Home » » উমাইয়া আমলের বৈশিষ্ট্য

উমাইয়া আমলের বৈশিষ্ট্য

উমাইয়া আমলের বৈশিষ্ট্য

খুলাফায়ে রাশিদীনের শাসনকাল অবসানের পর মুয়াবিয়া (রা.) কর্তৃক ৬৬১ খ্রি: দামেস্কে উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় শাসন ব্যবস্থা, সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। 


উমাইয়া সমাজের সামাজিক বৈশিষ্ট্য : 

অভিজাত সম্প্রদায় : 

খলীফা, খলীফার পরিবারবর্গ, বিজেতাগণ, আমলাবর্গ, সম্মন্ত আরবগণ এই শ্রেণিভূক্ত ছিলেন। খলীফাগণ দামেস্কে বিলাস ব্যাসনের জীবন যাপন করতেন। প্রাসাদ ছিল মূল্যবান পাথর ও মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি। কৃত্রিম ফোয়ারা ও জলপ্রপাত ছিল। খলীফা ও তার অভিজাত শ্রেণিবর্গ বিলাসী ও প্রমোদ-পূর্ণ জীবন-যাপন করতেন। 


মাওয়ালী : 

নবদীক্ষিত অনারব মুসলিমদেরকে মাওয়ালী বলা হত। মাওয়ালীরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য কোন আরব গােত্রভূক্ত হত। তারা উমাইয়াদের রাজ্য বিস্তার ও শিক্ষা সংস্কৃতিতে অবদান রাখে।


যিম্মি : 

মুসলিম রাষ্ট্রে আশ্রিত অমুসলিম প্রজাদের যিম্মি বলা হত। বাধ্যতামূলক সামরিক ও অন্যান্য দায়িত্ব থেকে জিযিয়া কর । প্রদান করে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ভোগ করতো। তবে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও অক্ষম ব্যক্তিদের জিযিয়া কর প্রদান করতে হতো না।।


দাস : 

উমাইয়া যুগে দাসদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধবন্দী হিসেবে সাধারণত দাসদের আগমন ঘটে। তারা খলীফা ও বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হতো। তবে তাদের অবস্থা রোমান ও সাসানীয় সময় অপেক্ষা ভালো ছিল। 


আমোদ-প্রমোদ : 

উমাইয়া যুগে ভোগ বিলাস প্রাধান্য পায়। দ্বিতীয় ওয়ালিদের সময়ে হেরেম প্রথা অত্যন্ত প্রসার লাভ করে। রাজধানী দামেস্ক পরিণত হয় সকল প্রকার আমোদ-প্রমোদের কেন্দ্র। খলীফা ও অভিজাত শ্রেণির মধ্যে ঘোড়দৌড়, পাশাখেলা, মোরগের লড়াই, দাবা ইত্যাদি খেলা প্রচলিত ছিল। উমাইয়া যুগের শেষভাগে পারস্য পোলো খেলার প্রচলন হয়।


নারীর অবস্থান : 

উমাইয়া যুগে সমাজে নারীর বিশেষ মর্যাদা ছিল। রাজ পরিবারের নারীরা প্রচুর স্বাধীনতা ভোগ করতেন। এ যুগে কয়েকজন বিদূষী নারীর কথা জানা যায়। মুয়াবিয়ার দুহিতা আতিকা ও আব্দুল মালিকের স্ত্রী আতিফা খলীফাদের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। মদীনায় ইমাম হুসাইন (রা.) এর কন্যা সুকায়না (সখিনা) তায়েফের আয়শা বিনতে তালহা, মক্কার খাফা ও ওয়ালিদের স্ত্রী উম্মে বানিন ও তাপসী রাবেয়া ছিলেন এই যুগের গুণবতী ও প্রতিভাসম্পন্ন নারী।


বেশ-ভূষা : 

উমাইয়া যুগে মুসলামনগণ আঁকজমক ও সুদৃশ্য পোশাক পরিধান করতেন। সাধারণত ঢিলা পাজামা, লম্বা কোর্তা, সূক্ষ মাথাওয়ালা জুতা ও পাগড়ী পরিধান করা হতো। বেদুইনরা কটিবদ্ধ ও কাঁধের উপর ছোট-ছোট চাদর ও মাথার উপর আবরণ ব্যবহার করতো। মহিলারা ঢিলা পাজামা কামিজ ও বড় রুমাল বা ওড়না ব্যবহার করতেন। 


অর্থনৈতিক অবস্থা বৈশিষ্ট্য

উমাইয়াযুগ ছিল রাজ্য বিস্তারের যুগ। এই যুগে মুসলমানগণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে বিজয় প্রতিষ্ঠা করে। উমাইয়াদের কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল দিওয়ান আল-খারায নামক প্রতিষ্ঠানের উপর। বায়তুল মাল ছিল রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কোষাগার। বিজিত অঞ্চল হতে উমাইয়াগণ ব্যাপক রাজস্ব আদায় করতেন। তাদের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎসগুলো ছিল: যাকাত, জিযিয়া বা নিরাপত্তা কর, গনিমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি, খারায বা অমুসলিমদের ভূমিকর, উশর বা মুসলিমদের ভূমিকর, উশুর বা বাণিজ্য কর, আল-ফে বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হতে প্রাপ্ত কর ইত্যাদি।। 


কৃষি উৎপদান :  

উমাইয়াগণ রাজ্য বিজয়ের ফলে প্রচুর অনাবাদি জমির মালিক হন। এ সকল জমিতে পানি সেচের মাধ্যমে ফসল ফলানোর কাজে অসংখ্য দাস শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। সিরিয়া, মিসর ও প্যালেস্টাইন অঞ্চলে উর্বর ভূমিতে প্রচুর কৃষি উৎপাদন ঘটে। 


হস্তশিল্প : 

উমাইয়া আমলে হস্তশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে এতে স্থানীয় কারিগর শ্রেণি যথেষ্ট উন্নতি সাধন করে। হস্তশিল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গৃহস্থালী আসবাব, তৈজসপত্র, সোফা, ফুলদানি, ধাতব পাত্র, মুসাল্লা (জায়নামাজ) ও কার্পেট ইত্যাদি। পোশাক শিল্পও এই সময় ব্যাপক প্রসার লাভ করে। 


মুদ্রা ব্যবস্থা : 

খলীফা আব্দুল মালিক সর্বপ্রথম রাজকীয় টাকশাল নির্মাণ করেন এবং বিভিন্ন প্রাদেশিক মুদ্রা তুলে নিয়ে আরবীতে নিজ নামে অঙ্কিত স্বর্ণ রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রার প্রচলন করেন। মুদ্রা জাল রোধ করার জন্য কঠোরতা অবলম্বন করেন।


শিল্প-সাহিত্য : স্থাপত্য ও সংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য 

জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা : 

সাম্রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি উমাইয়াগণ জ্ঞান বিজ্ঞানে ও শিল্প সাহিত্য চর্চায় বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। এই সময় গ্রীক, আর্মেনিয়া, রোমান, পারসিক ও ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা শুরু হয়। এটি ছিল মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূচনাকাল । 


কুরআন-হাদীস চর্চা : 

এই যুগে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কুরআন ও হাদীস চর্চা শুরু হয়। এই কুরআন ও হাদীস চর্চা শুরু থেকেই পরবর্তীতে ফিকাহ শাস্ত্র বা মুসলিম আইনের জন্ম হয়। এই যুগে সর্বশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশরাদ ছিলেন ইমাম হাসান আল বসরী, শিহাব আল জুহুরী। কুফায় আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ বহু হাদীস বর্ণনা করেন। ইবনে শারাহবিন ইমাম আবু হানিফার শিক্ষক ছিলেন। 


আরবী ব্যাকরণ ও ইতিহাস চর্চা : 

এই সময় বসরা ও কুফায় আরবী ব্যাকরণ চর্চা শুরু হয়। মূলত অনারব মুসলিমদের কুরআন পাঠে ও অর্থ উদ্ধারে সহায়তার জন্য ব্যাকরণ চর্চা শুরু হয়। বসরার আবুল আসওয়াদ ছিলেন আরবী ব্যাকরণের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক। ব্যাকরণবিদ খলিল আরবী ব্যাকরণ ও অভিধান প্রণয়ন করেন। তার শিষ্য সিবাওয়াই ছিলেন প্রথম আরবী ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনাকারী। উমাইয়া যুগের প্রথম ইতিহাসগ্রন্থ হচ্ছে আবিদ কর্তৃক রচিত কিতাবুল মুলক ওয়া আখবারুল মদীনা। কবি কায়িস ছিলেন। একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক। 


কবিতা ও কাব্য সংস্কৃতি : 

খলীফারা ছিলেন কবিতা ও কবির পৃষ্ঠপোষক। এযুগে রাজনৈতিক কবিতার জন্ম হয়। কবি মিসকিন আল দারিমী ইয়াযিদের খলীফা নির্বাচন সম্পর্কিত কবিতা রচনা করেন। হাম্মাদ জাহিলিয়া যুগের কবিতা সংকলনের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন।

এছাড়া ছিলেন ফারাজদাক জারীর ও আল-আখতাল। তারা চারণকবিতা, ব্যাঙ্গ কবিতা, প্রহসন রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কবির উমর ইবনে রাবিয়া ও কবি জামীল প্রেমের কবিতা রচনার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। 


আইনশাস্ত্র বা ফি ও বিভিন্ন মতবাদ : 

ইমাম আবু হানিফা, হাসান আল বসরী, এই যুগের শ্রেষ্ঠ ফিকাহ শাস্ত্রবিদ ছিলেন। এই সময় মুসলিম মনোজগতে আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক চিন্তার সূত্রপাত হয়। এই সময় জাবরিয়া ও কাদারিয়া নামে ২ টি ভিন্নধর্মী মতবাদের সৃষ্টি হয়। এই | সময় ইসলামের প্রথম যুক্তিবাদী সম্প্রদায় মুতাজিলাদের আবির্ভাব ঘটে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এই সময় | আত্মপ্রকাশ করে। যেমন- শিয়া ও খারিজী সম্প্রদায়। মুরজিয়া নামক অপর একটি সম্প্রদায়েরও আবির্ভাব ঘটে এই সময়ে। উমাইয়াগণ এদেরকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। 


শিক্ষা ব্যবস্থা : 

উমাইয়া যুগে শিক্ষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। খলীফা আব্দুল মালিক ও আল-ওয়ালিদ শিক্ষার একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তারা শিক্ষানুরাগী হিসেবেও পরিচিত। তাদের রাজত্বকালে সাম্রাজ্য জুড়ে বহু স্কুল ও মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। তখন মসজিদ ভিত্তিক কুরআন ও হাদীস শিক্ষা দেওয়া হতো। রাজপরিবারে ও অভিজাত শ্রেণির পরিবারে গৃহশিক্ষক রাখার রীতি প্রচলিত ছিল। 


বিজ্ঞান চর্চা :

উমাইয়াযুগে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা ব্যাপক প্রসার লাভ করে। খালিদ বিন ইয়াযিদ গ্রীক বিজ্ঞান চর্চা করে জ্ঞান অর্জন করেন। হারিস নামক একজন সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসক ছিলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর রচিত গ্রীক ও সিরীয় ভাষায় লিখিত গ্রন্থসমূহ এ সময় আরবীতে অনূদিত হয়। 


সঙ্গীত চর্চা : 

উমাইয়া খলীফাদের রাজদরবারে আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল। সেখানে নিয়মিত সঙ্গীত চর্চা হত। মদীনার তুবায়িস ছিলেন ইসলামী সঙ্গীতের গুরু। সাইদ ইবনে মিজাহ ছিলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ । নারীদের মধ্যে মদীনার জামিলা, সাল্লামা, হাবাবা, প্রমুখ উল্লেখযোগ্য সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন।


স্থাপত্য শিল্প : 

শিল্পে উমাইয়া খলীফাগণ বিশেষ কীর্তি রেখে গেছেন। আব্দুল মালিক ও আল ওয়ালিদ ছিলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যবিদ। জেরুজালেমে আব্দুল মালিক বিখ্যাত কুব্বাতুস সাখরা ও আল আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন। আল-ওয়ালিদ দামেস্কের বিখ্যাত উমাইয়া জামে মসজিদ নির্মাণ করেন। এটিকে প্রথম পূর্ণাঙ্গ মসজিদও বলা হয়। এছাড়াও মিসরের ফুসতাত মসজিদ ছিল উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *