Home » » উমর ইবনে আবদুল আজিজ

উমর ইবনে আবদুল আজিজ

উমর ইবনে আবদুল আজিজ

পরিচয় :

উমর ইবনে আব্দুল আযীয (র.) ছিলেন মারওয়ানের দৌহিত্র। তাঁর মাতা ছিলেন দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা.) এর দৌহিত্রী উম্মে হামিম। তিনি ছিলেন খলীফা আব্দুল মালিকের ভাই ও মিসরের শাসনকর্তা আব্দুল আযীযের পুত্র। তিনি আব্দুল মালিকের কন্যা ফাতিমাকে বিয়ে করেন। ইতিহাসে তিনি ২য় উমর হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। 


ক্ষমতায় আরোহণ 

খলীফা আল-ওয়ালিদের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই সুলাইমান খলীফা হন। তিনি প্রশাসনিক দক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হন। তাঁর রাজত্বকালে উল্লেখযোগ্য কোন সামরিক বিজয় সম্ভব হয়নি। তিনি মাত্র ২ বছর ৮ মাস রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি সৎ ও পবিত্র চরিত্রের অধিকারী তার চাচাতো ভাই উমর ইবনে আব্দুল আযীযকে পরবর্তী খলীফা হিসেবে নির্বাচিত করেন। ৭১৭ খি, উমর ইবনে আব্দুল আযীয দামেস্কের সিংহাসণ আরোহণ করেন।


শাসননীতি : 

নিরপেক্ষ ও প্রজাবৎসল খলীফা ২য় উমর (রা.) একজন প্রজাবৎসল শাসক ছিলেন। রাজ্য জয়ের পরিবর্তে তাঁর সাম্রজ্যে বসবাসকারী প্রজাদের কল্যাণসাধনকেই তিনি তার পরম দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি শাসনকার্যে ন্যায়পরায়ণ, সৎ ও বিশ্বস্ত লোককে নিয়োগ করেছিলেন। তাদের কর্মকাণ্ডের উপর কড়া নজর রাখতেন। ইয়াযীদ ইবনে মুহাল্লাব ও আল-হুরকে অসৎ উপায় অবলম্বনের জন্য পদচ্যুত করেন। 


অনাড়ম্বর জীবন 

তিনি খিলাফত লাভের পর তার সকল সম্পত্তি রাজকোষে জমা করেন। তিনি খোলাফায়ে রাশিদীনের নীতি অনুসরণ করে দৈনন্দিন জীবন যাপন করতেন। তার নির্দেশে তদ্বীয় স্ত্রী তার পিতা ও ভ্রাতা কর্তৃক প্রাপ্ত মূল্যবান অলংকার রাজ কোষে জমা করেন। তিনি যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ করে দেন এবং রাজ অশ্বশালার অশ্ব বিক্রি করে জনকল্যাণে ব্যয় করেন। তিনি সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন।

বায়তুল মাল পুনঃপ্রতিষ্ঠা 

তিনি বায়তুল মালকে জনগণের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। 

হাশিমী নীতি 

খলীফা ২য় উমর হাশেমীয় বংশের প্রতি উদার ছিলেন। তিনি শুক্রবারের খুত্বায় হযরত আলীর নামে পঠিত লানত ও অভিসম্পাত বন্ধ করে দেন। তিনি মারওয়ান কর্তৃক দখলকৃত ফিদাক নামক খেজুরবাগানটি মুহাম্মদ (সা.) এর পরিবারের লোকদের কাছে হস্তান্তর করেন। তিনি তালহার সম্পত্তি যা আব্দুল মালিক কর্তৃক দখলকৃত হয়েছিল, তা তালহার বংশধরকে ফিরিয়ে দেন।

মজলিস-আল-শুরা 

শাসন ক্ষেত্রে তিনি মজলিস-আল-শুরা অনুসরণ করতেন যা তার পূর্বসূরীরা স্থগিত করেছিল।

খারিজী নীতি 

খলীফা ২য় উমর (রা.) খারিজীদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করেন। তাঁর এই নীতির ফলে তার সময়ে খারিজীগণ কোন বিদ্রোহ করেনি। খারিজীগণ একমাত্র ২য় উমর (রা.)কেই উমাইয়া বংশের খলীফা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। 

অমুসলিম নীতি 

খলীফা ২য় উমর (রা.) অমুসলিমদের প্রতিও উদার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। অমুসলিমগণ তাঁর সময়ে রাজকার্যে নিয়োগ পেতেন। তিনি খ্রিস্টান ও ইহুদীদের গীর্জা ও উপাসনালয় তাদের নিকট হস্তান্তর করেন। তিনি নারান, আইলা ও সাইপ্রাসের খ্রিস্টানদের বার্ষিক করের বোঝা হ্রাস করেন। 

মাওয়ালী নীতি 

খলীফা ২য় উমর মাওয়ালীদের (অনারব মুসলিম) প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি থেকে দূরে সরে আসেন। তাদের প্রতি বৈষম্য দূর করেন। তিনি তাদের উপর আরোপিত খারায ও জিযিয়া কর লাঘব করে দেন। তিনি মাওয়ালীদের ভাতা প্রদান করেন। 


সংস্কারসমূহ :

ধর্মীয় সংস্কার 

রাষ্ট্র সম্প্রসারণ অপেক্ষা ইসলাম সম্প্রসারণে খলীফা ২য় উমর বেশি মনােযোগী হন। তিনি মাওয়ালীদের উপর বাড়তি জিযিয়া ও খারায ন্যায়ানুগভাবে আরোপ করেন। মুসলিমদের ন্যায় তাদেরকে সকল রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা প্রদান করেন। এই নীতির ফলে খোরসান, বোখারা, সমরকন্দ, খাওয়ারিজম, নিশাপুর প্রভৃতি জায়গায় ইসলাম ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। আফ্রিকার বার্বার জনগােষ্ঠীর মাঝেও ইসলাম ব্যাপকহারে বিস্তার লাভ করে। তিনি ধর্মীয় ক্ষেত্রে কোন প্রকার গোঁড়ামির আশ্রয় নেননি বরং তিনি ছিলেন সকল ধর্মের প্রতি উদার। তিনি তাঁর রাজ্যে ধর্মনিরপেক্ষ শাসননীতি প্রবর্তন করেছিলেন।

রাজস্বনীতি

অমুসলিমদেরকে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য তিনি মাওয়ালীদের উপর হতে জিযিয়া ও খারায মওকুফ করেন। এর ফলে রাজকোষে অর্থসংকট দেখা দেয়। তাই রাজস্ব সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি নিম্নোক্ত পদ্ধতি অবলম্ব করেন। নও মুসলমানগণ ১/১০ অংশ উশর রাজস্ব প্রদান করতে যা পূর্বে তাদের উপর ১/৫ খারায হিসেবে ধার্য ছিল। তাই তিনি ঘোষণা করেন যে, ১০০ হিজরীর পরে অমুসলমানগণ মুসলিমদের নিকট খারায ভূমি বিক্রয় করতে পারবে না। মুসলমানগণ সকল প্রকার কর হতে মুক্ত ছিল এবং অমুসলমানগণ কর প্রদানে অনিচ্ছার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তাই তিনি ভূমিদখলকারী প্রত্যেক মুসলিম ও অমুসলিমের উপর খারা আরোপ করেন। তিনি সকল অমুসলিমকে রাষ্ট্র কর্তৃক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য জিযিয়া কর বাধ্যতামূলক করেন। 

বৈদেশিক নীতি : 

স্পেনের শাসন: স্পেনে শান্তি শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য খলীফা উমর আস-সামকে গভর্ণর নিযুক্ত করেন। তিনি সেখানে বহু জনহিতকর কার্যাবলি যেমন- ভূমি জরিপ, আদমশুমারি, সেতু, রাস্তাঘাট নির্মাণ ইত্যাদি সম্পন্ন করেন। তিনি সারাগােসায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি বিদ্রোহী খ্রিস্টানদের হুমকি প্রতিহত করার জন্য এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে পীরেনীজ পর্বত অতিক্রম করে ফ্রান্সের দক্ষিণাংশ দখল করেন। আস-সামের মৃত্যুর পর আব্দুর রহমান মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

উমর ইবনে আব্দুল আযীয এর চরিত্র :

কৃতিত্ব উমর ইবনে আব্দুল আযীয ছিলেন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে শ্রেষ্ঠ উমাইয়া খলীফা। তিনি ছিলেন সরল, আদর্শবান ও ন্যায়পরায়ণ শাসক। তিনি তার ব্যক্তিগত জীবন ও শাসনপ্রণালীতে খোলাফায়ে রাশিদীনের আদর্শ অনুসরণ করতেন। তিনি ইসলামের মৌলিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ধর্মভীরু ও নিষ্ঠাবান জীবন যাপন করতেন। প্রজাদের কল্যাণ সাধনই ছিল তার শাসননীতির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। এজন্যই ইসলামের ইতিহাসে তাকে পঞ্চম খলীফা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ছিলেন উমাইয়া বংশের এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। তিনি উমাইয়া সাধু খলীফা (Pious Caliph of the Umayyah) নামে পরিচিত। তার সময়ে ইসলাম ধর্ম প্রসারিত হয়। মাওয়ালী ও অমুসলিমগণ তাদের ন্যায্য অধিকার প্রাপ্ত হন। প্রজাগণ সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে। Syed Ameer Ali বলেন, eThe reign of Omar forms the most attarctive period of the Ommeyade dominion."

পরিশেষে বলা যায়, খলীফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয (রা.) উমাইয়া বংশের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল নাম। তাঁর রাজত্বকালে ছিল উমাইয়া বংশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি তাঁর পূর্বসূরীদের চেয়ে শাসনক্ষেত্রে ভিন্ন নীতি গ্রহণ করেন এবং খুলাফায়ে রাশিদীনের শাসননীতি ও ইসলামের আদর্শকে মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাই তিনি খুলাফায়ে  রাশিদীনের ‘পঞ্চম খলীফা হিসেবে পরিচিত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সদাসয় অনাড়ম্বর, উদার ও আদর্শবান একজন শাসক।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comment below if you have any questions

Contact form

নাম

ইমেল *

বার্তা *