সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল কেন / সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিপ্লব মূলত এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে ব্যর্থ হয়। এ বিপ্লবের পেছনে কোনো পূর্ব পরিকল্পনা না থাকায় ঐক্যবদ্ধ কোনো কর্মপন্থা বা সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় নি। দুর্বল নেতৃত্ব, আঞ্চলিক ও বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ, উপযুক্ত সাংগঠনিক শক্তির অভাব, নিম্নমানের সমরাস্ত্র ও দুর্বল রণকৌশল বিদ্রোহীদের পরাজয়কে অবধারিত করে তোলে। অন্যদিকে ইংরেজদের দক্ষ নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা এবং উন্নত সামরিক শক্তি তাদের গলায় বিজয়ের মুকুট পরিয়ে দেয়।
সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার কারণসমূহ নিম্নে দেয়া হলো:
পূর্বপরিকল্পনার অভাব
এই বিপ্লব পূর্বপরিকল্পিত ছিল না এবং কোনো রকম পরিকল্পনা অনুসারে কার্যকরীও হয় নি - বিদ্রোহীদের কোনো নির্দিষ্ট কর্মপন্থাও ছিল না। বিভিন্ন স্থানে নেতৃবৃন্দ বিচ্ছিন্নভাবে এই বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। উপযুক্ত যোগাযোগ বা সংহতি তাঁদের মধ্যে ছিল না। ফলে একই সময়ে সকল জায়গায় অভ্যুত্থান যেমন ঘটে নি, তেমনি সর্বত্র একই পদক্ষেপ বা কর্মপন্থা | অনুসরণ করা সম্ভব হয় নি। অপরদিকে বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী নেতাদের মধ্যে আদর্শ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থাকায় সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণে তাঁরা ব্যর্থ হয়। নানা সাহেবের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পেশোয়া পদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ যাকে বিদ্রোহীরা নেতা নির্বাচন করে, তার উদ্দেশ্য ছিল মোগল সম্রাটের হারানো শক্তির পুনরুদ্ধার করা। উভয়ের উদ্দেশ্য স্পষ্টতই ছিল পরস্পর বিরোধী। আঁসীর রাণী লক্ষীবাঈও নিজের হারানো রাজ্য ফিরে পাবার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছিলেন।
সংঘবদ্ধতার অভাব
এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার অন্যতম কারণ ছিল এতে দেশের সকল শ্রেণির মানুষ যোগ দেয় নি। তা ছাড়া বিদ্রোহীদের প্রতি অনেকের সমর্থনও ছিল না। যদিও কয়েকটি অঞ্চলে বিদ্রোহ প্রকট আকার ধারণ করেছিল, তথাপি তা ছিল সীমাবদ্ধ প্রকৃতির। উত্তর প্রদেশ, অযোধ্যা, রোহিলাখণ্ড এবং বাংলা ও বিহারের পশ্চিমাঞ্চলেই বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ থাকে। দক্ষিণ ভারতের বিশাল এলাকায় এর বিস্তৃতি ঘটে নি। ভারতবর্ষের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং দেশীয় রাজণ্যবর্গের বড় অংশ এই বিদ্রোহ থেকে নিজেদের দূরে রাখে।
অন্যদিকে দেশীয় নৃপতিদের অনেকেই সক্রিয়ভাবে বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে। হায়দ্রাবাদের নিজাম, কাশ্মীরের মহারাজা এবং মারাঠা অধিপতি সিন্ধিয়ার ভূমিকা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্যযোগ্য। লর্ড ক্যানিং এ সময় বলেছিলেন যে, যদি মারাঠা নেতা সিন্ধিয়া এই বিদ্রোহে যোগ দেয় তাহলে ইংরেজকে ভারত ছেড়ে চলে যেতে হবে। এটা বললে অতিশয়োক্তি হবে না যে, কাশ্মীরের মহারাজার করুণার উপর তখন পাঞ্জাবে ইংরেজদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল ছিল। বিপ্লবের সময়ে ভারতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা অর্থাৎ শিখ ও গুর্খা বাহিনী এবং কিছু সংখ্যক রাজপুত যোদ্ধা সিপাহীদের পক্ষ না নিয়ে বরং ইংরেজদের সাহায্যে এগিয়ে যায়।
দক্ষ নেতৃত্বের অভাব
বিদ্রোহীদের মধ্যে সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব ছিল। নেতাদের অধিকাংশই বিদ্রোহের যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হন। ঝাঁসির রাণি, নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপী, কুনওয়ার সিং প্রমুখ নেতৃবৃন্দ স্ব-স্ব এলাকায় সুযোগ্য নেতৃত্বের পরিচয় দিলেও ব্যাপক বিদ্রোহের সার্বিক নেতৃত্বদানের ক্ষমতা তাঁদের কারও ছিল না। তা ছাড়া কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বা কেন্দ্রীয় সংগঠনের মাধ্যমে এ বিদ্রোহ সংঘটিত হয় নি। ফলে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত চেষ্টাগুলো সহজেই ইংরেজদের পক্ষে দমন করা সম্ভব হয়েছিল।
ইংরেজদের সামরিক শক্তি
ইংরেজদের সামরিক সংগঠন ও রণকৌশল তাদের প্রতিপক্ষের চেয়ে উন্নততর ছিল। তাদের অস্ত্রশস্ত্রও ছিল আধুনিক ও উন্নত ধরনের। বিদ্রোহী নেতৃবৃন্দের তুলনায় ইংরেজ সেনাপতিরা ছিলেন অধিক দক্ষ, সাহসী ও রণকৌশলী যোদ্ধা। লরেন্স, আউটরাম বা নিকলসনের মতাে নির্ভিক ও সমরকুশলী বিদ্রোহীদের মধ্যে কেউই ছিলেন না।
বিদ্রোহীদের প্রয়োজনীয় শক্তির অভাব
যুদ্ধাস্ত্র এবং শক্তির দিক থেকেও বিদ্রোহীরা দুর্বল ছিল। তাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল গাদা বন্দুক। বিপরীতে ইংরেজ বাহিনী ছিল আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত ও উন্নত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। রেলপথে দ্রুত সৈন্য প্রেরণ, টেলিগ্রাফের সাহায্যে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় বার্তা পৌঁছানো ইত্যাদি ব্যবস্থা বিদ্রোহ দমনে তাদের প্রভূত সাহায্য করে। তদুপরি বৃটিশ নৌবাহিনী পারস্য ও মালয় থেকে প্রয়োজনীয় সৈন্য ও গােলাবারুদ এনে স্বপক্ষের শক্তি বৃদ্ধি করে। ফলে দেশীয় সিপাহীরা তাদের সঙ্গে দীর্ঘকালব্যাপী সংঘর্ষ চালাতে ব্যর্থ হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions