সেলজুক সাম্রাজ্য
সেলজুকগণ মধ্য এশিয়ার বিখ্যাত ঘুজ গোত্রীয় লোক ছিলেন। সেলজুক বিন বাকায়িকের নাম অনুসারে এ বংশের নামকরণ হয় সেলজুক বংশ। তারা প্রাথমিককালে ছিল নিরক্ষর, অসভ্য ও অজ্ঞ। ৯৫৬ খ্রিঃ তারা সেলজুক বিন বাকায়িকের নেতৃত্বে দক্ষিণ ট্রান্স অক্সিয়ানার বোখারায় বসতি স্থাপন করে এবং সুন্নী ইসলাম মতাদর্শ ছিল। সেলজুকের পর তাঁর পুত্র পিণ্ড আরসলান ও তাঁর পৌত্র তুগ্রিল বেগের নেতৃত্বে সেলজুকগণ মধ্য এশিয়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। গজনীর সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মাসুদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সেলজুকের পৌত্র তুগ্রিল বেগ সেলজুকদের নেতৃত্ব দেন এবং মাসুদকে পরাজিত করে মার্ভ ও নিশাপুর দখল করেন। গনীর বংশের ধ্বংসস্তুপের উপর সেলজুক বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১০৪৩ খ্রিঃ মধ্যে তুগ্রীলের নেতৃত্বে সেলজুকগণ বলখ, জুরজান, তাবারিস্তান, হামাদান, রাই, ইস্পাহান ও পারস্য দখল করে নেয়।
তুগ্রীল বেগ (১০৩৭-১০৬৩) খ্রিঃ
১০৫৫ খ্রিঃ আব্বাসীয় খলীফা কায়িম-বিল্লাহ বুয়াইয়া শাসকদের প্রতাপে অতিষ্ঠ হয়ে তুগ্রিল বেগের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তুগ্রিল বেগ খলীফার আহবানে সাড়া দিয়ে বাগদাদে প্রবেশ করেন এবং ১০৫৫ খ্রিঃ শেষ বুয়াইয়া শাসক মালিক রহিমকে পরাজিত করে বাগদাদ দখল করেন। তুগ্রিল বেগ বাসাসিরি নামক তুর্কি নেতাকে পরাজিত ও নিহত করেন যিনি খলীফা আল-কায়িম বিল্লাহ কে সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন। ১০৬০ খ্রি: খলীফা পুনরায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। খলীফা তুগ্রিল বেগকে ‘সুলতান’ উপাধি দেন। তুলি বেগ বাগদাদে স্বয়ং উপস্থিত না থেকে তাঁর রাজধানী মার্ভ হতে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। তুলি বেগ অত্যন্ত উদার, সরল, সাহসী ও যোগ্য সামরিক সংগঠক ছিলেন। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর তুগ্রিল বেগকে জ্ঞানী, ধৈর্যশীল, দানবীর, অনাড়ম্বর ও বিদ্যানুরাগী বলে উল্লেখ করেন। মার্ভে ছিল তার রাজধানী। তিনি যে নগর বিজয় করতেন সেখানে তার বিজয়ের স্মৃতিস্বরূপ একটি মসজিদ ও একটি মাদ্রাসা স্থাপন করতেন। দীর্ঘ ২৫ বছর গৌরবে সাথে রাজত্ব করে ১০৬৩ খ্রি: তুগ্রিলবেগ মৃত্যুবরণ করেন।
আলপ আরসলান (১০৬৩-১০৭২) খ্রি:
তুগ্রিল বেগের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র আল আরসলান সেলজুক সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। সুলতান তুগ্রিলের সময় বাইজানটাইন সম্রাটের সঙ্গে যে সংঘর্ষের সূচনা হয়েছিল তা আল আরসলানের সময় চরমরূপ ধারণ করে। ১০৬০ খ্রি: আলপ আরসলান বাইজানটাইনদের কাপাডোসিয়া ও ফ্রিজিয়া হতে বিতাড়িত করেন। এরপর তিনি বাইজানটাইন অধিকার করে জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া দখল করেন। এতে ১০৭১ খ্রি: বাইজানটাইন সম্রাট ডায়োজিনিসিম রোমানাস ২,০০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। আল আরসলান মাত্র ৪০,০০০ সৈন্যের সাহায্যে মালাজকার্দ নামক যুদ্ধক্ষেত্রে রোমানদের পরাজিত করেন। রোমান সম্রাট তার কন্যার সাথে আলপ আরসলানের পুত্রের বিবাহ, সকল মুসলিমকে বন্দীদশা হতে মুক্তি প্রদান ও নিজের মুক্তিপণ হিসেবে ১০ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করে সুলতানের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। আলপ আরসলান ১০৭৩ খ্রি: ইন্তিকাল করেন। তিনি মার্ভ হতে ইস্পাহানে তার রাজধানী স্থানান্তর করেন। আব্বাসীয় খলীফার সাথে তার সুসম্পর্ক বজায় ছিল।
মালিক শাহ (১০৭২-১০৯২) খ্রি:
আল আরসলানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মালিক শাহ জালালউদ্দিন' উপাধি নিয়ে ১০৭৩ খ্রি: সিংহাসনে আরোহণ করেন। মালিক শাহের রাজত্বকাল ছিল সেলজুক ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। তাঁর রাজত্বের শুরুর দিকে তাকে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ দমন করতে হয়। নিজের ভ্রাতার তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই সময়ে আব্বাসীয় খলীফা ছিলেন মুকতাদির। তিনি একজন ব্যক্তি ছিলেন। মালিক শাহ তাঁর রাজধানী ইস্পাহান হতে বাগদাদে স্থানান্তর করে। একজন জ্ঞানী ও সুশাসক হিসেবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে মালিক শাহ্ বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তার সময়ে সেলজুক সাম্রাজ্য চীনের সীমান্ত হতে ভূ-মধ্যসাগরীয় তীর পর্যন্ত এবং উত্তরে জর্জিয়া হতে দক্ষিণে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি শাসন সংস্কারে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। তার সময়ে সাম্রাজ্যে সুখ-শান্তি বিরাজমান ছিল।
খাজা হাসান নিযামুল মুলক
মালিক শাহ খাজা হাসান নিযামুল মুলককে পদে নিযুক্ত করে ‘আতাবেগ’ উপাধি দেন। নিযামুল মুলক ছিলেন একজন পণ্ডিত ও মেধাবী এবং তাঁর কর্মদক্ষতা বিচক্ষণতার ফলেই সেলজুক শাসকদের মধ্যে মালিক শাহের রাজত্বকাল স্মরণীয় হয়ে আছে। এই প্রসংগে ঐতিহাসিক P.K. Hitti বলেন, ‘Nizamul-Mulk was probably, after Yahya Bermek, the ablest ministar and administrator, Asia has ever produced."
নিজামুল মুলক ছিলেন ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসের অলংকারস্বরূপ। তিনি তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণস্বরূপ রাজ্যশাসন কাঠামোর উপর ‘সিয়াসাত নামা’ নামক ফার্সি ভাষায় একটি মহামূল্যবান পুস্তক রচনা করেন। সুপণ্ডিত নিযামুল মুলক ১০৬৫-৬৭ খ্রি: বাগদাদে নিযামিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন যা পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) এর মত দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন এই মাদ্রাসার একজন অধ্যাপক। শেখ সাদী এই মাদ্রাসার অন্যতম। কৃতী ছাত্র ছিলেন এবং উমর আল-খৈয়াম নিযামুল মুলকের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। নিযামুল মুলকের পরামর্শে ১০৭৪ খ্রি: নিশাপুরে ৭০ জন জ্যোতির্বিদদের একটি সম্মেলন আহবান করেন এবং তাদের মাধ্যমে একটি পারসিক পঞ্জিকা সংস্কার করেন। এটি সুলতানের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘জালালী পঞ্জিকা'। মালিক শাহ নিশাপুরে একটি মান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়
মালিক শাহের রাজত্বের শেষ দিকে গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নিযামুল মুলকের সহপাঠি হাসান সাবাহ, যিনি পর্বতের বৃদ্ধ লোক (The old Man of the Mountain) নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায় ফাতেমীয়। খলীফার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং সাম্রাজ্যের সর্বত্র নৈরাজ্য ও ত্রাসের সৃষ্টি করে। তারা তরবারি ও বিষের সাহায্যে বহু রাজবংশীয় লোককে হত্যা করে। নিযামুল মুলকের উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে ১০৯১ খ্রি: গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় নিযামুল মুলককে হত্যা করে। তিনিই ছিলেন এই গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের প্রথম হত্যার শিকার। মালিক শাহ তাদের বিরুদ্ধে ২টি অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হন। অবশেষে ১২৫৬ খ্রি: মোঙ্গল নেতা হালাকু খান কর্তৃক গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের বিনাশ ঘটে ও তাদের প্রধান ঘাটি আলামুত দুর্গ বিধ্বস্ত হয়। মালিক শাহ প্রায় একুশ বছর রাজত্ব করে ১০৯২ খ্রি: মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
পরবর্তী সেলজুকগণ
মালিক শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পত্নী তুরখানের অনুরোধে খলীফা তার শিশুপুত্র মাহমুদকে (১০৯২-৯৪) নাসিরুদুনইয়া ওয়াদ্দীন উপাধি দিয়ে সুলতানের পদে অধিষ্ঠিত করেন। কিন্তু অচিরেই তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বরকিয়ারুক তাকে পদচ্যুত করেন ও রুকুনুদ্দীন উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। কিছুদিন পর তাঁর ভ্রাতা মুহাম্মদের সাথে তাঁর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বরকিয়ারুক পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন ও মুহাম্মদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই সময় হতেই সেলজুক সুলতানদের প্রভাব হাস পেতে থাকে। সেলজুক সাম্রাজ্য পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ১১৯৪ খ্রি: পর্যন্ত সেলজুকগণ আব্বাসী খলীফাদের উপর প্রভাব বজায় রাখেন।
সেলজুকদের পতনের কারণসমূহ:
যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাব :
মালিক শাহ ছিলেন শ্রেষ্ঠ সেলজুক শাসক। তাঁর মৃত্যুর পর যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে সেলজুক বংশের পতন ঘটে।
নিজামুল মুলকের মৃত্যু :
নিজামুল মুলকের ন্যায় মেধাবী ও যোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
আদর্শচ্যুতি :
যে আদর্শের ভিত্তিতে সেলজুক বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পরবর্তী দুর্বল শাসকগণ সেই আদর্শ হতে বিচ্যুত হয়ে পড়েন। এতে এ বংশের পতন ত্বরান্বিত হয়। ১১৯৪ খ্রি: খাওয়ারিজমের শাসক তাকাশ শেষ সেলজুক সুলতান তুগ্রিলকে (১১৭৭-৯৪) পরাজিত করে সেলজুক বংশের পতন ঘটান।
সেলজুকদের অবদান :
ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি সেলজুক সুলতানদের অবদান চিরস্মরণীয়। মালিক শাহের ও নিজামুল মুলকের সময়কাল ছিল সেলজুকদের স্বর্ণযুগ। দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী (রহ.), কবি ফরিদ আল দীন আত্তার, সাহিত্যিক নিযামী, কবি নাসির-ই-খসরু, গণিত ও জ্যোতির্বিদ উমর খৈয়াম সেলজুক রাজদরবার অলংকৃত করেন। সেলজুক সুলতানদের আমলে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও স্থাপত্য শিল্পের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। তাঁরা বাগদাদে সুন্নী খিলাফতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তারা ইসলাম বিস্তার ও এশিয়া মাইনরে স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
পরিশেষে বলা যায়, সুন্নী মতাদর্শী সেলজুক শাসকগণ ১০৫৫ হতে ১১৯৪ খ্রি: পর্যন্ত বাগদাদে শাসন পরিচালনা করেন। তুগ্রিল বেগ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও মালিক শাহের দ্বারা গৌরবান্বিত সেলজুক বংশ মধ্য এশিয়ায় এক বিস্তৃর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই বংশের সকল শাসক ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। এশিয়া মাইনরে তারা স্থায়ীভাবে ইসলামকে প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠিত করেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions