মর্লি মিন্টো সংস্কার আইন কি
১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ‘কাউন্সিল আইন’ ভারতীয়দের দাবি-দাওয়া পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। তারা উপলব্ধি করে যে ভারতের জনগণকে কোনো প্রকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিকার প্রদান করতে বৃটিশ সরকার আদৌ আগ্রহী নয়। কিন্তু বিশ শতকের শুরুতে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠায় এবং ভারতীয়দের মধ্যে তীব্র বৃটিশ বিরোধী মনোভাব লক্ষ্য করে ঔপনিবেশিক সরকার সংস্কারের কথা চিন্তা করে। একদিকে স্বদেশী আন্দোলনের তীব্রতা, অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ- এহেন পরিস্থিতিতে সরকার বুঝেছিল যে, কেবল দমনমূলক নীতির মাধ্যমে এ অশান্ত পরিবেশের মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। ঐ সময়ে ইংল্যান্ডে উদারনৈতিক দলের ক্ষমতা লাভ, ভারতে লর্ড কার্জনের স্থলে বড়লাট হিসেবে লর্ড মিন্টোর দায়িত্ব গ্রহণ এবং ভারত সচিব পদে লর্ড মর্লির নিয়োগ ভারতের রাজনীতিতে সঞ্চার করে এক নতুন গতিবেগ। মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবি এবং ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে দলের মধ্যে নরমপন্থী ও চরমপন্থী উপদলের উদ্ভব পরিস্থিতিকে খানিকটা বৃটিশের পক্ষে অনুকূল করে তোলে। বৃটিশ পার্লামেন্টে বাজেট ভাষণে মর্লির ভারতে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের আভাস কংগ্রেসের নরমপন্থীদের সহযোগিতা লাভের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। লর্ড মর্লি ও বড়লাট মিন্টো উভয়েই নিজেদের মধ্যে মতের আদান প্রদানের পর শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একমত হন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বৃটিশ পার্লামেন্টে ভারতের শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য যে আইন পাশ হয় তা মর্লি-মিন্টো সংস্কার বা ১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইন নামে পরিচিত।
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের সংস্কার আইনে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতীয়দের সহযোগিতা লাভের নীতি গৃহীত হয়। বড়লাটের কার্যনির্বাহী পরিষদে একজন ভারতীয় প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা হয়। বােম্বে ও মাদ্রাজের গভর্নরের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৪ জনে উন্নীত করা হয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের গঠন ও ক্ষমতার ক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ অতিরিক্ত সদস্য সংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৬০ পর্যন্ত করা হয়। এর মধ্যে ২৮ জনের বেশি সদস্য সরকার কর্তৃক মনোনীত হবেন না। কতগুলো বিশিষ্ট সম্প্রদায় থেকে তাদের প্রতিনিধি মনোনীত করার অধিকার বড়লাটকে দেয়া হয়। তিনি মুসলমান সম্প্রদায়, জমিদার শ্রেণি, কলিকাতা ও বােম্বের চেম্বার অব কর্মাস এবং প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে সর্বমোট ২৭ জনকে মনোনীত করবেন। কেন্দ্রীয় আইন সভায় সরকার মনোনীত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখার নীতি গৃহীত হয়। প্রাদেশিক আইন পরিষদের ক্ষেত্রে বৃহৎ প্রদেশগুলোতে অতিরিক্ত সদস্যের সর্বাধিক সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ৫০ জনে। তবে এ বৃদ্ধি এমনভাবে করা হয় যাতে নির্বাচিত সদস্যদের তুলনায় সরকারি ও বেসরকারি মনোনীত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকে। একমাত্র বাংলায় নির্বাচিত সদস্যদের সংখ্যা অধিক রাখা হয়।।
সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের দাবি স্বীকার করে এ আইনে মুসলিম সম্প্রদায়কে পৃথকভাবে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের (পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা) অধিকার দেয়া হয়। তাছাড়া আইন সভাগুলোকে বাজেট নিয়ে আলোচনা করার প্রস্তাব উত্থাপন করার এবং জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ের আলোচনা করার অধিকার প্রদান করা হয়। অবশ্য ঐসব প্রস্তাব অগ্রাহ্য বা বাতিল করার ক্ষমতা সরকারের হাতে রাখা হয়। তবে দেশীয় রাজ্য, সামরিক বিভাগ, বৈদেশিক নীতি প্রভৃতি কয়েকটি বিষয়ের উপর প্রস্তাব গ্রহণ বা আলোচনা নিষিদ্ধ ছিল।
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের সংস্কার আইন ভারতে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়। আইন সভার নির্বাচিত সদস্যগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতেন না। তাছাড়া তাদেরকে কোনো ক্ষমতাও দেয়া হয় নি। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভাগুলোতে তারা সবসময়ই সংখ্যালঘু ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এ সংস্কার আইনের মাধ্যমে ভারতে প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের কোন ইচ্ছাই ইংরেজদের ছিল না। ভারত সচিব মর্লে স্পষ্টতই বলেছিলেন যে, স্বায়ত্তশাসিত ডোমিনিয়নের মর্যাদা ভারতকে দেয়া সম্ভব নয়। বড় লাট মিন্টোরও উক্তি ছিল যে, পাশ্চাত্যের অনুকরণে প্রতিনিধিমূলক সরকার গঠন ভারতের জন্য উচিত হবে না। তাই কংগ্রেসের নরমপন্থীদের পক্ষে আনা যদি মর্লি-মিন্টো সংস্কারের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে স্বীকার করতে হবে যে সে উদ্দেশ্য অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবি মেনে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বৃটিশ সরকার কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহন করে।
মর্লি-মিন্টো সংস্কারে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকায় জাতীয় কংগ্রেস অসন্তুষ্ট হয়। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস এ ধরণের নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। অধিবেশনের সভাপতি মদন মোহন মালাভীয়া সরকারের বিভেদমূলক নীতির তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন যে, এর ফলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষুন্ন হবে। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী একে মারাত্নক নীতি বলে অভিহিত করেন। অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের পত্র-পত্রিকা ও নেতৃবৃন্দ স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথাকে স্বাগত জানায়। নাগপুরে অনুষ্ঠিত ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লীগের অধিবেশনে ভারত সচিব ও বড়লাটের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions