে পর্তুগিজদের দমন করেন। কাসিম খানের পর সুবাদার ইসলাম খান মাসহাদি (১৯৩৫-১৬৩৯) চার বছর শাসন করেন। অতঃপর সম্রাট শাহজাহান তাঁর দ্বিতীয় পুত্র শাহসুজাকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান। সুজা কুড়ি বছর দায়িত্বে ছিলেন। মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল সুজার শাসনকাল। বিদেশি বণিকগোষ্ঠীর মধ্যে ইংরেজরা এ সময় সুবাদারের কাছ থেকে কিছু বাড়তি সুবিধা লাভ করেছিল। এতে বাণিজ্যের পাশাপাশি ইংরেজদের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ১৬৫৭ সালে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর চার পুত্রের প্রত্যেকেই মোগল সম্রাট হওয়ার জন্য বিদ্রোহ করে। এসময় আওরঙ্গজেবের সাথে শাহ সুজার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দুই ভাইয়ের যুদ্ধে ১৬৫৯ সালে শাহসুজা পরাজিত হন।
আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীরজুমলা সুজাকে দমন করার জন্য বাংলার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর (ঢাকা) পর্যন্ত এসেছিলেন। তাই সম্রাট আওরঙ্গজেব মীরজুমলাকে (১৬৬০-১৬৬৩) বাংলার সুবাদারের দায়িত্ব দেন। দক্ষ সুবাদার হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। মীরজুমলা আসাম ও কুচবিহার মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। মীরজুমলার মৃত্যুর পর প্রথমে দিলির খান ও পরে দাউদ খান অস্থায়ী সুবাদার হিসেবে বাংলা শাসন করেন। এরপর আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খানকে (১৬৬৪-১৬৮৮) বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মাঝখানে ১৬৭৮ সালে সম্রাট তাঁকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বাংলার সুবাদার হন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ ও দূরদর্শী শাসক। বাংলার জনজীবনের ওপর মারাত্মক হুমকি জলদস্যুদের বিতাড়িত করে শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম দখল করেন। তিনি ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের হাত থেকেও বাংলার মানুষদের রক্ষা করেছিলেন। সুবাদারির শেষ দিকে শায়েস্তা খানের সাথে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরোধ বাধে। ইংরেজদের ক্ষমতা এত বৃদ্ধি পেতে থাকে যে, তারা ক্ৰমে এদেশের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। দীর্ঘ দিনের চেষ্টার পর শায়েস্তা খান বাংলা সুবা থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করেন। শায়েস্তা খানের পর একে একে বাংলার সুবাদার হন খানজাহান বাহাদুর, ইব্রাহীম খান ও আজিমুদ্দিন। তাঁদের সময় বাংলার ইতিহাস তেমন ঘটনাবহুল ছিল না।
দক্ষ সুবাদার হিসেবে এবার বাংলার শাসন ক্ষমতায় আসেন মুর্শিদকুলী খান (১৭০০-১৭২৭)। প্রথমে তাঁকে বাংলার দিউয়ান পদে নিয়োগ দেয়া হয়। দিউয়ানের কাজ ছিল সুবার রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা। সম্রাট ফররুখ শিয়ারের রাজত্বকালে মুর্শিদকুলী খান বাংলার সুবাদার পদ দেয়া হয়। এদেশের রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য তিনি খ্যাতিমান হয়ে আছেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দুর্বল মোগল সম্রাটগণ দূরবর্তী সুবাগুলাের দিকে তেমন দৃষ্টি দিতে পারেন নি। ফলে এসব অঞ্চলের সুবাদারগণ অনেকটা স্বাধীনভাবে নিজেদের অঞ্চল শাসন করতে থাকেন। মুর্শিদকুলী খানও অনেকটা স্বাধীন হয়ে পরেন। তিনি নামেমাত্র সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতেন এবং সম্রাটকে বার্ষিক ১ কোটি ৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব পাঠাতেন। মুর্শিদকুলী খানের পর তার জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাংলার সিংহাসনে বসেন। এভাবে বাংলার সুবাদারী বংশগত হয়ে পরে। আর এরই পথ ধরে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন শাসন।।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions