Home » » জাহেলিয়া যুগে আরবের সাংস্কৃতিক অবস্থা

জাহেলিয়া যুগে আরবের সাংস্কৃতিক অবস্থা

জাহেলিয়া যুগে আরবের সাংস্কৃতিক  অবস্থা

প্রাক্ ইসলাম যুগে আরবে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষপদ্ধতি অথবা সুরুচিপূর্ণ মার্জিত জীবনধারা গড়ে ওঠেনি। মক্কা, মদিনা ও অন্যান্য কয়েকটি বর্ধিষ্ণু শহরের অধিবাসীরা ব্যতীত আরবের অধিকাংশ লোকই মূর্খ ও নিরক্ষর ছিল। এতদ্সত্ত্বেও অসাধারণ স্মৃতিশক্তিবলে তারা ইসলামপূর্ব যুগের প্রচুর লোকগাথা, প্রবাদ, লোকশ্রুতি সংরক্ষণে সক্ষম হয়। তাদের সাধারণত তিনভাগে ভাগ করা যায়। খতিব (বক্তা), শায়ির (কবি) এবং নাস্সাব (বিভিন্ন গোত্রের বংশ পরিচয় বা কুলজী বিশারদ।) 

প্রবাদ বাক্য : 

প্রবাদ বাক্য ছিল আরব সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান দিক। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের বাস্তব জ্ঞানের পরিস্ফুটন ঘটেছিল এ সকল প্রবাদ বাক্যের মাধ্যমে। প্রবাদ ও গদ্য রচনা গীতিকাব্যের তুলনায় যদিও অপ্রতুল ছিল, তা সত্ত্বেও বিখ্যাত পণ্ডিত আল হাকিমের (লোকমান) রচনায় আরবি প্রবাদ বাক্য সংগৃহীত ও সংরক্ষিত হয়েছিল। সে সময় বহু বিদিত আরবি প্রবাদ ছিল- “সৌন্দর্য তার জিহবার বাচনশীলতার মধ্যে নিহিত।” বুদ্ধিমত্তা তিনটি বস্তুর ওপর আপতিত হয়েছে“ফরাসিদের মগজে, চীনাদের হস্তে ও আরবদের জিহবায়”। 

গীতিকাব্য ও বিষয়বস্তু : 

আরব সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন আরবি গীতিকাব্য বা কাসিদা সমসাময়িক সাহিত্যের ইতিহাসে অতুলনীয় সম্পদ। বংশ গৌরব, বীরত্বপূর্ণ কাহিনী, যুগের বিবরণ, যুদ্ধের ঘটনা, উটের বিস্ময়কর গুণাবলি, প্রতিপক্ষের লোকদের বদনামসূচক তীরবিদ্ধ কথামালা ছাড়াও নারী, নারীর সৌন্দর্য, প্রেম, যৌনজীবন সম্পর্কিত নগ্ন কথামালা, নারী-দেহের সৌন্দর্যের বর্ণনা, যুদ্ধের বিবরণ, রণসংগীত, ব্যঙ্গোক্তি, বংশগৌরব সম্পর্কিত গীতিকাব্য রচনা করা হতো। আরবরা যে নির্ভীক বীর, অতিথিপরায়ণ, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল এবং কাপুরুষের মতো মৃত্যুভয়ে ভীত ছিল না, সে সম্বন্ধে আমরা তাদের কবিতা থেকেই অবগত হতে পারি। 

কবি ও তাদের মর্যাদা : 

আরব কবি ও পণ্ডিতদের মধ্যে ইমরুল কায়েস, তেরফা বিন আবদ, আনতারা বিন শাদ্দাদ, আমর বিন কুলসুম, হারেস, লবিদ বিন রবিয়া, কাব বিন যুহায়র প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রত্যেক গোত্রেরই আলাদা কবি থাকতেন। এ গোত্রীয় কবি ছিলেন গোত্রের মর্যাদার প্রতীক। সকলে তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত। সমাজে কবিদের অতিমানবের মর্যাদা দেয়া হতো। তাদের কবিতায় উচ্চমানের সাহিত্য অলঙ্কার নিহিত ছিল। 

বিনোদন :

জাহিলী যুগে আরবরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে বিনোদনমূলক কর্মে অংশগ্রহণ করতো। উট ও । ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতা আরবদের নিকট খুবই প্রিয় ছিল। 

গদ্য সাহিত্য রচনা :

লিখন পদ্ধতির বিকাশের অভাবে জাহিলী যুগের আরবে গদ্যসাহিত্য রচনায় সমৃদ্ধি লাভ করেনি। তবে বংশ বৃত্তান্ত, গোত্রীয়। কলহ ও যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস সংবলিত কিছু গদ্য সাহিত্য রচিত হয়েছিল। কাব্যগাথার মাধ্যমে প্রাচীনকাল থেকে আরবরা। নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতো। ইতিহাস চেতনা তাদের মধ্যে এতই তীব্র ছিল যে, পরবর্তীতে ইসলামের ইতিহাস কিংবা বিশ্ব ইতিহাস রচনা তাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই সূচিত হয়েছিল।

উকায় মেলা : 

জাহিলিয়া যুগে প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ে মক্কার অদূরে উকায নামক স্থানে একটি বাৎসরিক মেলা বসত। এখানে খ্যাতনামা আরব কবিদের মধ্যে কবিতা পাঠের আসর বসত। এখানে বিভিন্ন বিষয় যেমন- কাব্যগাথা, বীরত্ব ও বাগ্মিতার। প্রতিযোগিতা হতো এবং শ্রেষ্ঠদের পুরস্কৃত করা হতো। এখানে গান বাজনা, নৃত্য প্রভৃতিও অনুষ্ঠিত হতো। অধ্যাপক পি.কে.হিট্টি এটিকে ‘Ukaz fair was the Academic franchise of the Arabs- বলে অভিহিত করেন।

সাবয়া’ মুয়াল্লাকা : 

আরবের ওকায মেলায় সাহিত্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেরা কবিতা নির্বাচন করা হতো। প্রতি বছরের নির্বাচিত সেরা কবিতাটি কাবাগৃহের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হতো। মুয়াল্লাকা' অর্থ- ঝুলন্ত। এ ঝুলানোর কারণে এ কবিতাগুলোর নাম ‘মুয়াল্লাকা হয়েছে। এরকম সাতটি কবিতা বা ‘সাবয়া মুয়াল্লাকা’ সাহিত্যজগতে এক অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচিত হয়ে । আসছে। এছাড়াও দিওয়ানে হামাসা, কিতাবুল আগানী ও আল মুফাযিলাত বিশেষ উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। 

জাহিলিয়া যুগে আরবদের প্রশংসনীয় দিকসমূহ : 

জাহিলিয়া যুগে আরবের কয়েকটি গোত্র ছাড়া প্রায় সকল স্থানের আরবগণই ছিল অশিক্ষিত ও সভ্যতা বিবর্জিত। তাদের জীবন ছিল বন্য প্রাণীয় মতো বর্বরতায় পূর্ণ। তবে তাদের জীবনে কিছু কিছু প্রশংসনীয় দিক ছিল যার বিবরণ নিম্নরূপজাহিলী যুগের আরবগণ ছিল কষ্টসহিষ্ণু, নির্ভীক ও চির সংগ্রামী। মুরুময় রুক্ষ আরবে জীবনযাপন উপযোগী খাদ্য ও পানীয়ের বড় অভাব ছিল। বাঁচার জন্য তারা প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতো। আরবগণ ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ। ক্ষুধার্তকে অন্নদান, আশ্রয় প্রার্থীকে আশ্রয়দান এবং অত্যাচারিতকে রক্ষা করা তারা তাদের কর্তব্য বলে মনে করতো। আশ্রিত ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য তারা নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিত। পরবর্তীকালে তাদের এ গুণাবলিকে লালন করার জন্য মহানবী (সা.) বলেন, “অন্ধকার যুগের আদর্শ গুণাবলির প্রতি লক্ষ কর এবং সেগুলোকে ইসলামের কাজে লাগাও। অতিথিকে আশ্রয় দাও, এতিম শিশুর প্রতি সদয় হও এবং আশ্রিতদের সাথে সদয় ব্যবহার কর।” জাহিলিয়া যুগের আরবগণের একটি প্রশংসনীয় গুণ ছিল অতিথিপরায়ণতা। অতিথির থাকা খাওয়া এবং মর্যাদা রক্ষার জন্য তারা সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হতো না। 

জাহিলিয়া যুগে আরবগণ কবিতা রচনা ও বক্তৃতায় বিশেষ পারদর্শী ছিল। কবিতার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য প্রতিভা প্রকাশ পেত। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, “কাব্যপ্রীতিই ছিল বেদুইনদের সাংস্কৃতিক সম্পদ।” তাদের কবিতাগুলো ‘কাসিদা' নামে খ্যাত ছিল। তিনি আরাে বলেন, “এ কাসিদাগুলো ছন্দ এবং বিশদ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ‘ইলিয়ড’ ও ‘ওডিসি’কেও অতিক্রম করেছিল।”

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *