রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি
রাজনৈতিক সংস্কৃতি: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি বহুল ব্যবহৃত প্রত্যয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলতে বুঝায় এমন কতগুলো বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, আবেগ এবং অনুশীলন যা একজন ব্যক্তির বা একটি জনসমষ্টির রাজনৈতিক আচরণকে গড়ে তোলে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার রাজনৈতিক আদর্শ এবং কর্মপদ্ধতিকেও অন্তর্ভুক্ত করে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির আধুনিক ধারণাটি গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড (G, A. Almond) এবং সিডনি ভার্বা (Sydney Verba) প্রথম গঠনমূলকভাবে Civic Culture নামক গ্রন্থে বিশ্লেষণ করেছেন:
অ্যালমন্ড এর মতে, “রাজনৈতিক সংস্কৃতি হল রাজনৈতিক ব্যবস্থার সদস্যদের রাজনীতি সম্পর্কে মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির বিন্যাস।”
সিডনি ভাবা বলেন, “পরীক্ষালব্ধ বিশ্বাস, প্রকাশযোগ্য প্রতীক এবং মূল্যবোধের সমষ্টিই হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি যা রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের পরিধি ব্যাখ্যা করে।”
রাজনৈতিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য
একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবেশ অর্থাৎ সকল উপাদানের সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ ঘটে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেমন এর জনগণের বিশ্বাস, আচার-আচরণের অনুশীলনের সমষ্টি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি তেমনি আবার জনগণের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণও করে। এসব বিবেচনায় রাজনৈতিক সংস্কৃতির নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়:
রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি
একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্রীড়নক, সংগঠক থেকে শুরু করে সাধারণ সদস্য পর্যন্ত সকলের বিশ্বাস অর্থাৎ অনুশীলনের একটি ছবি ফুটে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান | নির্ধারণ করা হয়। যেমন, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যদি সকলের অংশ থাকে, মত প্রকাশের সুযোগ-সুবিধা থাকে তবে তাকে উন্নত বা অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলে। আর এসব সুযোগ না থাকলে তা নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবেই পরিগণিত হয়।
মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপ
প্রত্যেকের আচার-আচরণ দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যবোধের সমষ্টিগত বহি:প্রকাশ ঘটে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। এসব মনস্তাত্ত্বিক বিষয় পরিবর্তন সাপেক্ষে একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটা সম্ভব।
সমরূপতা ও ঐক্যমত
সাধারণত কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমরূপতা ও ঐক্যমত্যের বহি:প্রকাশকেও সে ব্যবস্থার রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার সদস্যরা সে ব্যবস্থাটি সম্পর্কে যে ধরনের মনোভাব পোষণ করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিও সে ধরনের হয়।
অনুভূতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি
রাজনৈতিক পরিমন্ডল সম্পর্কে মানুষের অনুভূতিই আসলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকারভেদ
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভিন্ন-ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিন্যাস করেছেন। গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড ও সিডনি ভার্বার মতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি মূলত তিন ধরনের- (১) নিম্নমানের (Parochial) রাজনৈতিক সংস্কৃতি (২) অধীন (Subjective) রাজনৈতিক সংস্কৃতি (৩) অংশগ্রহণমূলক (Participatory) রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
যে ব্যবস্থাতে নাগরিকেরা রাষ্ট্রের কর্মকান্ড সম্পর্কে তেমন কোন খবরাখবর রাখেন না; রাজনীতি সম্পর্কে আদৌ উৎসাহ বোধ করেন না এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহনের পরিবেশ থাকে না, সে ধরনের ব্যবস্থাকে নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
যে ব্যবস্থায় নাগরিকেরা রাজনীতি ও রাষ্ট্রের কর্মকান্ড সম্পর্কে অবহিত থাকা সত্ত্বেও এসব বিষয়ে অংশগ্রহণের সীমিত সুযোগ ভোগ করে, সে ধরনের ব্যবস্থাতে অধীন রাজনৈতিক সংস্কৃতি রয়েছে বলা যায়। যে ব্যবস্থাতে নাগরিকেরা রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে এবং এসব বিষয়ে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম, সে ধরনের ব্যবস্থাকে অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
অ্যারল্ড লিজপহার্টের মতো পন্ডিত অবশ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: গণ (Mass) রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও এলিট (Elite) রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
সর্বশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থারই সার্বিক গুণের বহিঃপ্রকাশ। কোন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চিরকাল এক রকম থাকে না। রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলোতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঞ্চার হলে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান উন্নত হতে থাকে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions