হিশামের শাসন ব্যবস্থা / হিশাম ইবনে আবদুল মালিকের শাসন ব্যবস্থা
পরিচয়
খলীফা আব্দুল মালিকের চতুর্থ পুত্র ছিলেন হিশাম। ৭২৪ খ্রি: দুর্বল শাসক দ্বিতীয় ইয়াযিদের মৃত্যুর পর হিশাম। দামেস্কের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন উমাইয়া বংশের সর্বশেষ কর্মদক্ষ খলীফা।
সমস্যা ও সংকট
হিশাম সিংহাসনের আরোহণ করে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সময় উমাইয়া ও হাশিমী দ্বন্দ্ব, খারিজী বিদ্রোহ, বার্বার ও রোমানদের হুমকি এবং সর্বোপরি আব্বাসীয় আন্দোলন উমাইয়া খিলাফতকে সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। এ সকল সংকট নিরসন করে উমাইয়া হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধার করতে। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
হিশামের নীতি
একমাত্র ২য় উমর ছাড়া উমাইয়া বংশের সকল খলীফা কোন না কোন দলীয় শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। হিমারীয় ও মুদারীয় দ্বন্দ্ব এভাবে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতো। খলীফা ২য় ইয়াযিদ মুদারীয়দের অনুগ্রহ লাভ করেন। তাই তাদের প্রাধান্য খর্ব করার জন্য হিশাম হিমারীয়দের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
প্রশাসনিক রদবদল
পূর্ববর্তী খলীফার অযোগ্য শাসনের ফলে অযোগ্য রাজকর্মচারী ও মন্ত্রীর কুশাসনে বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা যায়। হিশাম। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশে প্রশাসনিক রদবদল করেন। ইরাকে উমর বিন হোবায়রাকে অপসারণ করে তার স্থলে খালিদ বিন আব্দুল্লাহ আল কাসরীকে নিয়োগ করেন। খালিদ এর ভ্রাতা আসাদ আল কাসরীকে খোরাসানে নিয়োগ করেন।
ইরাকে বিদ্রোহ দমন
ইরাকের শাসক খালিদ কৌশলে হিমারীয় ও মুদারীয় দ্বন্দ্ব প্রশমিত করেন। তিনি খারিজী বিদ্রোহ প্রশমিত করেন। অমুসলমানগণ ও তার শাসনে আস্থাভাজন হন। কিন্তু খলীফা তার সুশাসন সত্ত্বেও অর্থ আত্মসাৎ অথবা আলী (রা.) এর বংশধরদের প্রতি উদারতার জন্য তাকে পদচ্যুত করেন এবং তার স্থলে ৭৩৯ খ্রি: ইউসুফ বিন উমরকে ইরাকের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তার শাসনকালে যায়িদ নামক হযরত আলী (রা.) এর বংশধর কুফায় খিলাফত দাবি করলে ইউসুফ তাকে পরাজিত ও নিহত করেন।
খোরাসানে বিদ্রোহ দমন
জিযিয়া থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য আমু-দরিয়ার পূর্বদিকের অবস্থিত সাগোদের অধিবাসীগণ ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাদের উপর জিযিয়া ধার্য হলে তারা ইসলাম ত্যাগ করেন এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই সময় ৭৩৫ খ্রি: আসাদ আল কাসরী তার জৈষ্ঠ্য ভ্রাতা খালিদ আল-কাসরী কর্তৃক নিয়োজিত হন। ৭৩৬ খ্রি: আসাদ সাগোদের বিদ্রোহীদেরকে পরাজিত করেন। তিনি তুর্কি উপাজতি নেতা খানকেও পরাজিত ও নিহত করেন। আসাদ বলখে খোরাসানের রাজধানী স্থাপন করেন। আসাদ অচিরেই মৃত্যুবরণ করেন এবং তার স্থলে নসর বিন সাইয়্যারকে গভর্ণর নিয়োগ করা হয়। নসর ছিলেন সর্বশেষ উমাইয়া গভর্ণর। তিনি মার্ভে খোরাসানের রাজধানী স্থাপন করেন।
উত্তর আফ্রিকায় বিদ্রোহ দমন
হিশামের খিলাফতের প্রাথমিককালে উত্তর আফ্রিকায় শান্তি বজায় ছিল। কিন্তু একদল খারিজী উত্তর আফ্রিকায় গমন করে বার্বারদের সহায়তায় বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা ৭৩৮ খ্রি: তাঞ্জিয়ারের শাসনকর্তাকে নিহত করে এবং কায়রোয়ান দখল করে। আরব সেনাপতি হাবীব পরাজিত ও নিহত হন আরো বহু বীরযোদ্ধা এই যুদ্ধে নিহত হন। তাই এইযুদ্ধে ‘সম্রান্তদের যুদ্ধ’ (Battle of the Nobles) বলা হয়। খলীফা সেনাপতি কুলসুম কে প্রেরণ করলে তিনিও পরাজিত ও নিহত হন। এই অবস্থায় ৭২৪ খ্রি: হিশাম সেনাপতি হানজালাকে উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। মূর্তির যুদ্ধে’ (Battle of Idols) এ হানজালা বিদ্রোহীদের পরাজিত করে উত্তর আফ্রিকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
মধ্য-এশিয়ায় অভিযান
ককেশাস পর্বতের উত্তরে আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান প্রদেশে খাজার তুর্কিগণ বসবাস করত। ৭৩১ খ্রি: তারা মসুল আক্রমণ করে এর গভর্ণর জারাকে পরাজিত ও নিহত করে। হিশাম সাঈদ আল-হাবশীকে বিপুল সৈন্যসহ খাজারদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। খাজারগণ তার নিকট পরাজিত হয়। ৭৩২ খ্রি: খলীফা তাঁর ভ্রাতা মাসলামাকে পরের বছর ও মারওয়ানকে যথাক্রমে আর্মেনিয়া ও মেসোপটেমিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। মাসলামা খাজারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হন। মারওয়ান খাজারদের বিরুদ্ধে সফলতা লাভ করেন। পরবর্তী উমাইয়া ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় মারওয়ান নামে খ্যাত।
স্পেন ও ফ্রান্সের ঘটনাবলী
দামেস্ক হতে স্পেনের দূরত্ব অধিক হওয়ায় উত্তর আফ্রিকা হতে স্পেনের শাসনকর্তা নিযুক্ত হতো। ৭২০ সালে তুলুসের যুদ্ধের পর আরব সেনাপতি আনবাসাহ স্পেনের শাসকর্তা নিযুক্ত হন। তিনি প্রশাসনিক কাজে দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু পীরেনীজ গিরি সংকটে তিনি ফ্রান্সের বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। এর ফলে স্পেনে ৬ বছর যাবৎ বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। অবশেষে হিশাম ৭৩১ খ্রিস্টাব্দে আব্দুর রহমান আল-গাফিকীকে স্পেনে পাঠান। এই সময় পীরেনীজ পর্বতের অপর প্রান্তে সাগোদে আরব শাসনকর্তা মনুজা একুইটেনের ডিউক ইউডিজের সুন্দরী কন্যাকে বিবাহ করে শ্বশুরের সাথে আরব শাসনের বিরোধিতা শুরু করেন। মনুজা আব্দুর রহমানে নিকট পরাজিত ও নিহত হন। ইউডিজ ফ্রানকিস রাজা চার্লস মারটেলের সহায়তায় আব্দুর রহমানকে বাধা দেন। ৭৩২ খ্রি: টুরস নামক স্থানে উভয় পক্ষের ভীষণ যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। দলীয় কোন্দল, বিশৃঙ্খলা, সেনাপতির আদেশ অমান্য ও ভুল সংবাদ পরিবেশন ইত্যাদি কারণে মুসলমানগণ এই যুদ্ধে ভীষণভাবে পরাজিত হয়। সেনাপতি আব্দুর রহমান যুদ্ধে পরাজিত হন। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ভাগ্যনিয়ন্ত্রক যুদ্ধ।
আব্বাসীয় বিদ্রোহ
এই সময়ে আব্বাসীয়গণ উমাইয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। আবু মুসলিম খোরাসানী নামক এক ইস্পাহানবাসী হযরত আব্বাস (রা.) এর বংশধর মুহাম্মদ ও তার পুত্র ইব্রাহীম এর পক্ষে খোরাসান অঞ্চলে প্রচারণা শুরু করেন। খলীফা হিশাম এই আন্দোলনকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন।
হিশামের চরিত্র ও কৃতিত্ব :
শাসনদক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা
খলীফা হিশাম ২০ বছর রাজত্ব করেন। তিনি যে সময়ে ক্ষমতায় আরোহণ করেন তখন সর্বত্র ছিল গোত্রীয় কলহ, খারিজী ও বার্বার বিদ্রোহ, খাজার বিদ্রোহ ও স্পেনে সংকট। এই সময় আব্বাসী আন্দোলন উমাইয়াদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়। এই সংকটজনক অবস্থায় তিনি কঠোর অবস্থানে থেকে একে একে সকল বিদ্রোহ দমন করেন। তার পূর্বসূরী ২য় ইয়াযীদের সমর্থকদের প্রভাব তিনি বহুলাংশে কমিয়ে আনতে সক্ষম হন। তিনি ছিলেন উমাইয়া বংশের সর্বশেষ রাজনীতিবিদ। তার মাধ্যমে উমাইয়া গৌরব যুগের অবসান ঘটে। এই প্রসংগে P.K Hitti বলেন, “With Hisham (724-43), the fourth son of 'Abd-al-Malik, the Umayyad golden age came to a close."
সন্দেহপরায়ণ ও ধনলিপ্সা
শাসক হিসেবে তিনি সন্দেহপরায়ণ ছিলেন। কাউকেই তিনি বিশ্বাস করতেন না। তাঁর সময়ে অনেক প্রশাসনিক রদবদল দেখা যায়। তাঁর অতিরিক্ত অর্থলিপ্সা পূরণের জন্য তিনি প্রজাদের উপর বাড়তি কর আরোপ করেন। এর ফলে জনগণ অসন্তুষ্ট হয় এবং আব্বাসীয় আন্দোলন দ্রুত প্রসার লাভ করে।
ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ
ব্যক্তি জীবনে তিনি ধর্মপরায়ণ ছিলেন তাঁর দরবার পাপাচার ও অন্যায় হতে মুক্ত ছিল। হিশাম রক্ষণশীল মুসলিম হিসেবে পরিচিত এবং ধর্মের ক্ষেত্রে বিরুদ্ধ মতবাদ সহ্য করতেন না।
সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা
তিনি শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি একজন সুপণ্ডিত হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রী সেলিম একজন বিখ্যাত ভাষাবিদ ছিলেন। তিনি এরিস্টটলের কয়েকটি গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেন। তাঁর পুত্র জাবালাও ফার্সী ভাষায় লিখিত ইতিহাস আরবিতে অনুবাদ করেন। তিনি তাঁর প্রজাদের মঙ্গলের জন্য জনহিতকর কার্যাবলি সম্পাদন করেন। তিনি সুরম্য অট্টালিকা, বাগান ও রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। খ্রিস্টান ধর্ম যাজক স্টিফেন ছিলেন তাঁর একজন সহচর। এছাড়াও সঙ্গীতজ্ঞ হুনায়ন আল-হিরি তার অনুগ্রহ লাভ করেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions