মোগল আমলের অর্থনীতি
অর্থনৈতিক অবস্থা
মুগল যুগে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। তবে অল্প আকারে হস্ত নির্ভর কুঠির শিল্পের বিকাশও হয়েছিল। এ ছাড়া মোঘলযুগে ভারতবর্ষে ইউরোপিয় বাণিজ্যের বিকাশ শুরু হয়। মোগল যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সমকালীন ফার্সি সাহিত্য, ইউরোপিয় পর্যটকদের বিবরণী ইত্যাদি থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া বাবরনামা, হুমায়ুন নামা, আইন-ই-আকবরী গ্রন্থ থেকেও বিশেষ তথ্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে গুলবদন বেগমের হুমায়ুননামা-তে উল্লিখিত মোগল আমলের আর্থিক সচ্ছলতার প্রসঙ্গ সম্পর্কে বলা যায়।
কৃষি ও রাজস্ব নীতি
মোগল যুগে কৃষিই ছিল ভারতের জনগণের প্রধান জীবিকা ও সাম্রাজ্যের রাজস্বের প্রধান উৎস। মোগল আমলে জাবতি, গাল্লাবকস, নাসাব প্রভৃতি প্রথা অনুসারে রাজস্ব আদায় হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষকদের নিকট থেকে নির্দিষ্ট হারে নগদে রাজস্ব আদায়ের নিয়ম ছিল। আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে উৎপন্ন শস্যের তিন ভাগের এক অংশ আদায় করা হত যা পরবর্তী আমলে বাড়তে থাকে। মোগল আমলে পণ্যদ্রব্যের দাম খুব কম ছিল। আকবরের আমলে টাকায় ১৫ মন গম এবং ১০ মন চাল বিক্রি হতো। সুবাহদার শায়েস্তা খানের সময় বাংলায় টাকায় ৭/৮ মন চাল বিক্রি হতো। তাছাড়া খাদ্যদ্রব্য, শাক-সবজি, জীব-জন্তুর দামও খুব সস্তা ছিল।
জনহিতকর কার্যক্রম ও বাণিজ্য-নীতি
মোগল সম্রাটগণের পৃষ্ঠপোষকতায় এ সময় ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়। জল ও স্থল পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। মোগল সম্রাটগণ রাস্তার দুই পাশে পথিক ও বণিকদের সুবিধার্থে কূপ খনন, বৃক্ষরোপণ ও সরাইখানা নির্মাণ করেছিলেন। মোগল আমলে বিদেশ থেকে হাতির দাঁত, মূল্যবান পাথর, সুগন্ধি, সিল্ক ও রেশম আমদানি করা হতো আর ভারতবর্ষ থেকে নানা প্রকার দ্রব্যসামগ্রী যেমন সূতীবস্ত্র, মসলিন, চিনি, নীল, আফিম ইত্যাদি রপ্তানি করে প্রচুর অর্থ আয় করা হতো। সুরাট, মসলি পট্টম, বোম্বাই, চট্টগ্রাম, কালিকট প্রভৃতি মোগল আমলের বিখ্যাত বাণিজ্য বন্দর ছিল। মোগল আমলে মুদ্রার প্রচলন ছিল। তবে কিছু কিছু সুবাহতে মুদ্রার পাশাপাশি কড়ি নামক একধরনের বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে ব্যবহৃত হত।
মোগল শাসনামলে সাম্রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নে কৃষির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। জনসাধারণ প্রধানত কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। মোগল বাদশাহগণ তাদের রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি জমিতে পানি দেয়ার জন্য খাল খনন, পুরানো খাল সংস্কার প্রভৃতি কৃষি সংশ্লিষ্ট উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বাংলা-বিহারে ধান ও ইক্ষু এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে কার্পাস, পশম ও তামাক উৎপন্ন হতো। তাছাড়া গম, বার্লি, যব ইত্যাদিও প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হতো।
মোগল আমলে মানুষের আর্থিক অবস্থা
মোগল যুগে সাম্রাজ্যের ধন-সম্পদ উচ্চশ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও জনসাধারণের অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। এ সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বণিক ও ব্যবসায়ী সমন্বয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি হয়। এ আমলে রাজদরবার জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। ভারতের বিভিন্ন স্থানের শিল্পের মধ্যে সুবাহ বাঙালার মসলিন বস্ত্র বিশ্বের সর্বত্র সমাদৃত হতো।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions