ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার আন্দোলন
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১ খ্রি.)
বিদ্যাসাগর উপাধিতে সমধিক পরিচিত হলেও এই ক্ষণজন্মা পুরুষের প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন বাঙালি নবজাগরণের একজন পুরাধা ব্যক্তিত্ব। বিদ্যাসাগর ছিলেন একাধারে দার্শনিক, শিক্ষানুরাগী, শিক্ষক, লেখক, অনুবাদক, মুদ্রাকর, প্রকাশক, সমাজ সংস্কারক এবং ব্যাকরণবিদ। তিনি সহজবোধ্য আধুনিক বাংলা গদ্য রচনার পথপ্রদর্শক ছিলেন। কোলকাতার সংস্কৃত কলেজ পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত করে। ১৮৪৬ সালে সংস্কৃত কলেজে সহকারী সেক্রেটারি পদে যোগদান করেন। ঈশ্বরচন্দ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশকিছু পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেন। ১৮৪৯ সালে ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। একই কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব লাভ করেন ১৮৫১ সালে। ১৮৫৫ সালে তিনি বিশেষ স্কুল পরিদর্শকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। সমাজ সংস্কারে ভূমিকা: দীর্ঘদিন থেকে প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে এসময় ভারতীয় নারীরা দুর্দশাগ্রস্ত ছিলেন। এই অবস্থা ব্যাথিত করেছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। বিশেষ করে হিন্দু মেয়েদের বাল্যবিয়ে প্রচলিত থাকা এবং বিধবা বিয়ে নিষিদ্ধ থাকাকে তিনি অন্যায় ও অমানবিক মনে করেছিলেন। সামাজিক প্রথামতে কোনো মেয়ের বারো বছরের মধ্যে বিয়ে না হলে তা সামাজিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। এমন পরিবারকে নানাভাবে নিগৃহীত হতে হতো। কখনো কখনো পুরো পরিবারকে গ্রাম ছাড়া করা হতো। আবার ব্রাহ্মণ কন্যাকে কুলিন ব্রাহ্মণ ছাড়া বিয়ে দেয়া যাবে না বলে সমাজ বিধান ছিল। ফলে এক ধরনের কুলিন ব্রাহ্মণের বিয়ে করা পেশা হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক চাপে পড়ে সাত বছরের কন্যার সাথে সত্তর বছরের কুলিন ব্রাহ্মণ বৃদ্ধের বিয়ে হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। স্বাভাবিক নিয়মেই এই বৃদ্ধদের বা অন্য বয়সী বরদের মৃত্যু হলে বালিকা বধূ বিধবা হয়ে যেত। কিন্তু এদের আর পুনরায় বিয়ে করার অনুমতি ছিল না। উপরন্তু এই বাল্য বিধবাদের সারাজীবন নানা আচার অনুষ্ঠান পালন করে চলতে হতো। বাল্যবিয়ের কুফল এবং বিধবাদের করুণ জীবন ঈশ্বরচন্দ্রকে ব্যাথিত করে।
ঈশ্বরচন্দ্রের চেষ্টায় ভারত সরকার এগিয়ে আসে। অবশেষে ১৮৫৬ সালে বিধবা পুনর্বিবাহ আইন পাশ হয়। সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য বিদ্যাসাগর নিজের পুত্রকেও একজন বিধবার সাথে বিয়ে দেন। বিধবা বিয়ে কার্যকর করা, দ্বিতীয় বিয়ে ও বাল্যবিয়ে রোহিতকরণ এং বিধবা বিয়েকে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে ১৮৭২ সালে সিভিল ম্যারেজ এ্যাক্ট পাশ করা হয়। এই আইন পাশেও বিদ্যাসাগরের যথেষ্ট অনুপ্রেরণা ছিল।
বিদ্যাসাগর বিশেষ স্কুল পরিদর্শক থাকার সুবিধায় শিক্ষা বিস্তার ও নারী শিক্ষার প্রণোদনা দানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বিদ্যালয় গড়ায় উৎসাহ দিতেন। তিনি অনেক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি নিজ অর্থ ব্যয়ে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষা বিস্তারে এই প্রতিষ্ঠানের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই এই মহৎপ্রাণ সমাজ সংস্কারক ও পণ্ডিত ব্যক্তির জীবন অবসান ঘটে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions