লক্ষ্ণৌ চুক্তি কি
লক্ষ্ণৌ চুক্তি : ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন বা মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতবাসীর সব দাবি-দাওয়া পূরণে যথেষ্ট সহায়ক হয় নি। এ আইনে যদিও প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি স্বীকার করে নেয়া হয় এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের অধিকার প্রদান করা হয় তথাপি এতে মুসলিম সম্প্রদায় পরিপূর্ণভাবে সন্তুষ্ট হতে পারে নি। এ সময় কয়েকটি ঘটনা মুসলমানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘােষণা তাদেরকে বৃটিশ সরকারের প্রতি সন্দিহান করে তোলে। এ রকম আরও একটি ঘটনা হচ্ছে বলকান যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুসলিম দেশ তুরস্কের প্রতি বৃটেনের বিরুদ্ধাচারণকে ভারতের মুসলমানরা সমালোচনার চোখে দেখে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তাছাড়া ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে কানপুর মসজিদের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে কয়েকজন মুসলমান নিহত হলে মুসলমানদের মধ্যে সরকার বিরোধী মনোভাব তীব্র হয়ে উঠে।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও অসন্তোষ ভারতের মুসলমানদের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। অভিজাত, রক্ষণশীল ও বৃটিশ অনুগত নেতাদের বদলে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম লীগের তরুন সদস্যগণ দলের মধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠে। এ সময়েই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, (যিনি একজন কট্টর কংগ্রেসী ছিলেন) মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চে মুসলিম লীগের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে দলের নতুন গঠনতন্ত্র প্রণীত হয়। এতে বলা হয় যে, জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং স্বরাজ অর্জনই হচ্ছে লীগের অন্যতম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এর ফলে ভারতের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। অতঃপর লীগ ও কংগ্রেস প্রায় একই সময়ে ও স্থানে এদের বার্ষিক অধিবেশন আহবান করে। এক দলের প্রতিনিধিগণ আরেক দলের অধিবেশনে যোগদান করে। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে বোম্বে শহরে অনুষ্ঠিত উভয় দলের সম্মেলনেই সরকারী নীতির সমালোচনা করা হয় এবং হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ঐক্যের উপর জোর দেয়া হয়।
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ এদের বার্ষিক সম্মেলন লক্ষ্ণৌ শহরে অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময়ে উভয় সম্প্রদায় ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের নীতির প্রশ্নে একটা সমঝোতায় আসে। এটাই ইতিহাসে লক্ষ্ণৌ চুক্তি নামে পরিচিত। এ চুক্তির মাধ্যমে কংগ্রেস ও লীগ মিলিত দাবি পেশ করে। চুক্তির বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
লক্ষ্ণৌ চুক্তির বৈশিষ্ট্য:
১. লক্ষ্ণৌ চুক্তিতে কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্যসংখ্যা ১৫০ জন করার সুপারিশ করা হয়। এদের মধ্যে পাঁচ ভাগের চার ভাগ হবেন নির্বাচিত সদস্য এবং বাকী একভাগ মনোনীত সদস্য। যতদূর সম্ভব ব্যাপক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সদস্যগণ নির্বাচিত হবেন। নির্বাচিত সদস্যের এক তৃতীয়াংশ হবে মুসলিম সদস্য এবং নিজ সম্প্রদায়ের দ্বারাই তারা নির্বাচিত হবেন। কেন্দ্রের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, শুল্ক, রেলওয়ে, ডাক ও তার বিভাগ। ভারত সচিবের কাউন্সিল বিলুপ্ত করতে হবে এবং বৃটিশ সরকারই তাঁকে বেতন দেবে। তাঁর সাহায্যকারী থাকবেন দু’জন এবং এদের মধ্যে একজন হবেন ভারতীয়।
২. প্রাদেশিক আইনসভার ক্ষেত্রে দাবি করা হয় যে, বৃহৎ প্রদেশে সদস্য সংখ্যা ১২৫ জনের কম হবে না। ছােট প্রদেশগুলোতে এ সংখ্যা হবে ৫০ থেকে ৭৫ এর মধ্যে। প্রদেশের ক্ষেত্রেও চার পঞ্চমাংশ সদস্য হবেন নির্বাচিত এবং অবশিষ্ট এক পঞ্চমাংশ মনোনীত। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে। প্রদেশগুলোতে নির্বাচিত সদস্য সংখ্যার ক্ষেত্রে মুসলিম সদস্য থাকবে পাঞ্জাবে ৫০%, যুক্তপ্রদেশে ৩০%, মধ্যপ্রদেশে ১৫%, বাংলায় ৪০%, বিহারে ২৫%, মাদ্রাজে ১৫% ও বোম্বেতে ৩৩%। এখানেও পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমেই মুসলিম প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। তবে শর্ত ছিল যে, এসব সংরক্ষিত আসন ছাড়া মুসলমানরা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক অন্যকোন আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না।
৩. লক্ষ্ণৌ চুক্তিতে সিদ্ধান্ত হয় যে, কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক আইন পরিষদে উপস্থিত কোন সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন বিল কখনো গৃহীত হবে না যদি উক্ত সম্প্রদায়ের তিন চতুর্থাংশ সদস্য সে বিলের বিরোধিতা করে।
৪. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একত্রে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
৫. চুক্তিতে দাবি করা হয় যে, ডােমিনিয়ন সরকারসমূহের সঙ্গে বৃটিশ সরকারের উপনিবেশ মন্ত্রীর যে সম্পর্ক, ভারত সরকারের সাথে ভারত সচিবের সম্পর্কও হতে হবে অনুরূপ।
উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্বকালের ইতিহাসে লক্ষ্ণৌচুক্তিই হচ্ছে প্রথম হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক সমঝোতার স্বাক্ষর। ভারতের জন্য একটি সংবিধানের মূল রূপরেখা প্রণয়নে এটা ছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যৌথ প্রয়াস। এ চুক্তি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তি রচনা করে। এর দ্বারা উভয় সম্প্রদায় সরকারের নিকট যুক্তভাবে নিজেদের দাবিনামা পেশ করার সুযোগ পায়। লক্ষ্ণৌচুক্তিতে কংগ্রেস প্রথমবারের মতো মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের অধিকার স্বীকার করে। মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বলেও মেনে নেয়। তবে এ চুক্তির কিছু সমালোচনা হয়েছে। বাংলা ও পাঞ্জাবে মুসলমানদের সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। শুধু হিন্দু মুসলিম সমঝোতার খাতিরে তাদেরকে এ দুই প্রদেশে জনসংখ্যা অনুপাতে কম সংখ্যক নির্দিষ্ট আসন মেনে নিতে হয়েছে। বাংলার নেতা নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এ চুক্তির প্রতিবাদে বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশনে যোগদান করেন। অন্যদিকে এ চুক্তির ফলে পাঞ্জাবে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ বিভক্ত হয়ে পড়ে। মাদ্রাজে তামিল ভাষী মুসলমানরা চুক্তির বিরোধিতা করে। তথাপি এটা অনস্বীকার্য যে, ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের লক্ষ্ণৌচুক্তি ঔপনিবেশিক ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক।
পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সম্পাদিত লক্ষৌচুক্তি হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক সহযোগিতা ও সামাজিক সম্প্রীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। ইংরেজদের উপর আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে সহযোগিতার পথে পা বাড়ায় এবং ভারতের জন্য স্বরাজ অর্জনের লক্ষ্যপথ স্থির করে। লক্ষ্ণৌচুক্তির মাধ্যমে এ দুই সম্প্রদায় বৃটিশ সরকারের কাছে যুক্ত দাবিনামা পেশ করে। এ চুক্তিতে কংগ্রেস প্রথমবারের মতো মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবিকে স্বীকার করে নেয় এবং ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানে যৌথ প্রয়াস গ্রহণ করে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions