মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কাকে বলে
মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে যে পরিপূর্ণ রূপ আজকে আমরা দেখছি তা কিন্তু একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এটি মূলত বিংশ শতাব্দীর চিন্তা ভাবনার ফসল। ব্যবস্থাপনার ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের ধারায় মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়টি আসলে সামগ্রীক ব্যবস্থাপনার কার্যক্রমের উন্নয়নের ধারায় সংযোজিত এক নতুন অধ্যায়। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা হলো প্রতিষ্ঠানের কর্মরত সকল স্তরের মানবীয় উপকরণের সাথে জড়িত সব কাজের সমন্বিত দিক। অতীতে প্রতিষ্ঠানের জনশক্তিকে অন্যান্য উপকরণের ন্যায় সাধারণ একটি উপকরণ মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এ ধারনার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে জনশক্তিকে সংগঠনের সবচেয়ে মূল্যবান ও অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কর্মী ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের যে সকল ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন Robert Owen তাদের মধ্যে অন্যতম। খ্যাতনামা বস্ত্র উৎপাদনকারী Robert Owen তার প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করে শ্রমিক কর্মীদের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণের সুপারিশ করেন, ১৮১৩ সালে তিনিই প্রথম A new view of society নামক গ্রন্থে শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণের সুপারিশ করেন ফলে অনেকেই তাকে আধুনিক কর্মী ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠাতা রূপে গন্য করেন। এর পর ১৯১১ খৃষ্টাব্দে F. W. Taylor - Scientific management গ্রন্থে পরিকল্পনা বিভাগের আওতায় Employment Bureau নামে একটি শাখার কথা বলে কর্মী ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের পথকে সুগম করেছেন। ১৯১২ সালে শ্রমিক কর্মীদের কল্যাণের জন্য শিল্পপতিগণ Welfare Secretaries নিয়োগ করে পরবর্তীতে যারা কর্মব্যবস্থাপক হিসেবে পরিচিত হন।
কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে শিল্প কারখানায় কর্মরত প্রত্যেক শ্রমিকের কার্য সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার জন্য ১৯২০ খৃষ্টাব্দে প্রথম কর্মী ব্যবস্থাপনার আত্ম প্রকাশ ঘটে। ১৯৪৫ সালের পর থেকে কর্মী ব্যবস্থাপনার দ্রুত উন্নতি ঘটে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিকদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে। ফলে পৃথক কর্মী বিভাগের প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকে। সাধারণ অর্থে কর্মী বলতে সংগঠনের নিস্তরের কর্মচারী ও শ্রমিকদের বুঝায়, অথচ কার্য সম্পাদনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে সংগঠনের মধ্যমে ও উচ্চস্তরের নির্বাহীগণও জড়িত থাকে। সে অর্থে কর্মী ব্যবস্থাপনা কথাটির দ্বারা এর আওতা সীমিত হয়ে পড়ে ফলে সংগঠনের সকল স্তরের মানবীয় উপাদানকে বুঝানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্ব প্রথম ১৯৫০ সালের পর থেকে কর্মী ব্যবস্থাপনা বিভাগের নাম পরিবর্তন করে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা রেখেছে। সেই থেকে এ বিষয়টি মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা নাম পরিগ্রহ করে সর্বক্ষেত্রে ব্যবহৃত ও প্রচলিত হচ্ছে।
মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞা (Definition of Human resource management)
সার্বজনীন মৌলিক ব্যবস্থাপনার যে সকল অংশ রয়েছে তাদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যবহৃত অংশ হলো মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা। সাধারণ অর্থে শিল্প কারখানায় ও অফিসে কর্মরত শ্রমিক কর্মীদের ব্যবস্থাপনাকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বলে। অন্যভাবে বলা যায় ব্যবস্থাপনার যে অংশ দ্বারা প্রতিষ্ঠানের কর্মরত মানবীয় উপাদান সংক্রান্ত প্রশাসন পরিচালনা করা হয় তাই মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা নামে পরিচিত। পূর্বে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে কর্মী ব্যবস্থাপনা (Personnel management), শ্রম ব্যবস্থাপনা (Labour management), কর্মী প্রশাসন (Personal adminstration), শিল্প ব্যবস্থাপনা (Industrial management) ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হত। উৎপাদনশীল শিল্প প্রতিষ্ঠান অথবা সেবা পরিবেশনকারী (যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লাব, সংঘ, সমিতি, NGO, সরকারিবেসরকারি অফিস ইত্যাদি) প্রতিষ্ঠানসমূহ দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনে নির্বাহী ও শ্রমিক কর্মী সংগ্রহ ও নির্বাচন, নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, বদলী, পদোন্নতি, অবসরদান ইত্যাদি কার্য সম্পাদন করতে হয়। আর প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রম শক্তি তথা মানবীয় উপাদান সংক্রান্ত এসকল নানাবিধ কাজের সমষ্টিই হচ্ছে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা। এই শ্রমিক কর্মীই হলো একমাত্র উপাদান যারা সেবা কার্য ও উৎপাদনশীল কাজে সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহৃত হয় এবং এদের উপর প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ও অবনতি অনেকটায় নির্ভরশীল।
Gray Dessler- এর মতে, “মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যা কর্মী সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন, ক্ষতিপূরণ এবং তাদের শ্রম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং ন্যায় নিষ্ঠার সাথে সম্পর্কিত” [Human resource management is the process of acquiring, training, appraising and compensating, employees, and attending to their labour relations, health and safety, and fairness concerns..]
Ricky W. Griffin এর মতে, “মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা হলো পরস্পর সম্পূরক কতিপয় সাংগঠনিক কাজ যা কার্যকর কর্মীদল আকর্ষণ, উন্নয়ন ও সংরক্ষণের সাথে জড়িত । [Human resource management is the set of organizational activities directed at attracting developing and maintaining an effective work force.]
David A. Decenzo and Stephen P. Robbins এর মতে, “মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা চারটি কাজের সমন্বয়ে গঠিত (১) স্টাফিং (২) প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন (৩) প্রেষণা দান এবং (৪) সংরক্ষণ বা ধারে রাখার ব্যবস্থা করা [Human resource management is made of four activities (i) Staffing (ii) Training and development (111) Motivation and (iv) Maintenance.]
উল্লেখিত আলোচনা ও বিশেষজ্ঞ সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে চূড়ান্তভাবে বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন সুদক্ষ কর্মী বাহিনীর উপর নির্ভরশীল- যাদের সার্বিক ভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব ন্যাস্ত থাকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার উপর। তাই বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের মানবীয় উপাদান সংক্রান্ত সকল কার্যের সমষ্টিকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা (HRM) হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ একমাত্র উপাদান যার সেবা কার্য ও উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য উপাদান গুলোকে সমন্বয় করে।
মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতা বা পরিধি (Scope of Human Resource Management)
মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা মৌলিক ব্যবস্থাপনার অংশ হলেও এর গুরুত্ব অফিসের অন্যান্য বিভাগের তুলনায় বেশ ব্যাপক। প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনের যে সকল উপাদান ব্যবহৃত হয় সেগুলোর সমন্বয় পূর্বক মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা অফিসকে রাখে সর্বদা সচল ও গতিশীল। শিল্প সম্পর্ক উন্নয়ন, পারিতোষিক ও মজুরী নির্ধারণ সর্বপরি তাদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ করা মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রধান দায়িত্ব। তাই বলা যায় প্রতিষ্ঠানের কর্মরত সকল স্তরের কর্মী সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজ বলে এর আওতা বা পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। নিতে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত বিষয়সমূহ উপস্থাপন করা হলো:
মানব সম্পদ পরিকল্পনা (Human Resource Planning) :
মানব সম্পদ পরিকল্পনার মৌলিক উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের কাজের প্রকৃতি ও ধরন অনুযায়ী কার্য বিভক্তি করে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মীদের মধ্যে কার্য বণ্টন করা । সময়মত সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক দায়িত্বে নিয়োজিত করার জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে সে অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়।
সংগঠন ও পদের নকশা প্রণয়ন (Design of organization & job) :
প্রতিষ্ঠানের সামগ্রীক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ। তাই কার্যকর সংগঠন কাঠামো নির্ধারণ, কার্যভিত্তিক পদ সৃষ্টি ও বিন্যাস, পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ, দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রদর্শন করা মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভূক্ত। এজন্য পদ অনুযায়ী মানব সম্পদের চাহিদা নির্ধারণ ও উৎস নির্বাচন করে পদ ভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করতে হয়।
কার্য বর্ণনা (Description of work) :
সংগঠনের জন্য প্রণীত নকশায় পদ ভিত্তিক বণ্টনকৃত কার্যের বর্ণনা মনব সম্পদ ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভূক্ত। এতে বিভিন্ন পদের বিপরীতে কার্যের সীমানা নির্ধারণ করা হয় এবং কাজের সামগ্রীক বর্ণনা সহজতর হয়।
নির্বাচন ও স্টাফিং (Selections & staffing) :
প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মী খুঁজে বের করা হয় এবং তাদের কাজের জন্য নির্বাচন করে উপযুক্ত ব্যক্তিকে সঠিক স্থানে পদায়ন করা হয়। এ পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ কর্মীর প্রয়োজন সনাক্তকরণ, কর্মী সংগ্রহের উৎস নির্বাচন, পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদি কার্য সম্পাদন করেন।
প্রশিক্ষণ ও উননয়ন (Training & Development) :
কর্মীকে তার কার্য পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও কাজ সম্পর্কে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়াকে প্রশিক্ষণ বলে। অন্যদিকে কর্মরত কর্মীকে অধিক দক্ষ করে গড়ে তোলার কাজকে উন্নয়ন বলে। প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মীকে কাজের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা যায়।
সাংগঠনিক উন্নয়ন (Organizational Development) :
প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীদের সন্তুষ্টির জন্য সঠিক ভাবে কার্য মূল্যায়ন ও পদ মূল্যায়ন করে সংগঠনের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মীর মধ্যে আন্ত:ব্যক্তিক ও আন্ত:দলীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হয়।
মজুরী ও বেতন (Wages & Salaries) :
মানুষ তার অভাব পূরণের জন্য অর্থের বিনিময়ে শ্রম বিক্রি করে। শ্রমিকদের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী মজুরী ও বেতন কাঠামো নির্ধারন করতে হয়। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কর্মীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুবিধাসহ স্থায়ী মজুরী ও বেতনের ব্যবস্থা করে থাকে।
কার্য পরিবেশ (Working Environment) :
প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কার্য পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রতিষ্ঠানের কার্য সময়, কাজের ভৌত পরিবেশ, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়সমূহ উন্নত ও সম্প্রসারিত হলে কর্মীকে সহজে কাজের প্রতি আকর্ষিত করা যায়। তাই এগুলো মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত।
শ্রমিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক (Labour Management Relations) :
শিল্প প্রতিষ্ঠানে শান্তি, শৃঙ্খলা, সেবা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সুন্দর শ্রম ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল। সুষ্ঠুশ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক সৃষ্টির কাজটি মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত বিষয়।
বিনোদন সুবিধা (Entertainment Benefit) :
বিনোদন ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমিক কর্মীকে সতেজ ও উদ্যোমী রাখা যায়। তাই কর্মীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের বিনোদনমূলক ব্যবস্থা যেমন- খেলাধুলা, চিত্তবিনোদন, বনভোজন, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ইত্যাদির ব্যবস্থা করা মানব সম্পদ উন্নয়ন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
ব্যক্তিক গবেষণা ও তথ্য ব্যবস্থাপনা (Personal Resource & Information System) :
প্রযুক্তির উন্নয়নে আজ পৃথিবী পরিবর্তীত হচ্ছে অহরহ। তাই পরিবর্তীত অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে তথা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থেকে নিজেদের উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিক গবেষণা ও তথ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। কর্মীর প্রত্যাশা ও আচরণ অনুধাবন করে তাদের দ্বারা প্রত্যাশা মাফিক কাজ আদায় করতে মানব সম্পদ উন্নয়নে গবেষণা ও তথ্য ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions