Home » » জাহেলিয়া যুগের রাজনৈতিক অবস্থা

জাহেলিয়া যুগের রাজনৈতিক অবস্থা

জাহেলিয়া যুগের রাজনৈতিক অবস্থা

প্রাক ইসলাম যুগে আরবের রাজনৈতিক অবস্থাও ছিল চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলায় ভরপুর। না ছিল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা, না ছিল কোনো সংবিধান। মনগড়া মতবাদের ছায়ায় আদিম যুগের বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ গোত্রীয় শাসনব্যবস্থা হচ্ছিল। ঐতিহাসিক হার্বাট মুলারের ভাষায়- In Mohammad's Arabia there was no state here were only scattered independent tribes and towns. 

সাম্রাজ্যবাদের শিকার 

কোনো কেন্দ্রীয় শাসকের নিয়ন্ত্রণে না থাকায় তৎকালীন আরব সাম্রাজ্যবাদী দু’পরাশক্তি রোমান ও পারস্যের লোলুপ দৃষ্টির শিকার ছিল। উত্তর আরব রোমানদের এবং দক্ষিণ আরব পারসিকদের কর্তৃত্ব বলয়ে ছিল। আবিসিনীয় আগ্রাসনভীতিও আরবকে সর্বদা শঙ্কিত রাখত। ইয়েমেন জবরদখলকারী আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান শাসক আবরাহার ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে কাবাঘর আক্রমণ করতে আসার ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তবে উত্তর ও দক্ষিণ আরব ব্যতীত সমগ্র আরবদেশই স্বাধীন ভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল। 

গোত্ৰতান্ত্রিক ব্যবস্থা : 

মহানবী (সা.)-এর যুগে আরবের রাজনৈতিক অঙ্গনে কেন্দ্রীয় সরকারের অভাবে গোত্ৰতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। আরবরা ছিল বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। আরবিতে গোত্রকে ‘কাবিলা' বলা হয়। প্রতিটি গোত্র বংশ  হিসেবে ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত ছিল। গোত্রের বিভক্ত অংশগুলোকে একত্রে কাওম বলা হতো। কখনো কখনো কতিপয় গোত্র  মিলে সহাবস্থানের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পাদন করতো। এসব চুক্তিকে ‘আল আহনাফ বা মৈত্রী চুক্তি বলা হতো। আরবদের সমাজ জীবনে গোত্রই ছিল একমাত্র নিরাপত্তার চাবিকাঠি। এজন্য গোত্রভুক্ত হয়ে বসবাস করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। স্বগোত্রীয় সদস্যদের প্রতি তারা যেমন সহানুভূতিশীল ও বন্ধুভাবপন্ন ছিল, তেমনি শত্ৰু গোত্রের প্রতি তারা চরম শত্রুতা পোষণ করতো। 

নেতা নির্বাচন পদ্ধতি : 

আরবের গোত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় নেতা ছিলেন গোত্রীয় প্রধান। প্রত্যেক গোত্রে শায়খ নামে একজন দলপতি ছিলেন। বয়স, বিচার বুদ্ধি, সাহস, আর্থিক অবস্থা, অভিজ্ঞতা যাচাই বাছাই করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শেখ নির্বাচিত হতেন, আবার নির্বাচনের মাধ্যমেই শায়খ পরিবর্তন করা হতো। এজন্য তার মেয়াদকাল সম্পূর্ণরূপে নির্বাচকমণ্ডলীর সন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল ছিল। আরবদের শেখের প্রতি আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। শায়খ-এর যে কোনো নির্দেশ পালনে তারা জীবনপণ প্রচেষ্টা চালাতো।

গোত্রীয় কলহ ও যুদ্ধ : 

প্রাকইসলাম যুগে ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে গোত্রীয় কলহের সূত্রপাত হতো। এ কলহের ধারাবাহিকতা। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে বংশানুক্রমে চলতো। যেমন বনু বকরের সাথে বনু তাগলিবের যুদ্ধ চল্লিশ বছর স্থায়ী হয়েছিল। মদিনার আউস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে জঙ্গে বুয়াস এবং কুরাইশ ও হাওয়াযিন গোত্রের মধ্যে হারবে ফিজার দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়েছিল। লাগাতার যুদ্ধবিগ্রহের এ সময়কে আরবদের ইতিহাসে ‘আইয়ামে হারব’ বলা হয়েছে। সামান্য কারণে, যেমন পানির নহর ব্যবহার, জীবজন্তুর তৃণলতা ভক্ষণ, গবাদি পশু পালন প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করে এক গোত্র অপর গোত্রের সাথে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো। 

রাজনৈতিক ঐক্য ও স্থিতিশীলতার অভাব : 

প্রাক ইসলামী যুগে আরবদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য বলতে কিছুই ছিল না। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা ছিল তাদের নিত্য সঙ্গী। ঐতিহাসিক ওয়েল হাউসেন বলেন- Their political life was in a thoroughly primitive level. এজন্যই তাদের রাজনৈতিক সচেতনতাবোধ মোটেই ছিল না। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, স্থিতিশীলতার অভাবে তখন তাদের প্রশাসন পদ্ধতি খুব সহজে পরিবর্তন হয়ে যেত। সারা বছর ধরেই সবাইকে মানসিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকতে হতো।

মন্ত্রণা পরিষদ : 

তৎকালীন মক্কায় ‘আল-মালা' নামে একটি মন্ত্রণা পরিষদ গড়ে ওঠে। এ পরিষদ মক্কা এবং শহরতলীর শাসনব্যবস্থা তদারক করতো। বেদুইনদের মতো মৈত্রী জোট গঠন, বৈদেশিক বাণিজ্যক ও সামরিক চুক্তি সম্পাদনেও মন্ত্রণা পরিষদ সক্রিয় ভূমিকা রাখতো।

সংবিধানের অভাব : 

সংবিধান যে কোনো রাষ্ট্র বা সংস্থা সংগঠনের চালিকাশক্তি। নিয়মতান্ত্রিক কোনো দেশ বা সংগঠন  গঠনতন্ত্র বা সংবিধান ছাড়া চলতে পারে না। জাহিলী যুগের আরবদের দেশ পরিচালনার উপযোগী কোনো সংবিধান ছিল না বলে তারা সুষ্ঠু কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারত না।

জোর যার মুল্লুক তার নীতি :  

জাহিলী যুগের আরবদের মূলনীতি ছিল জোর যার মুল্লুক তার। সন্ত্রাসবাদ, সহিষ্ণুতা, গোত্রীয় যুদ্ধ ইত্যাদি পন্থায় আরবরা একে অপরের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতো।

জঙ্গে বাসুস :

প্রাকইসলাম যুগের আরবে সংঘটিত প্রসিদ্ধ যুদ্ধসমূহের মধ্যে বাসুসের যুদ্ধ অন্যতম। আরবের বনু বকর ও বনু তাগলিবের মধ্যে সংঘটিত এ যুদ্ধ ৪৯৪ থেকে ৫৩৪ সাল পর্যন্ত মোট ৪০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এ যুদ্ধে প্রায় ৭০  হাজার লোক নিহত হয়েছিল। উভয় গোত্রই পরস্পর আত্মীয় ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছিল। উভয়ই নিজেদের ওযায়েরের  বংশধর বলে দাবি করতো। একটি উষ্ট্রী জখম হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাসুস যুদ্ধের সূচনা হয়। উষ্ট্রীটির নাম ছিল বাসুস। এটির মালিক ছিলেন বনু বকর গোত্রের হাসসাম নামক এক ব্যক্তি। উষ্ট্ৰীটি বনু তাগলিবের কোনো এক ব্যক্তি হাতে আহত হয়েছিল।

জঙ্গে দাহিস :

ইসলামপূর্ব যুগের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধজনিত সংঘাতসমূহের মধ্যে জঙ্গে দাহিস অন্যতম প্রসিদ্ধ যুদ্ধ। এ যুদ্ধ  গাফান গোত্রের দুটি শাখা বনু আবস ও বনু যুবিয়ানের মধ্যে ৫৬৮ থেকে ৬৩১ সাল পর্যন্ত মোট ৬৩ বছর স্থায়ী হয়েছিল।  এ যুদ্ধে অনেক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ নেই। এ যুদ্ধে আরব বীর আন্তারা বিন শাদ্দাদ তার বীরত্ব ও কবিত্বের অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন।  

গোত্রীয় জোট : 

পবিত্র নগরী মক্কায় অবস্থিত কাবা শরীফের কারণে মক্কা নগরী ও নগরবাসী কুরাইশদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ কারণে কুরাইশ গোত্রের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা এবং পার্শ্ববর্তী আরো কতিপয় গোত্রের মধ্যে একটি মৈত্রীজোট বা গোত্র-সংঘ রূপ লাভ করে। এ জোটের নেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী একটি আন্তঃগোত্রীয় শাসনব্যবস্থাও গড়ে ওঠে। 

মক্কার নগর রাষ্ট্রের মর্যাদা : 

আরবে কোনো কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা কিংবা সংগঠিত কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন না থাকলেও ধর্মীয় এবং বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে মক্কায় অগ্রসর রাজনীতি ও নগর রাষ্ট্রের উন্মেষ হয়েছিল। মক্কা নগর রাষ্ট্র পরিচালনার মূলে ছিল কুরাইশ গোত্রপতিদের সমন্বয়ে গঠিত ‘মালা’ বা মন্ত্রণাপরিষদ। এ পরিষদ মক্কা নগর রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থা তদারক করতো। এছাড়াও বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বেদুইনদের সাথে মৈত্ৰীজোট গঠন করাও এ পরিষদের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

মক্কার প্রশাসনিক ব্যবস্থা : 

কুরাইশদের একজন পূর্বপুরুষ ‘কুসাই' ৪৮০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর প্রাক্কালে স্বীয় পুত্র আবদুদ দারকে অলী নির্বাচন করেন। তিনি তৎকালীন মক্কার শাসনব্যবস্থা পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেন। যথা: ১. হিজাবা : কাবা ঘর আবৃতকরণ। ২. সিকায়া: যম্ম্ কূপ থেকে হাজীদের পানি বিতরণ। ৩. রিফাদা: হজ্জ পালনকারী লোকদের পবিত্র নগরীতে সাদর সম্ভাষণ জানানো। ৪. নাদওয়া: কার্যকরী কমিটির সদস্যপদ। ৫. লিওয়া: পতাকা উত্তোলন করা। 

দারুন নাদওয়া :

কুসাই কাবাঘর সংস্কার ও মন্ত্রণাপরিষদ বিভক্তকরণের পাশাপাশি কাবাঘরের পাশে আরেকটি প্রাসাদ  নির্মাণ করেছিলেন, যার নামকরণ করা হয় দারুন নদওয়া বা মন্ত্রণাপরিষদ। দারুন্ নাওয়ায় বসে নগরের অভিজাতবর্গ যে কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন, কিন্তু নগর ও কাবাঘর বিষয়ক কার্যক্রম, যেগুলোর সাথে সর্বসাধারণের সংশ্লিষ্টতা ছিল, সেগুলোর জন্য সকল নাগরিক কাবা প্রাঙ্গনে সাধারণ সভা করে সিদ্ধান্ত নিতেন।

শেষে বলা যায়, আরব সমাজের মূলভিত্তি ছিল গোত্রপ্রথা। একই গোত্রের মধ্যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলে কেউ অপরাধীকে সাহায্য করতো না, কিন্তু অপর কোনো গোত্র যদি কারো নিজ গোত্রের কাউকে হত্যা করতো, তাহলে সমগ্র গোত্রের সক্ষম ব্যক্তিরা হত্যার প্রতিশােধ গ্রহনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ত। এক্ষেত্রে রক্তের পরিবর্তে রক্তের দাবি জানানো হতো। যাযাবর আরব  গোত্রপ্রধানদের শায়খ বলে অভিহিত করা হতো। গোত্রকেন্দ্রিক মরুবাসী বেদুইনদের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য ‘আসাবিয়াহ' বা গোত্র প্রীতি। গোত্রপ্রীতি ও রক্ত সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই এ কওম চেতনা পরবর্তীকালে আরব জাতি গঠন এবং ইসলামের বিস্তৃতিতে সহায়ক হয়েছিল। 

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *