সিফফিনের যুদ্ধ
হযরত উসমান (রা.) এর শাসনামলে উমাইয়াগণ খলীফার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বহু সরকারী সম্পত্তি জায়গীর নিজেদের অধিকারভুক্ত করেছিলেন এবং তা ভোগ করে আসছিলেন। পরবর্তীতে হযরত আলী (রা.) খলীফা হয়ে এই সকল সরকারী সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। এতে উমাইয়া পরিবারের সকল সদস্য মুয়াবিয়া (রা.) সহ তাদের সম্পত্তির অনেকাংশ হাত ছাড়া হয়ে যায় যা ছিল তাদের জন্য ব্যাপক স্বার্থহানি। এটি ছিল তাদের মধ্যকার অন্যতম দ্বন্দ্বের কারণ।
সিফফিনের যুদ্ধ (৬৫৭ খ্রিঃ)
খলীফা হযরত আলী (রা.) এর প্রতি মুয়াবিয়া (রা.) এর আনুগত্য প্রকাশে অনীহা, উসমান (রা.) হত্যার বিচার দাবি ও সর্বোপরি মুসলিম সম্পদায়ের মধ্যে বিভক্তি ইত্যাদি কার্যকারণে মুয়াবিয়া (রা.) ও হযরত আলী (রা.) এর মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। মুয়াবিয়া (রা.) এর ধৃষ্টতা ও অবাধ্য আচরণের ফলে ৬৫৭ খ্রিঃ খলীফা একটি বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা শুরু করে। ইতিমধ্যে মুয়াবিয়া (রা.) ৬০,০০০ সৈন্য নিয়ে ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিম তীরে সিফফিন নামে স্থানে এসে শিবির স্থাপন করলেন। প্রথমে হযরত আলী (রা.) মুয়াবিয়া (রা.) কে দূত পাঠানোর মাধ্যমে ইসলামের স্বার্থে খলীফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে আহবান জানান। কিন্তু মুয়াবিয়া (রা.) তার সিদ্ধান্তে অটল রইল। তারপর খলীফা হযরত আলী (রা.) অযথা রক্তপাত এড়ানোর জন্য ব্যক্তিগতভাবে মুয়াবিয়া (রা.) কে মল্লযুদ্ধে আহবান জানালেন। কিন্তু শোর্য-বীর্যের প্রতীক, আল্লাহর বাঘ হযরত আলী (রা) সাথে মল্লযুদ্ধে মুয়াবিয়া (রা.) নিজের প্রাণক্ষয় করতে চাইলো না তাই এই প্রস্তাবও নাকচ করে দেয়া হলো। অবশেষে যুদ্ধ অনিবার্য হয়েও উঠলো। দুই পক্ষ সম্মুখযুদ্ধে পরস্পরকে মোকাবেলা করতে লাগলো। খলীফার সেনাপতি মালিক আল আসতার এর অপূর্ব রণকৌশলে মুয়াবিয়া (রা.) এর বাহিনী ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিবসে মুয়াবিয়া (রা.) তাঁর সেনাবাহিনীর নিশ্চিত পরাজয় দেখতে পেলেন।
যুদ্ধে মুয়াবিয়া (রা.) এর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী দেখা দিলো। তাই মুয়াবিয়া (রা.) তার প্রধান সেনাপতি ও উপদেষ্টা, শ্রেষ্ঠ কূটনৈতিক আমর ইবন আল-আস (রা.) এর পরামর্শ গ্রহণ করলেন। আমর (রা.) মুয়াবিয়া (রা.) কে যুদ্ধের পরাজয় হতে ফিরে আসার জন্য এক অভিনব কৌশল অবলম্বনের উপদেশ দিলেন।
আমরের পরামর্শে মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী অংশ তাদের পতাকাশীর্ষে ও বর্শার অগ্রভাগে কুরআন শরীফের পবিত্র পাতা ঝুলিয়ে চিৎকার করে বিরোধীদলীয় সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, “ এখানে আল্লাহর কিতাব - এটি আমাদের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করবে।” নিঃসন্দেহে এটি ছিল একটি অভিনব কৌশল। হযরত আলী সেনা বাহিনীর প্রায় সম্মুখভাগের প্রায় সকলেই ছিলেন কুরআনে হাফি। তাঁরা কুরআনকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে যুদ্ধ বন্ধ করেন এবং হযরত আলী (রা.) কে কুরআনের মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য সকলকে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানান। এই ব্যবস্থা ছিল। একটি দূরদর্শী চিন্তার ফসল যা যুদ্ধের মোড়-পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছিল।
হযরত আলী (রা.) মুয়াবিয়া (রা.) এর এই কূটনৈতিক চালকে বুঝতে সক্ষম হন। তিনি এই যুদ্ধ বন্ধ করতে কোনভাবেই ইচ্ছুক ছিলেন না। কারণ যুদ্ধে তাঁর জয় ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। তার সেনাপতি মালিক আল-আসতারও যুদ্ধ স্থগিত করতে আগ্রহী হলেন না। এমন অবস্থায় হযরত আলী (রা.) এর সেনাবাহিনীর একাংশ হযরত আলী (রা.) কে যুদ্ধ বন্ধের জন্য বার বার অনুরোধ করতে থাকেন এবং একটি সালিশের মাধ্যমে এই সংকটের নিষ্পত্তি কামনা করেন। অবশেষে সকলের একান্ত ইচ্ছা ও চাপে পড়ে হযরত আলী (রা.) যুদ্ধ স্থগিত করেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions