Home » » চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত: ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংসের পর লর্ড কর্ণওয়ালিস আটচল্লিশ বছর বয়সে বাংলার গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। তাঁর শাসনকাল নানাবিধ সংস্কারের জন্য প্রসিদ্ধ। তার মধ্যে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে একটা নিশ্চিত ও দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য লর্ড কর্নওয়ালিস ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত এক নতুন ব্যবস্থার প্রস্তাব কোম্পানির নিকট পেশ করেন যা ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে অনুমোদন লাভ করে। তা ইতিহাসে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এ বন্দোবস্তের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আলোচনার সূত্রপাত হয়। এর পক্ষে কর্ণওয়ালিসের যুক্তি ছিল এই যে, ভূমি ব্যবস্থায় স্থায়িত্ব এলে স্বাভাবিকভাবেই জমিদারগণ ভূমিতে পুঁজিবিনিয়োগ করবেন এবং নিজ স্বার্থেই জমিদার তার উদ্ধৃত্ত অর্থ জমির উন্নয়নে ব্যবহার করবেন। তার ফলে জমি উন্নত হবে, কৃষিতে উৎপাদন বাড়বে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। কর্ণওয়ালিস জমিদার পুত্র ছিলেন বলেই মনে করেছিলেন যে, ইংল্যান্ডে যেমন ভূম্যধিকারী সমাজ কৃষিতে বিপ্লব সাধন করেছিল, তেমনি উপমহাদেশেও অনুগত জমিদার সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষি বিপ্লব সম্ভব হবে। তাই তিনি প্রজার দিকে তেমন নজর দিলেন না। তিনি এমন এক অভিজ্ঞ জমিদার শ্রেণি খাড়া করে দিতে চাইলেন যারা শত বাধার মধ্যেও ইংরেজদের অনুগত থাকবে। আর এমনিভাবেই এ শ্রেণি হবে উপমহাদেশে ইংরেজ-রাজের রাজনৈতিক ভিত্তি।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি কর্ণওয়ালিস যখন এদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন, তখন বাংলার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার অন্ত ছিল না। কোন একক কারণে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয় নি। এর পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। 

পূর্ববর্তী গভর্নর হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য যে পাঁচসালা বন্দোবস্তের (১৭৭২ খ্রি:) প্রথা চালু করেন, তাতে ভূমি রাজস্ব নিলাম করা হতো এবং যিনি ডাক পেতেন তিনিই জমির মালিক হতেন। এ ব্যবস্থায় উচ্চহারে ডাক নিয়ে জমির বন্দোবস্ত নিলেও সে অনুপাতে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় ও সময়সীমা থাকায় জমিদারগণ প্রজা পীড়ন করত কিন্তু উন্নয়ন করত না। ফলে কৃষকগণ জমি চাষ না করায় তা বছর ধরে অনাবাদী অবস্থায় পড়ে থাকত ও জমির দাম কমে যেত। এসব কুফল দেখা দেয়ায় হেস্টিংস জমিদারগণের সাথে একসালা’ ব্যবস্থা চালু করেন। কিন্তু এতেও সরকার, জমিদার ও প্রজাদের অসুবিধা দেখা দেয়ায় কর্ণওয়ালিস দশশালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন (১৭৮৯ খ্রি:)। সাথে সাথে কর্নওয়ালিস এ বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হবে বলেও আশ্বাস দেন। এ বিষয়ে স্যার জন শােরের সাথে কর্ণওয়ালিসের নানা তর্ক বিতর্ক হয়। অবশেষে কোম্পানির বোর্ড অব ডাইরেক্টরস্ এর অনুমোদন লাভের পর কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে ঘোষণা করেন। 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুসারে রাজস্বের পরিমাণ চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায় এবং জমির উপর জমিদারদের মালিকানা ক্ষমতা এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। জমি হস্তান্তর বা দান করার ক্ষমতাও তাঁরা পান। জমিদারগণ নিজ খুশী মত শর্ত সাপেক্ষে জমি পত্তন বা ইজারা দেয়ার ক্ষমতাও লাভ করেন। কেবল শুল্ক আদায়ের ক্ষমতা, বিচার ও পুলিশী ক্ষমতা তাঁদের হাতে দেয়া হয় নি। তাছাড়া জমির রাজস্ব কিস্তি নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের পূর্বে দিতে সক্ষম না হলে জমি নিলামে বিক্রি করার ক্ষমতা সরকারের হাতেই রয়ে গেল। তাই এই নিয়ম সূর্যাস্ত আইন নামে পরিচিত হয়। 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও নিরপেক্ষ বিচারে দেখা যায় যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলের চেয়ে কুফলই ছিল বেশি।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এর সুফল 

প্রথমতঃ জমিদারগণ জমির স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব লাভ করে জমির উন্নতি বিধানের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে লাগলেন। ফলে, জমির উৎপাদন শক্তি ও মূল্য বেড়ে গেল। 

দ্বিতীয়ত: সরকার প্রতিবৎসর নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায়-সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নতুন জমিদার শ্রেণির পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করতে লাগলেন। 

তৃতীয়ত: দেশের এই প্রভাবশালী জমিদারগণ ইংরেজ সরকারের সহায়তা করায় ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। 

চতুর্থত: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ইংরেজ শাসনের বুনিয়াদ সুদৃঢ় করে বাংলার সামাজিক ও বৈষয়িক উন্নতি সাধনেও বিশেষভাবে সহায়তা করেছিল। 

পঞ্চমতঃ বিত্তবান জমিদারগণ বিদ্যালয় ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন, জলাশয় ও দিঘি খনন, রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং পালা পার্বন ও সামাজিক উৎসবে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে গ্রাম বাংলার গ্রামীন জীবনকে সচল করে রেখেছিলেন। 

ষষ্ঠত: এ সময়েই জমিদার শ্রেণি ও কৃষক শ্রেণির মধ্যে সংযোগের মাধ্যমরূপে কৃষিজমির উপ-স্বত্বভােগী এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়। সপ্তমতঃ আয় সুনিশ্চিত হওয়াতে কোম্পানির বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুবিধা হয়। অস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে উদ্ভূত কুফলগুলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা দূর করা সম্ভব হয়েছিল।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কুফল 

প্রথমত: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সঠিক জরিপের মাধ্যমে জমি ভাগ না হওয়ায় নিষ্কর জমির উপর বেশি করে রাজস্ব নির্ধারিত হয় এবং জমির সীমানা নির্ধারিত না হওয়ায় পরবর্তীকালে মামলা মোকদ্দমার সৃষ্টি হতে থাকে। 

দ্বিতীয়ত: এই ব্যবস্থার ফলে পরবর্তীকালে জমির মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকলেও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি হয় নাই। ফলে সরকার। বর্ধিত রাজস্বের লাভ হতে বঞ্চিত হয়। 

তৃতীয়ত: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দরুণ প্রজা ও কৃষকদের কোনো উন্নতি হয় নি। জমিতে প্রজাদের পুরাতন স্বত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয় এবং তারা জমিদারদের করুণার উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়। জমিদার ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় উচ্ছেদ করতে পারতেন। পরিশ্রম করেও কৃষকগণ যথাযথ পারিশ্রমিক পেতো না। 

চতুর্থতঃ সূর্যাস্ত আইনের কঠোরতার জন্য অনেক বড় বড় জমিদারী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে বর্ধমানের, নাটোরের, দিনাজপুরের, নদীয়ার, বীরভূমের ও বিষ্ণুপুরের জমিদারী উল্লেখযোগ্য। তবে এঁদের মধ্যে একমাত্র বর্ধমানের জমিদারী ছাড়া আর অন্যসব জমিদারী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রথম সাত বছরের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যায়। 

পঞ্চমতঃ জমিদারীর স্বত্ব ও আয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে নায়েব গোমস্তাদের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে জমিদারগণ গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস শুরু করে। ফলে গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যেতে থাকে। 

ষষ্ঠত: জমিতে অর্থ বিনিয়োগ করে অনায়াসে সম্পদ ও মর্যাদা লাভের আশায় শিল্প-বাণিজ্য পরিত্যক্ত হতে থাকে। ফলে গ্রাম বাংলার কুটির শিল্প ও শ্রম শিল্প ক্রমশ ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। 

সপ্তমত: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার মুসলমানগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। উইলিয়াম হান্টারের মতে, “গত পঁচাত্তর বছরের মধ্যে বাংলার মুসলমান পরিবারগুলোর অস্তিত্ব হয় পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে, না হয় ইংরেজদের সৃষ্ট নতুন ধনী সমাজের নীচে এ সময় ঢাকা পড়েছে।” 

এ সময় নায়েব গোমস্তাদের অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যায়। ফলে লর্ড ক্যানিং ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব আইন দ্বারা খাজনা বৃদ্ধি বন্ধ করেন এবং ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রজাস্বত্ব আইন দ্বারা জমি থেকে উচ্ছেদ নিষিদ্ধ করে দেন। পাকিস্তান অর্জনের পর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উঠিয়ে দিয়ে প্রজাদের সঙ্গে সরাসরি জমির বন্দোবস্ত দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। জমিদার পুত্র লর্ড কর্ণওয়ালিস যে আশায় এ প্রথা চালু করেছিলেন তার সে আশা সম্পূর্ণ বিফল হয়েছিল।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *