মনোভাব কি
কোনো ব্যক্তি কোনো ঘটনা বা বস্তুর প্রতি যে অনুভূতি, বিশ্বাস ও আচরণ প্রকাশ করে তাকেই মনোভাব বলা হয়ে থাকে । মনোভাব ইতিবাচক বা নেতিবাচক দুরকমেরই হতে পারে। ব্যক্তির মনোভাব তার পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল থেকে গড়ে ওঠে। সুতরাং, কোনো বিশেষ উদ্দীপকের প্রতি সাড়া প্রদান ব্যক্তির মনোভাবের উপর নির্ভরশীল নীরবতা বা কর্মের মাধ্যমে মনোভাব প্রকাশ করা যায়। তবে মতামত মনোভাবের বাচনিক বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। স্টিফেন রবিনস (Stephen Robbins) এর মতে, কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা অবস্থার প্রতি কোনো ব্যক্তির অনুকূল বা ইতিবাচক, প্রতিকূল বা নেতিবাচক মূল্যায়নমূলক বিবরণীকে মনোভাব বলে ।
মনোভাব এবং মূল্যবোধ একই জিনিস নয়, কিন্তু একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। সাংগঠনিক আচরণে মূল্যবোধ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি মনোভাবও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, কোনো বস্তু বা ঘটনার প্রতি কর্মীদের অনুভূতি ও বিশ্বাস যা তাদের নির্দিষ্ট পরিবেশে নির্দিষ্ট কর্মসম্পাদনের বিষয়ে নির্দিষ্ট আচরণ করতে প্রভাবিত করে।
কোনো বস্তুর প্রতি তিনটি ভিন্ন ধর্মী কিন্তু পরস্পর নির্ভরশীল উপাদান দিয়ে মনোভাব গড়ে ওঠে:
(ক) অনুভূতিমূলক উপাদান (Affective Component): কোনো বস্তু, ঘটনা, বিষয় বা ধারণার প্রতি কোনো ব্যক্তির অনুভূতি, আবেগ, রসবোধ ইত্যাদি এবং ঐ বস্তু, ঘটনা বিষয় সম্পর্কে তার পছন্দ বা অপছন্দ করার প্রবণতা অনুভূতিমূলক উপাদানের অন্তর্ভুক্ত।
(খ) অবগতিমূলক উপাদান (Cognitive Component): ব্যক্তির বিশ্বাস, মতামত, জ্ঞান ও প্রাপ্ত তথ্য ইত্যাদি অবগতিমূলক উপাদানের অন্তর্ভুক্তি।
(গ) আচরণমূলক উপাদান (Behavioral Component): কোনো কিছু করার ইচ্ছা বা প্রবৃত্তিতে কোনো ব্যক্তির নির্দিষ্ট পন্থায় আচরণের প্রবণতা আচরণমূলক উপাদানের অন্তর্ভুক্ত।
আলোচিত উপাদানগুলো ব্যক্তির মনোভাব গঠনে সমন্বিত প্রভাব বিস্তার করে। অনুভূতি, অবগতি এবং আচরণ প্রবণতার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো বস্তু, ঘটনা, বিষয় সম্পর্কে আমাদের মনোভাব গঠিত হয়।
মনোভাবের উৎসসমূহ
Sources of Attitudes
মূল্যবোধের মতই মনোভাবও পিতা-মাতা, শিক্ষক, সঙ্গী এবং সহকর্মীদের কাছ থেকে অর্জিত হয়। আমরা জন্মগতভাবেই পিতা-মাতা বা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে কিছু বৈশিষ্ট্যাবলি পেয়ে থাকি । আমরা শৈশব থেকেই যাদেরকে শ্রদ্ধা করি, যাদের প্রতি মুগ্ধ হই এমনকি ভীত হই, তাদেরকে অনুকরণ করার চেষ্টা করি। তখন থেকেই মূলত: আমাদের মনোভাব গঠন হতে থাকে। আমরা পর্যবেক্ষণ, কখনো বা মনোযোগী হই কীভাবে আমাদের পরিবার এবং বন্ধুরা আচরণ করে এবং আমরা নিজেদের মনোভাব ও আচরণকে তাদের সাথে সামঞ্জস্য করে থাকি। অনেকে আবার জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ত্বদের মনোভাবকে অনুকরণ করে থাকে। এছাড়াও আমরা যাদের প্রতি মুগ্ধ হই কিংবা শ্রদ্ধা করি, সেইসব ব্যক্তিদের আচরণ ও মনোভাবকে আমরা অনুকরণ করে থাকি। তবে, মূল্যবোধের বিপরীতে মনোভাব কম স্থিতিশীল হয়।
সংগঠনে মনোভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারণ এটা কর্মক্ষেত্রে আচরণকে প্রভাবিত করে। যেমন-কর্মীদের দিয়ে একই বেতনে কিংবা কম বেতনে বেশি সময় ধরে কাজ করানো, এখানে বোঝার বিষয় কীভাবে সুপারভাইজরের মধ্যে এ মনোভাবের জন্ম নিয়েছে, প্রকৃত কর্ম-আচরণের সাথে তার এ মনোভাবের সম্পর্ক এবং কীভাবে তার মনোভাবের পরিবর্তন ঘটতে পারে ।
মনোভাবের ধরন
Types of Attitudes
একজন মানুষের হাজার ধরনের মনোভাব থাকতে পারে, কিন্তু সাংগঠনিক আচরণে শুধুমাত্র কর্ম-সম্পর্কিত মনোভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়। সাংগঠনিক আচরণের উপর পরিচালিত বেশিরভাগ গবেষণা তিন ধরনের মনোভাবের উপর গুরুত্বারোপ করেছে:
১. কর্মসন্তুষ্টি (Job Satisfaction)
২. কর্ম সম্পৃক্ততা (Job Involvement)
৩. সাংগঠনিক প্রতিশ্রুতি (Job Commitment)
এ তিনটি মনোভাব সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হল :
১. কর্মসন্তুষ্টি: সাধারণভাবে কর্মসন্তুষ্টি বলতে বুঝায় কোনো ব্যক্তির তার কার্যের প্রতি সাধারণ মনোভাব। যে ব্যক্তি তার কর্মের প্রতি যত বেশি সন্তুষ্ট সে তত বেশি ঐ কর্মের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব ধারণ করে। বিপরীত ভাবে, যে ব্যক্তি কর্মের প্রতি অসন্তুষ্ট সে তার কর্মের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব ধারণ করে। যখন আমরা কর্মী মনোভাব নিয়ে কথা বলি তখন মূলত কর্মসন্তুষ্টির কথা বুঝাইনা। আসলে, সংগঠনে এ দুটি শব্দ বারংবার একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেহেতু সাংগঠনিক আচরণের গবেষকরা কর্মসন্তুষ্টির উপর অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন।
২. কর্ম সম্পৃক্ততা: সাংগঠনিক আচরণ শিক্ষায় কর্মে সম্পৃক্ততা একটি সাম্প্রতিক সংযোজন। কর্মে সম্পৃক্ততার কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, কর্মে সম্পৃক্ততা হচ্ছে একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে তার কর্মের সাথে কতখানি জড়িত তা পরিমাপ এবং পরিমাপকৃত মাত্রা অনুযায়ী ব্যক্তি তার কর্মক্ষমতা নির্ধারণ করে। যে ব্যক্তি নিজেকে কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিতে পারে সে স্বাভাবিকভাবেই ঐ নির্দিষ্ট কাজটি মন দিয়ে করতে পারে ।
কর্মস্থলে অনুপস্থিতি এবং পদত্যাগের হার সরাসরি ভাবে কর্ম সম্পৃক্ততার সাথে জড়িত। যদি কর্মীরা তার কর্মের সাথে উচ্চমাত্রায় সম্পৃক্ত থাকে তাহলে অনুপস্থিতির হার যেমন কমে তেমনি ঐ কর্মস্থল ত্যাগ করার প্রবণতাও অনেকাংশে কমে আসে।
৩. সাংগঠনিক প্রতিশ্রুতি: কর্মীদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও তার লক্ষ্যের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় এবং সেই প্রতিষ্ঠানে নিজেকে সম্পৃক্ত করার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। এ মনোভাবকে সাংগঠনিক আচরণের ভাষায় সাংগঠনিক প্রতিশ্রুতি বলা হয়। সুতরাং, কর্মে সম্পৃক্ততা বলতে বুঝায়, কর্মীদের কর্মের প্রতি নিজেকে সম্পৃক্ত করার মনোভাব এবং সাংগঠনিক প্রতিশ্রুতি বলতে বুঝায়, নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। কর্মীর কর্মের প্রতি তার সম্পৃক্ততার মনোভাবের ক্ষেত্রে সংগঠনের প্রতি কোন ধরনের প্রতিশ্রুতি নাও থাকতে পারে। কিন্তু, সংগঠনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা মনোভাবের ক্ষেত্রে কর্মী যেমন কর্মের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ঠিক তেমনি সংগঠনের প্রতিও সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে ।
জ্ঞানীয় অসঙ্গতি তত্ত্ব
Cognitive Dissonance Theory
মার্কিন সামাজিক মনস্তাত্বিক লিওন ফেস্টিঙ্গার (Leon Festinger) পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে তাঁর বিখ্যাত জ্ঞানীয় অসঙ্গতি তত্ত্ব উত্থাপন করেন। এ তত্ত্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, একজন ব্যক্তি তার উপলব্ধির সাথে কীভাবে ও কেন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে বা স্ববিরোধী মনোভাব পোষণ করেন। মানুষ জেনে বা না জেনে একই সঙ্গে স্ববিরোধী ধারণা বা বিশ্বাস পোষণ করেন, যা তাদের অন্যায় আচরণের দিকে ঠেলে দেয়। এ পরিস্থিতিতে মানসিক স্বস্তির জন্য স্ববিরোধী চিন্তা বা বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো হয় বা তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়। মূলত এ তত্ত্ব মানুষ কীভাবে তার অভ্যন্তরীণ সংহতির জন্য সংগ্রাম করে তার উপর আলোকপাত করে।
সাধারণত ব্যক্তির মধ্যে অসঙ্গতি দেখা দেয় যখন সে মানসিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত বা দুর্বল হয়। এ সময় ব্যক্তির মনোভাব ও আচরণের মধ্যে তারতম্য দেখা দেয়। এ তত্ত্ব মনোভাব এবং আচরণের মধ্যকার সংযোগ স্থাপন কীভাবে হয় তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। জ্ঞানীয় অসঙ্গতি বলতে যেকোনো অসঙ্গতিকে বোঝায়- যখন কোনো ব্যক্তি দুই বা ততোধিক মনোভাব কিংবা আচরণ এবং মনোভাব একই সাথে ধারণ করে। ফেস্টিঙ্গার যুক্তি দেন, যেকোনো ধরনের অসংগতি অস্বস্তিকর এবং ব্যক্তি তার মধ্যকার বিদ্যমান অস্বস্তি কমিয়ে আনার জন্য ঐ অসঙ্গতিগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করে ।
কোনো ব্যক্তিই সম্পূর্ণভাবে অসংগতিকে এড়িয়ে চলতে পারেনা। উদাহরণস্বরূপ, আপনি আপনার সন্তানকে খাবারের পর সবসময় দাঁতব্রাশ করার কথা বলছেন কিন্তু আপনি নিজে তা করেননা। এক্ষেত্রে আপনার মনোভাবে যেমন অসংগতি রয়েছে তেমনি আপনার মনোভাব ও আচরণ দুটোই স্ববিরোধী। যে উপাদানগুলো আপনার মধ্যে অসংগতি তৈরি করছে সেগুলি যদি তুলনামূলকভাবে কমগুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে এ অসামঞ্জস্যতা দূর করার প্রয়াসও কম হয়। আবার, প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানগুলো যদি নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য হয়, মনোভাব পরিবর্তনের খুব একটা আগ্রহ ব্যক্তির মধ্যে থাকেনা।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions