খলিফা আবু জাফর আল মনসুরের কৃতিত্ব
খলীফা আবু জাফর আল-মনসুর দীর্ঘকায়, শ্যামবর্ণ ও ক্ষীণদেহের অধিকারী ছিলেন। তার চরিত্রে দোষ-গুণের বিচিত্র সমাবেশ লক্ষ করা যায়। একদিকে তিনি ছিলেন কোমল, প্রজারঞ্জক, ন্যায়পরায়ণ, আদর্শবাদী ও দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব। অপরদিকে তিনি ছিলেন শত্রুর প্রতি অত্যাচারী, কপট, বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞ ও স্বৈরাচারি শাসক। তিনি সানবাদের বিদ্রোহ, হিরাতের বিদ্রোহ ও বার্বার খারিজীদের বিদ্রোহ অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে দমন করেছিলেন। অপরদিকে ইমাম হাসানের বংশধর মুহাম্মদ ও ইব্রাহিমের প্রতি তাঁর আচরণ ছিল নিষ্ঠুর ও বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ। তিনি তাঁর পিতৃব্য আব্দুল্লাহ, ভ্রাতুস্পুত্র ঈসাকে তাদের দাবি হতে অপসৃত করেন। আবু মুসলিম খোরাসানীর মত যোগ্য ও মেধাবী ব্যক্তিত্বকে তিনি নিজ বংশের স্বার্থরক্ষার জন্য হত্যা করেছিলেন। আব্বাসীয় শাসন ব্যবস্থা দৃঢ় করার জন্য তিনি এই কঠোরতা অবলম্বন করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে আবু জাফর আল-মনসুর ছিলেন আদর্শবান ব্যক্তি। কোন প্রকার চারিত্রিক দুর্বলতা তাঁর ছিল না। অপবিত্রতা ও অশালীনতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ন্যায়-নিষ্ঠ, মিতব্যয়ী, ধৈর্যশীল ও কঠোর পরিশ্রমী হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর পুত্র মুহাম্মদ আল-মাহদীকে যে অছিয়ত দান করেন তা তাঁর অভিজ্ঞতা দৃঢ় চরিত্র ও উন্নত শাসনদক্ষতার পরিচয় বহন করে।
আল-মনসুরের কৃতিত্ব সমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি খলীফা আল-মনসুর একজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাঁর দূরদৃষ্টির মাধ্যমে বুঝতে সক্ষম হন যে, আব্বাসীয় খিলাফত একসময় বিলুপ্ত হবে, তাই জনগণের সমর্থন ও আস্থা অর্জনের মধ্যে দিয়ে এর স্থায়িত্বকে ধরে রাখা সম্ভবপর হবে। তাই তিনি পার্থিব ক্ষমতার সাথে আধ্যাত্মিকতার এক সংমিশ্রণ ঘটান। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় সুন্নী মতবাদের ভিত্তি গড়ে ওঠে। হানাফী ও মালেকী মাযহাব গড়ে ওঠেছিল। এর ফলে শিয়াদের আধিপত্য অনেকটা হ্রাস পায় ও খলীফা ধর্মীয়ভাবে অনেকটা স্বীকৃতি পান।
প্রশাসনিক সংস্কার
আব্বাসীয় খিলাফতের উযীর ও জল্লাদের পদটি আবু জাফর আল-মনসুরের সময় অব্যাহত থাকে। উযীর খলীফাকে শাসনকার্যে নানাভাবে সাহায্য করেন। খালিদ বিন বার্মাকী তার প্রধান উযীর ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে খলীফা আল মানসুর আব্বাসীয় প্রশাসনকে একটি মজবুত কাঠামো দান করেছিলেন।
আব্বাসী বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা
আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ মাত্র ৩ বছর রাজত্ব করেন, তাই তিনি আব্বাসীয়দের শাসন কাঠামো তৈরী করে যেতে পারেননি। তিনি কেবল আব্বাসীয়দের চিরশত্রু উমাইয়াদের প্রতি ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ কার্যকরণ করেছিলেন। কিন্তু খলীফা আল-মানসুর সিংহাসনে আরোহন করে অভ্যন্তরীন বিদ্রোহসমূহ দমন করেন, আব্বাসীয় খিলাফতের সম্ভাব্য হুমকি ও সমস্যাগুলোকে প্রতিহত করেন এবং ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্য সিংহাসন নিষ্কন্টক করেন। বাগদাদ নগরীর মত সুরক্ষিত একটি রাজধানী স্থাপন করেন। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও তিনি সমান সফলতা অর্জন করেন। তাই তিনিই ছিলেন আব্বাসীয় বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। Syed Ameer Ali এই প্রসংগে বলেন-Although Saffah is the first sovereign of the Banu Abbas, Abu Jafor must be regarded as the real founder of the dynasty.
বিজেতা হিসেবে
বিজেতা হিসেবেও খলীফা আল-মনসুর অগ্রগণ্য ছিলেন। তিনি ৭৭৩ খ্রিঃ রোমান সম্রাট ৪র্থ কনস্টানটাইনকে পরাজিত করে মালাসিয়া দুর্গটি দখল করেন। গ্রীক সীমান্তে নিরাপত্তার জন্য দুর্গ নির্মাণ করেন। তারাকিস্তান, আর্মেনিয়া, কুর্দিস্তান তার সময়ে আব্বাসীয়দের হস্তগত হয়।
অভ্যন্তরীন বিদ্রোহ দমন
ক্ষমতায় আরোহণ করেই খলীফা আল-মনসুর অভ্যন্তরীন বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সানবাদের বিদ্রোহ, আফ্রিকার বার্বার ও খারিজী বিদ্রোহ, খুরাসান ও তাবারিস্তানের বিদ্রোহ এবং রাওয়ান্দিয়া সম্প্রদায়ের বিদ্রোহকে দমন করে তিনি তাঁর সাম্রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
বিদ্যানুরাগী নরপতি
খলীফা আল-মনসুর একজন বিদ্যানুরাগী নরপতি ছিলেন। আব্বাসীয়দের দ্বারা শিক্ষা-সংস্কৃতির যে উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিলো তাঁর বীজ আবু জাফর আল-মনসুর কর্তৃক রোপিত হয়েছিল। আব্বাসীয়দের যুগ ছিল তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ যার সূত্রপাত হয় আল-মনসুরের সময়কাল হতে। খলীফা বহু স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা নির্মাণ ও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি নিজেও বিজ্ঞান ও গণিত শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। তাঁর সময়ে কুরআনের তাফসীর (ব্যাখ্যা) এবং হাদীস সংকলিত ও সংগৃহীত হয়। তিনি প্রাক-ইসলামী যুগের আরবী কবিতা সমূহও লিপিবদ্ধ করেন।
অনুবাদ বিভাগ স্থাপন
খলীফার রাজদরবারে অনেক পণ্ডিত ও জ্ঞানী-গুণী সমাদর পেতেন। খলীফা তাদের সমন্বয়ে একটি অনুবাদ বিভাগ স্থাপন করেন। এই বিভাগ গ্রীক, পারসিক, সংস্কৃত প্রভৃতি নানান ভাষায় লিখিত বহু মূল্যবান পুস্তকাদি আরবী ভাষায় অনুবাদ করে। তার তত্ত্বাবধানে এরিস্টটল, ইউক্লিড ও টলেমীর গ্রন্থসমূহ, ভারতীয় সিদ্ধান্ত' খণ্ডকা-খাদ্যকা, হিতোপদেশ আরবী ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।
স্থাপত্য শিল্পের উৎকর্ষ
স্থাপত্য শিল্পে আবু জাফর আল-মনসুরের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত টাইগ্রীস নদীর তীরে অবস্থিত বৃত্তাকার বাগদাদ নগরী জগৎ বিখ্যাত। তিনি রাফিকা নামক অপর একটি শহরও নির্মাণ করেন। কুফা ও বসরা নগরীর প্রাচীর, বাব আল-যাহাব (স্বর্ণদ্বার), কামরুল খুলদ (অনন্তধারা) ও রুসাফা রাজপ্রাসাদ তাঁর স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন।
পরিশেষে বলা যায়, আবু জাফর আল-মানসুর ছিলেন বিপরীত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণে গঠিত একজন মানুষ। তার চরিত্রে কঠোরতা ও কোমলতার অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছিল। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও কঠোর সাধনার ফলেই আব্বাসীয় খিলাফত গৌরবের যুগে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি ন্যায়বিচারক, প্রজাহিতৈষী, শ্রেষ্ঠ বিজেতা, বিদ্যানুরাগী ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই নৃপতির মাধ্যমেই আব্বাসীয়রা গৌরবের সাথে ৫০৮ বছর শাসন করতে সক্ষম হয়েছিল। কারণ | তিনিই ছিলেন এই বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions