ক্রুসেড শব্দের অর্থ কি / ক্রুসেড কি
‘ক্রুসেড' শব্দের অর্থ ধর্মযুদ্ধ। অর্থাৎ খ্রিস্টানদের ধর্মযুদ্ধকে ‘ক্রুসেড' বলা হয়। একাদশ শতকের শেষভাগ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় দু'শ বছরব্যাপী (১০৯৬-১২৯১) ইউরোপের খ্রিস্টানরা যিশুখ্রিস্টের জন্মভূমি জেরুজালেম উদ্ধারের নামে প্রাচ্যের মুসলিমদের সাথে যে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল ইতিহাসে তা ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে ক্রুশ চিহ্ন ধারণ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল।
ক্রুসেডের কারণ :
ক্রুসেডের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। সংক্ষেপে কারণগুলো নিম্নরূপ:
ধর্মীয় কারণ :
যিশুখ্রিস্ট বা হযরত ইসার (আ.) জন্মস্থান, মহানবী হযরত মুহম্মদের (সা.) মিরাজ গমণের স্থান এবং হযরত মুসা, দাউদ ও সুলাইমানের (আ.) স্মৃতি বিজড়িত স্থান হিসেবে জেরুজালেম খ্রিস্টান, মুসলিম ও ইহুদিদের নিকট অত্যন্ত পবিত্র স্থান। সপ্তম শতক থেকে এটি মুসলিমদের অধীনে থাকে। একাদশ শতকের শেষ দিকে ধর্মোন্মত্ত খ্রিস্টানরা নানা অযুহাতে মুসলিমদের নিকট থেকে জেরুজালেম উদ্ধারের জন্য ধর্মযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
খলিফা আল-হাকিম ও সেলজুকদের নীতি :
১০০৯ সালে ফাতিমি খলিফা আল-হাকিম তাঁর রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক কিবৃতি (Coptic) খ্রিস্টানদের খুশি করা ও তাদের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভ করার জন্য বাইজানটাইনদের সমর্থনপুষ্ট মালেকী খ্রিস্টানদের নিয়ন্ত্রিত জেরুজালেমের প্রধান গির্জা ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। এছাড়া সেলজুক তুর্কীদের অধীনে থাকাকালে খ্রিস্টানদের জেরুজালেমে গমনে বাধা প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। আক্রান্ত খ্রিস্টানরা দেশে ফিরে তাদের প্রতি অত্যাচারের কথা স্ব-জাতির কাছে প্রচার করে। এসব কারণে খ্রিস্টানরা জেরুজালেমকে মুক্ত করতে উদ্যত হয়।
ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের প্রভাব :
ইউরোপে এ সময় সামন্ততন্ত্র বা ভূমি-কেন্দ্রিক এক ধরনের ব্যবস্থাপনা বা এক কথায় জমিদারতন্ত্র প্রচলিত ছিল যেখানে সামন্তরাজাদের পুত্রগণ আধিপত্য নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করত। খ্রিস্টান ধর্মগুরুগণ তাদের সামরিক দক্ষতা ও শক্তিকে নিজেদের মধ্যে অপব্যয় না করে কৌশলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য ধর্মযুদ্ধের আহ্বান করেন।
বাণিজ্যিক কারণ :
মধ্যযুগে ভূমধ্যসাগরসহ গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বাণিজ্যিক পথগুলো মুসলিমদের দখলে ছিল। এতে খ্রিস্টান ইউরোপ বাণিজ্য সুবিধা হতে বঞ্চিত হয় এবং অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়। খ্রিস্টানরা এসব বাণিজ্যিক পথ ও এলাকা দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্যে আধিপত্য পুন:প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।
রাজনৈতিক কারণ :
ইসলামের আবির্ভাবের পর এর রাজনৈতিক শক্তি পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা, স্পেন ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে যেখানে এক সময় খ্রিস্টানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। মুসলিম সাম্রাজ্যের ক্রমাগত সম্প্রসারণে খ্রিস্টানগণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং বিজীত অঞ্চল পুনরুদ্ধার ও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ধর্মযুদ্ধে যোগদানের পরিকল্পনা করে।
ক্রুসেড আহ্বান :
১০৯৪ সালে সেলজুকগণ অভিযান চালিয়ে বাইজানটাইন রাজধানী কনস্টানটিনোপোলের নিকটবর্তী হলে সম্রাট আলেকসিয়াস কমনেনাস আতঙ্কিত হয়ে পোপের নিকট সাহায্যের আবেদন করেন। পোপ দ্বিতীয় আরবান জেরুজালেমসহ এশিয়া মাইনর পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১০৯৫ সালে ফ্রান্সের ক্লেরমোন্ট শহরে আহূত এক সম্মেলনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের আহ্বান করেন। ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের পাপমোচন ও স্বর্গ লাভের আশ্বাস দেয়া হয়।
ক্রুসেডের পর্বসমূহ
১০৯৬ সালে সালে প্রথম ক্রুসেড শুরু হয় এবং সর্বমোট ৮টি পর্বে ক্রুসেড সম্পন্ন হবার পর ১২৯১ সালে পরিসমাপ্তি ঘটে। ধর্মযুদ্ধে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইংল্যান্ডের ধর্মযোদ্ধাগণ অংশগ্রহণ করে। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জঙ্গী বংশের ইমামুদ্দিন জঙ্গী ও নুরুদ্দীন জঙ্গী; আইয়ুবী বংশের গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, আল-আদিল, আল-কামিল ও মালিক আস-সালিহ; মামলুক বংশের বাইবার্স, কালাউন ও আশরাফ প্রমূখ শাসকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ক্রুসেডের সময় এশিয়া মাইনর, এডেসা, এন্টিয়ক, জাফফা, আক্কা, সিডন, বৈরুত, ত্রিপলি, জেরুজালেম, আলেপ্পো, মসুল, হাররান, হিট্টিন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ক্রুসেডের একটি পর্বে খ্রিস্টান শিশুদেরকেও নিয়ে আসা হয় যারা পরে ইতালির অসাধু খ্রিস্টান বণিকদের মাধ্যমে দাসে পরিণত হয়। প্রায় দুশ বছর ব্যাপী ধর্মযুদ্ধ জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত জেরুজালেমে মুসলিমরা আধিপত্য বহাল রাখতে সক্ষম হয়।
ক্রুসেডের ফলাফল
ক্রুসেডের ফল সুদূর প্রসারী। ক্রুসেডের মাধ্যমে খ্রিস্টানরা জেরুজালেম উদ্ধার করতে না পারলেও ইউরোপের জন্য ক্রুসেড ব্যাপক ইতিবাচক ফলাফল বয়ে নিয়ে এসেছিল।
প্রাচ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ :
ক্রুসেডের ফলে খ্রিস্টান ইউরোপ প্রাচ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। প্রাচ্যে ব্যবহৃত অনেক দ্রব্য নিজেদের দেশে নিয়ে যাবার সুযোগ পায় যে সম্পর্কে ইতােপূর্বে তাদের কোন ধারণাই ছিলনা। মেরিনার্স কম্পাস, সুগন্ধি দ্রব্য, উন্নত কার্পেট, উন্নতমানের কৃষি পদ্ধতি, শিল্পজাত দ্রব্যাদি, লাইটিং, মসলা ইত্যাদি দ্রব্যাদি নিজেদের দেশে নিয়ে যাবার কারণে ইউরোপে এর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়।
মসলা বাণিজ্য ও ভৌগোলিক আবিস্কার :
প্রাচ্যের মসলার ইউরোপে এত চাহিদা ছিল যে ইউরোপীয় বণিকরা প্রাচ্যের সাথে মসলা বাণিজ্য শুরু করে। প্রাচ্যের মসলা বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তারা আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল ধরে বিকল্প জলপথের আবিস্কার করে। বলা যায় ভৌগোলিক আবিস্কার ক্রুসেডের পরোক্ষ ফল।
ক্যাথলিক ধর্ম প্রচার :
ক্রুসেডের ফলে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে রেশারেশির কারণে খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। খ্রিস্টান ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারীরা প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মিশনারী স্থাপনের মাধ্যমে তাদের ধর্ম প্রচারের সুযোগ লাভ করে।
রেনেসা ও আধুনিক ইউরোপের সৃষ্টি :
ইউরোপের রেনেসা বা নবজাগরণ সৃষ্টিতে আরব তথা ইসলামী সংস্কৃতির বিরাট প্রভাব রয়েছে যা ক্রুসেডের মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করে। ক্রুসেডের ফলে আধুনিক ইউরোপের জন্ম হয়। কারণ এর ফলে প্রাচ্যের তথা ইসলামী সভ্যতার অনেক উপাদান ইউরোপীয়রা গ্রহণ করার সুযোগ পায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন। বিষয়ের উপর অনেক আরবী পাণ্ডুলিপি প্রাচ্য হতে সংগ্রহ করে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
পরিশেষে বলা যায়, খ্রিস্টানদের ধর্মযুদ্ধকে ক্রুসেড বলা হয়। ইউরোপের খ্রিস্টানরা মুসলিমদের নিকট থেকে যিশুখ্রিস্টের জন্মভূমি জেরুজালেম উদ্ধারের নামে প্রাচ্যের মুসলিমদের সাথে কথিত ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হয়। বাইজানটাইন সম্রাট আলেকসিয়াস কমনেনাসের আবেদনের প্রেক্ষিতে পোপ দ্বিতীয় আরবান ধর্মযুদ্ধের আহ্বান করেন। ১৯৯৬ সালে সালে প্রথম ক্রুসেড শুরু হয় এবং সর্বমোট ৮টি পর্বে ক্রুসেড সম্পন্ন হবার পর ১২৯১ সালে পরিসমাপ্তি ঘটে। ক্রুসেডের ফলাফল সুদূর প্রসারী। ইউরোপে রেনেঁসা ও আধুনিক ইউরোপ সৃষ্টিতে ক্রুসেড ভূমিকা রাখে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions