রোমান সভ্যতা
ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে- 'Rome was not build in a day'। এই প্রবাদ বাক্যটি রোমান সভ্যতার ক্ষেত্রে এমনিতেই স্থান পায়নি। কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন, উদ্ভাবন-ধ্বংসের পথ পাড়ি দিয়েই গড়ে উঠেছিল রোমান সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় ও প্রথম শতকে রোমানরা গ্রিক সাম্রাজ্য দখল করে। রোমানরা ইতালি ও ইতালির পশ্চিম দিকে অবস্থিত ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশগুলো জয় করে। লাতিনদের একটি ক্ষুদ্র জাতি থেকে সুবিশাল সাম্রাজ্যের বিকাশ হয়, মধ্য ইটালির ল্যাটিয়ামে রোম ছিল তাদের প্রধান শহর।
রোমান সভ্যতার উৎ গ্রিক সভ্যতার সমসাময়িক রোমান সভ্যতা হেলেনিক ও হেলেনিস্টিক সভ্যতার অনেক সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে। ঐতিহাসিকদের। ধারণা, ৭৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা রোমুলাস এর নামানুসারে রোম নগরীর নামকরণ করা হয়। টাইবার নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন রোমানগরীকে ‘বিশ্বের রাজধানী' বলা হয়। কারণ রোম নগরীর সঙ্গে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া-এই তিনটি মহাদেশের বিস্তৃত যোগাযোগ ছিল। রোমীয় সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলসহ উত্তরে ব্রিটেন, জার্মানী; পূর্বে মেসোপটেমিয়া এবং দক্ষিণে মিসর ও লিবিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
রোমান সভ্যতার ইতিহাস
ঐতিহাসিকগণ রোমান সভ্যতার ইতিহাসকে কয়েকটি পর্বে বিভক্ত করেন। (ক) রাজতন্ত্র যুগ (৭৫৩-৫১০ খ্রিস্টপূর্ব), (খ) প্রজাতন্ত্র যুগ (৫১০-৬০ খ্রিস্টপূর্ব), (গ) প্রথম কনসুলেট যুগ (৬০-৩১ খ্রিস্টপূর্ব), (ঘ) সম্রাট অক্টাভিয়ান অগাস্টান যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৩১-১৪) (ঙ) অগাস্টান পরবর্তী রোমান সাম্রাজ্য (১৪-৪৭৫ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত।
রোমান সভ্যতায় অগাস্টান যুগ
জুলিয়াস সিজারসহ (সিজার রোমান সম্রাটদের উপাধি) অনেক বিখ্যাত শাসক রোমীয় সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। কিন্তু সম্রাট অক্টাভিয়ান অগাস্টাস (খ্রিস্টপূর্ব ৩১-১৪ খ্রিস্টাব্দ) রোমের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত শাসক ছিলেন। তাঁর শাসনামলে রোমীয় সভ্যতায় স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। তিনি একজন বিচক্ষণ রাজনীতিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক ছিলেন। তাঁর সময়ে রোমীয় ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিল্পকলা, বিজ্ঞানচর্চা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। এই জন্য ইতিহাসে তাঁর সময়কালকে ‘অগাস্টান যুগ (Augustan Age) বলা হয়।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে রোমানদের অবদান
রোমীয় সাহিত্য। রোমান সাহিত্য-সংস্কৃতিতে গ্রিক সভ্যতার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। উচ্চ শিক্ষিত রোমানরা ল্যাটিন ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতো। সে যুগে রোমান সাহিত্য চর্চা ছিল ব্যাপক। মলিয়ে প্রটাস এবং টেরেন্স ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নাট্যকার। রোমীয় সাহিত্যে নাটকের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। গীতি কাব্যকার ক্যাটুলাস ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। এ ছাড়া সিসিরো এবং ভার্জিল সাহিত্য চর্চায় খ্যাতি অর্জন করেন। অগাস্টান পরবর্তী যুগের বিখ্যাত কবি জুভিনাল ছিলেন একজন ব্যঙ্গধর্মী কবি। সে যুগে সাহিত্য-চর্চায় স্বাধীনতা ছিল। ক্যাটুলাস রোমান শাসক পম্পি এবং জুলিয়াস সিজারের বিরুদ্ধেও বিদ্রুপাত্মক কবিতা ও গীতি কাব্য রচনা করেন।
রোমান সভ্যতায় ইতিহাস
সাহিত্যকর্মের সঙ্গে ইতিহাস চর্চাও রোমে সমৃদ্ধি অর্জন করে। সে যুগে ইতিহাস দর্শন ও সাহিত্য চর্চার মধ্যে তেমন প্রভেদ ছিল না। সাহিত্যের প্রধান উপাদানই ছিল ইতিহাস। রোমের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ছিলেন টিটাস লিভি (Titus Livius); খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯-১৭ খ্রিস্টাব্দ), ট্যাসিটাস (৫৫-১১৭ খ্রি:) এবং পুটার্ক। এ সকল রোমান ঐতিহাসিকরা লিভিকে পম্পিয়ান হিসেবে অভিহিত করেন। লিভির বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ The History of Rome from the Foundation of the City, ট্যাসিটাস-এর বিখ্যাত গ্রন্থ 'Annals এবং Histories আর পুটার্ক এর বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ 'The Parallel Lives অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ছিল। এ সব গ্রন্থে লেখকরা তৎকালীন রোমান সংস্কৃতি, রাজনৈতিক বিশৃংখলা, সামাজিক মূল্যবােধ সম্বন্ধে বিবরণ দেন। রোমের ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতির প্রধান উৎস হচ্ছে লিভির রচিত রোমের ইতিহাস।
রোমান সভ্যতায় ধর্ম
রোমানরা গণপ্রজাতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। ফলে শাসনকার্যে ধর্মীয় প্রভাব বা পুরোহিততন্ত্র পাকাপোক্ত হয়ে বসতে পারেনি। তাদের দেবদেবীর মধ্যে গ্রিকদের মতো মানবিক গুণাবলী আরোপিত হয়। এক্ষেত্রে গ্রিক ধর্মের সঙ্গে রোমীয় ধর্মের বৈসাদৃশ্য থেকে সাদৃশ্যই বেশী পরিলক্ষিত হয়। বিখ্যাত গ্রিক দেবতা জিউস, রোমানদের নিকট আকাশের দেবতা জুপিটার হিসেবে খ্যাত। গ্রিক দেবতা এথেনার জায়গায় রোমীয় দেবতা মিনার্ভা স্থান দখল করে। রোমের প্রেমের দেবতা ছিলেন ভেনাস। বাতাস এবং সমুদ্রের দেবতা নেপচুন রোমানদের নিকট খুবই জনপ্রিয় ও শক্তিশালী ছিল। রোমীয় ধর্মচর্চা ছিল রাজনৈতিক ও ইহজাগতিক।
রোমান সভ্যতার দর্শন
রোমানরা দর্শনের ক্ষেত্রেও গ্রিক প্রভাব মুক্ত হতে পারেনি। গ্রিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই রোমান দর্শনের সূত্রপাত। রোমীয় দার্শনিকদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন সিসিরো (Cicero), লুক্রেটিয়াস (Lucretius)। লুক্রেটিয়াস ছিলেন গ্রিক এপিকিউরিয়ান মতবাদের প্রবক্তা। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘On the Nature of Things' অপর দিকে সিসিরো ছিলেন গ্রিক স্টয়িক মতবাদের অনুসারী। তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘On Duty' তে স্টয়িক মতবাদের প্রতিফলন দেখা যায়।
রোমান সভ্যতার আইন
প্রাচীন সভ্যতায় রোমানদের অন্যতম কৃতিত্ব হলো রোমান আইন ব্যবস্থা (Roman Law)। রোমান দেওয়ানী ও ফৌজদারী। আইন (সিভিল ও ক্রিমিনাল’ল) খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতেই সংকলিত হয়। এই আইনগুলি জনগণের সুবিধার্থে কাঠের ফলকে খোদিত করে রাজপথে প্রকাশ্যে টানিয়ে রাখা হতো। এ আইনগুচ্ছকে বলা হতো দ্বাদশ তালিকা (Twelve Tables)। বিশিষ্ট আইনবিদ ছিলেন গেইয়াস, আলপিয়ান প্যাপিনিয়ান এবং পলাস। সম্রাট জুলিয়াস সিজারের আমলে এদেরকে আইনের ব্যাখ্যা ও মামলা নিস্পত্তির অধিকার দেয়া হয়। এদের দ্বারা আইন সংস্কারের মাধ্যমে রোমান আইন একটি সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই নতুন আইনের তিনটি শাখা ছিল। (ক) জাস সিভিল (Jus Civile), (খ) জাস জেন্টিয়াম, (গ) জাস ন্যাচারাল। জাস সিভিল বা বেসামরিক আইন সকল রোমীয় নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য। জাস জেন্টিয়াম বা জনগণের আইন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রযোজ্য এবং জাস ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক আইন মূলতঃ প্রাকৃতিকভাবে ন্যায় অন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে মানুষ জন্মগতভাবে সমান এবং মৌলিক অধিকার প্রাপ্ত। তাই, রাষ্ট্র বা সরকার তাকে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। এই আইনের প্রবক্তা ছিলেন দার্শনিক সিসেরো। ৪৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ১২টি ব্রোঞ্জপাতে সর্বপ্রথম রোমান আইন সংকলিত হয়। রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস। হওয়ার পর পূর্ব-রোমে নতুনভাবে রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
রোমান সাম্রাজ্যের পতন
খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের শেষের দিকে ইতালির কৃষকেরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। রোম এবং অন্যান্য বড় শহরগুলোতে সর্বহারা । দল ভিড় করে। রোমের দাস-মালিকরা গর্বের সঙ্গে বলত, রোমের ক্ষমতা চিরস্থায়ী। তাদের শক্তিমান রক্ষীবাহিনী ও বিশাল সেনাবাহিনী অপরাজেয়। কিন্তু সেই শক্তি বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। জার্মান ও পারসিকরা এক একটি রোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলি দখল করতে থাকে। যারা কয়েক শতাব্দী ব্যাপী অন্যদের দাস বানিয়েছে, আজ তারাই দাসে পরিণত হয়।
রোমান সভ্যতার শিল্পকলা
রোমনগরীকে কেন্দ্র করে রোমান স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা বিকশিত হয়। জুলিয়াস-সিজারের আমল থেকে রোমীয় শিল্পকলার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। অগাস্টাস রোমীয় শিল্পকলাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান। রোম নগরীর স্থাপত্যে ইটের পরিবর্তে মার্বেল এবং মোজাইকের ব্যবহার শুরু হয়।
শেষে বলা যায়, রোমান সম্রাটগণ প্রায় ছয় শতাব্দী ধরে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিস্তৃত অঞ্চলব্যাপী শাসন করেছেন। তাঁরা পাশাপাশি সাহিত্য, বিজ্ঞান, আইন ও শিল্পকলার প্রসার ঘটিয়ে বিশ্বমানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধশালী করেন। রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে রোম ছিল তকালীন বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী নগরী। প্রচলিত আছে যে, রোম গোটা বিশ্বকে শাসন করেছে (Rome ruled the world)।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions