মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জহিরউদ্দিন বাবর কর্তৃক ভারতবর্ষে মোগল বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে তার উত্তরসূরীরা এটিকে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যে রুপান্তরিত করে। বাবর থেকে আওরঙ্গজেব অর্থাৎ ১৫২৬ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোগল শাসন ছিল স্বর্ণযুগের শাসন। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল শাসনের পতনে প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৮৫৭ সালে শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর ইংরেজ কর্তৃক নির্বাসিত হলে মোগল শাসনের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি হয়। তাই ১৭০৭ থেকে ১৮৫৭ সময় কালকে (প্রায় দেড়শ বছর) মোগল বংশের পতনের যুগ বলা হয়। সামগ্রিকভাবে মোগল সাম্রাজ্য পতনের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বহিঃআক্রমন প্রভৃতি বিষয়কে দায়ী করা হয়:
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণসমূহ নিম্নে দেয়া হলো:
১. দুর্বল শাসন: মোগল সাম্রাজ্য আকারে এবং আয়তনে বিশাল ছিল। তাই রাজ্য শাসনের জন্য ছিল যোগ্য শাসকের প্রয়োজন। কিন্তু আওরঙ্গজেব পরবর্তী শাসকগণ ছিলেন অযোগ্য। তাই অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন এবং বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার মতো কোনো ক্ষমতা এবং যোগ্যতা তাদের ছিল না।
২. সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার নীতির অভাব: মোগল সিংহাসনে আরোহণের কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। কাজেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে মোগল যুবরাজদের নিজেদের আত্মঘাতী সংগ্রাম কেন্দ্রীয় শক্তি এবং ঐক্য নষ্ট করে। মোগল সাম্রাজ্য পতনের এটি অন্যতম প্রধান কারণ।
৩. অভিজাতদের দুর্বলতা: অভিজাত সম্প্রদায় এককালে মোগল সাম্রাজ্যের সংহতি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নিজেদের জীবনকে বাজী রেখে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। পরবর্তী কালে তারা বিলাসপ্রিয় এবং কোন্দল পরায়ণ হয়ে পড়লে সাম্রাজ্যের ভিত ও সংহতি বিনষ্ট হয়।
৪. সামরিক শক্তির দুর্বলতা: সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ও বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধে সামরিক শক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পরবর্তী মোগল শাসকদের সময়ে সামরিক শক্তি অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পায়। বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে মোগলদের বিশাল সামরিক বাহিনী গঠিত হয়েছিল। দুর্বল শাসকদের আমলে সেনাবাহিনী দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিলাসিতা ও চারিত্রিক অবনতির ফলে সেনাবাহিনীর সামরিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়। মোগলদের নৌশক্তির দুর্বলতা সাম্রাজ্যের পতন অন্যতম কারন।
৫. আর্থিক সংকট: মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল অর্থনৈতিক ও সামরিক সেনাবাহিনী পোষণে প্রচুর অর্থ ব্যয় হতো। তাছাড়া আওরঙ্গজেবের দীর্ঘদিন দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ পরিচালনা করলে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। পরবর্তী শাসকদের আমলে আয়ের পথ সংকীর্ণ হয়ে যায়। তাই আর্থিক দুরবস্থা সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
৬. আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্যে অবস্থান: আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্যে দীর্ঘ সময় অবস্থানের ফলে রাজধানী থেকে তাঁর অনুপস্থিতি কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থাকে অনেক দিক থেকে দুর্বল করে দেয়। ফলে এ সময়ে উত্তর ভারতে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় যা সাম্রাজ্যের পতনের পথ উন্মুক্ত করে।
৭. বিভিন্ন জাতির বিদ্রোহ: আওরঙ্গজেবের দুর্বল বংশধরদের রাজত্বকালে মারাঠা, শিখ, জাঠ, রাজপুতদের বিরোধিতা ও বিদ্রোহ মোগল শক্তি ও সংহতি বিনষ্ট করে।
৮. প্রাদেশিক শাসন কর্তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা: কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযোগ দূরবর্তী প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ স্ব স্ব এলাকায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর ফলে সাম্রাজ্যের সংহতি হুমকির সম্মুখিন হয়।
৯, জাতীয়তাবোধের অভাব: মোগল সম্রাটগণ ভারতবর্ষের জনগণকে কোনো একক জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন নি। তাই অভিন্ন জাতীয়তাবোধের অভাবে বিচ্ছিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখা দেয়।
১০. বিদেশি শক্তির আক্রমণ: পারস্য সম্রাট নাদিরশাহ এবং পরবর্তীকালে আফগান রাজা আহমদ শাহ আবদালীর দিল্লি আক্রমণ ও লুণ্ঠনে মোগল সাম্রাজ্য দুর্দশায় ও পতনুমুখ হয়ে পড়ে। এমনি মুমূর্ষ অবস্থায় ইংরেজ শক্তির ক্ষমতা দখল করার ফলে মোগল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়ার কারণে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙ্গুনে (বার্মা) নির্বাসিত করেন। বাহাদুর শাহের নির্বাসনের মধ্য দিয়ে ভারতে মোগল শাসনের চূড়ান্ত অবসান ঘটে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions