মৌলিক অধিকার কি
যে সব অধিকার সংবিধানে উল্লেখ থাকে এবং সরকার কর্তৃক অলঙ্ঘনীয় সেগুলোকে মৌলিক অধিকার বলে। এসব সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার রাষ্ট্রের সংবিধানে উল্লেখ থাকে। মৌলিক অধিকারের মাধ্যমে নাগরিকরা সুসভ্যভাবে জীবন-যাপন করতে পারে। এ অধিকার সরকারের স্বৈরাচার রোধ করে। যে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানে মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত থাকে। যেমন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হল-
১. আইনের দৃষ্টিতে সমতা: সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী।
২. সমানাধিকার: ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমানাধিকার লাভ করবে। নারী, শিশু ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য রাষ্ট্র বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারবে।
৩, সরকারী নিয়োগলাভের সুযোগে সমতা: বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক সরকারী নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। অর্থাৎ ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য থাকবে না।
৪. আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার: বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক আইনের আশ্রয় লাভ করতে পারবে। আইনের বিধান ব্যতীত কোন নাগরিকের জীবন, স্বাধীনতা, সম্মান ও সম্পত্তির হানি করা যাবে না।
৫. জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার: বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবনধারণ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। কোন ব্যক্তিকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
৬. গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ: গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে নাগরিকের কতগুলো রক্ষাকবচ রয়েছে। যেমন-
(i) গ্রেপ্তারের কারণ না জানিয়ে কোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
(ii) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি তার পছন্দ অনুযায়ী আইনজীবীর সাথে পরামর্শ ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারবে।
(iii) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে হাজির করতে হবে।
(iv) ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে চব্বিশ ঘন্টার বেশি প্রহরায় আটক রাখা যাবে না।
(v) বিদেশী শত্রু কিংবা নিবর্তনমূলক আটকের আইনে গ্রেপ্তার ব্যক্তির ক্ষেত্রে রক্ষাকবচগুলো প্রযোজ্য হবে না
৭. জোরপূর্বক শ্রম নিষিদ্ধ : কোন নাগরিককে জোরপূর্বক শ্রমে লিপ্ত করা যাবে না। অর্থাৎ সকল প্রকার জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধ। এ বিধান কোনভাবে লজ্জিত হলে তা আইনত: দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। তবে ফৌজদারী মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এবং জনকল্যাণার্থে উক্ত বিধান কার্যকর হবে না।
৮, বিচার ও দন্ড: প্রচলিত আইন ভঙ্গ করার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। এমনকি, আইনে নির্ধারিত দন্ড ব্যতীত অধিক দন্ড দেয়া যাবে না।
৯. চলাফেরার স্বাধীনতা: জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধি নিষেধ সাপেক্ষে প্রতিটি নাগরিক দেশের সর্বত্র অবাধে চলাফেরা, বসবাস ও বসতিস্থাপন করতে পারবে। এ ছাড়াও, দেশ ত্যাগ ও দেশে পুনঃপ্রবেশ করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
১০. সমাবেশের স্বাধীনতা: জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধি নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিক শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্রাবস্থায় সমবেত হবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার রয়েছে।
১১. সংগঠনের স্বাধীনতা: আইন সঙ্গত উপায়ে প্রত্যেক নাগরিক সমিতি বা সংঘ গঠন করতে পারবে। তবে এরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করা কিংবা এর সদস্য হওয়ার অধিকার থাকবে না, যদি ক) তা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। খ) তা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করে। গ) তা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গী কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে ঘটিত হয়। কিংবা ঐ সংগঠনের গঠন ও উদ্দেশ্য সংবিধান পরিপন্থী হয়।।
১২. চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা: প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা রয়েছে। তাছাড়া আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধি নিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা রয়েছে।
১৩. পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা: প্রত্যেক নাগরিক যোগ্যতা অনুযায়ী আইন সঙ্গত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণ এবং কারবার বা ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে। অর্থাৎ প্রত্যেক নাগরিক তার পছন্দ অনুযায়ী যেকোন বৈধ পেশা গ্রহণ করতে পারবে।
১৪. ধর্মীয় স্বাধীনতা: আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষ ক) প্রত্যেক নাগরিকের যেকোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রয়েছে।
১৫.সম্পত্তির অধিকার: আইন অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিক সম্পত্তি অর্জন, ধারণ ও হস্তান্তর করতে পারবে। আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাবে না।
১৬. গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের ক) প্রবেশ, তল্লাশী ও আটক থেকে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকবে। খ) চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে।
উল্লেখিত মৌলিক অধিকার ভোগের মাধ্যমে একদিকে নাগরিক জীবনের বিকাশ ঘটে। অন্যদিকে স্ব-স্ব কর্তব্য সম্পর্কে নাগরিকগণ সচেতন হয়। এর ফলশ্রুতিতে সরকার তার দায়িত্ব পালনে আরও সচেষ্ট হয়।
পরিশেষে বলা যায়, যেসব অধিকার সংবিধানে উল্লেখ থাকে এবং সরকার কর্তৃক অলঙ্ঘনীয় সেগুলোকে মৌলিক অধিকার বলে। বাংলাদেশের নাগরিকদের কয়েকটি মৌলিক অধিকার হল আইনের দৃষ্টিতে সমতা লাভ, সরকারি নিয়োগলাভের অধিকার, আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ, চলাফেরার স্বাধীনতা প্রভৃতি।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions