পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক
পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ইতিহাস উভয় শাস্ত্রই সামাজিক বিজ্ঞানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। ইতিহাস ব্যতীত পৌরনীতি ও সুশাসন যেমন পরিপূর্ণ নয়, তেমনি পৌরনীতি ও সুশাসন ছাড়া ইতিহাস স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না। তাই পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
সাদৃশ্য :
পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ইতিহাসের মধ্যে বিদ্যমান সাদৃশ্যসমূহ নিম্নরূপ:
১। পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা : পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ইতিহাস শাস্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিরাজমান। ইতিহাসের তথ্য বিনা পৌরনীতি ও সুশাসনের আলোচনা পূর্ণতা পায় না। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জন সিলি (John Seely) বলেন, “পৌরনীতি ব্যতীত ইতিহাস মূল্যহীন, আর ইতিহাস ব্যতীত পৌরনীতি ভিত্তিহীন।”
২। পারস্পরিক সহযোগিতা : পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ইতিহাসের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বিদ্যমান। ইতিহাস অতীতের ঘটনা প্রবাহ, বিপ্লব, সংগ্রাম, আন্দোলন, যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিবর্তন ও তত্ত্বসমূহ বিশ্লেষণ করে। পৌরনীতি ও সুশাসনে যখন অতীত ঘটনা প্রবাহ আলোচনা করা হয় তখন সেখানে ঐতিহাসিক বিকাশ ধারা সন্নিবেশিত হয়ে থাকে।
৩। পরস্পরকে পরিপূর্ণতা দান : পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ইতিহাস পরস্পরকে পরিপূর্ণতা দান করে থাকে। পৌরনীতি ও সুশাসনের আলোচনা ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ইতিহাসের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। ইতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ ব্যতীত পৌরনীতি ও সুশাসনের ব্যাখ্যা পরিপূর্ণতা পায় না।
৪। বিষয়বস্তুগত সাদৃশ্য : পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ইতিহাসের মধ্যে বিষয়বস্তুগত সাদৃশ্য রয়েছে। পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ইতিহাস উভয় শাস্ত্রেই মানব জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে। পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকের সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করে থাকে। ইতিহাস মানব সমাজের বিবর্তনের ধারাবাহিকতার সংকলন করে থাকে। তাই উভয় শাস্ত্রের মৌলিক বিষয়বস্তুগত মিল লক্ষণীয়।
৫। এক অপরের পরিপূরক : পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ইতিহাস একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত হয়। পৌরনীতি ও সুশাসনের আলোচ্য বিষয়ে ঐতিহাসিক দিক-নির্দেশনা ও তথ্যসমৃদ্ধ না হলে তা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তেমনি ঐতিহাসিক ঘটনা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপ্ত না করলে তা নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায়।
বৈসাদৃশ্য :
পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ইতিহাসের মধ্যে বৈসাদৃশ্যসমূহ নিম্নরূপ:
১। বিষয়বস্তুগত পার্থক্য : ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়বস্তু পৌরনীতি ও সুশাসনের আলোচ্য বিষয়বস্তু থেকে ব্যাপক। পৌরনীতি ও সুশাসন কেবল নাগরিকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করে। প্রথাগত ইতিহাস শাস্ত্র কেবল রাজা-রাজত্ব নিয়ে আলোচনা করলেও, আধুনিক কালের জন ইতিহাস চর্চা নাগরিকের সামগ্রিক জীবন ধারা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এভাবে দেখলে বিষয়বস্তুগত দিক থেকে ইতিহাস শাস্ত্র অনেকটা বিস্তৃত। পক্ষান্তরে পৌরনীতি ও সুশাসনের আলোচ্য বিষয় অনেকটাই সীমাবদ্ধ।
২। প্রকৃতি ও পদ্ধতিগত পার্থক্য : পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ইতিহাসের মধ্যে প্রকৃতি ও পদ্ধতিগত পার্থক্য বিদ্যমান। পৌরনীতি ও সুশাসনের আলোচনা প্রকৃতপক্ষে তত্ত্ব অনুসন্ধানমূলক। এটি করা হয় তুলনামূলক পদ্ধতিতে। অন্যদিকে ইতিহাসের আলোচনার পদ্ধতি প্রধানত তথ্য ও বর্ণনামূলক।
৩। পরিধিগত পার্থক্য : পরিধিগত দিক দিয়ে ইতিহাসের চেয়ে পৌরনীতি ও সুশাসন কিছুটা সংকুচিত। পৌরনীতি ও সুশাসন রাষ্ট্র ও নাগরিকের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা করে। ইতিহাস রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট সময়ের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, চিকিৎসা শাস্ত্রসহ নানাবিধ বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা করে।
৪। প্রাধান্যগত পার্থক্য : প্রথাগত ইতিহাস শাস্ত্র মূলত অতীতের রাজনৈতিক, কিছু মাত্রায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ঘটনাবলি আলোচনা করে। অন্যদিকে, পৌরনীতি ও সুশাসন ঐতিহাসিক ঘটনাবলি আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান, ভবিষ্যৎ নাগরিক জীবনের কর্ম-পরিকল্পনার নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
পরিশেষে বলা যায় যে, পৌরনীতি ও সুশাসন এবং ইতিহাসের মধ্যে কিছু বৈসাদৃশ্য থাকলেও উভয় শাস্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions