সমাজকর্ম কাকে বলে বা সমাজকর্ম কি
সমাজকর্ম কাকে বলে বা সমাজকর্ম কি : সমাজকর্ম হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিনির্ভর একটি সাহায্যকারী ও সক্ষমকারী পেশা, যা সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি, দল ও সমষ্টি তথা মানুষকে এমনভাবে সাহায্য করে যাতে মানুষ তার বস্তুগত ও অবস্তুগত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেই নিজেদের সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়ে উঠে। সমাজকর্ম ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সম্পদ ও অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগ্রত করে এবং সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। তাই সমাজকর্মকে empowering পেশা হিসেবে অভিহিত করা হয়। আধুনিক শিল্পসমাজের বহুমুখী ও জটিল সমস্যা মোকাবিলার জন্য সমাজকর্ম পেশার উদ্ভব হয়েছে; যদিও পেশাদার তথা আধুনিক সমাজকর্মের শিকড় প্রথিত রয়েছে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় পরিকল্পিত সেচ্ছাসেবী সমাজসেবা কার্যক্রম ও প্রচেষ্টার মধ্যে।
সমাজকর্ম একটি বিজ্ঞান ও কলা, যা ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিনির্ভর প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত কর্মকাণ্ড পরিচলিত করে। শিল্পভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হওয়ার প্রেক্ষাপটে সমাজকর্ম পেশার আবির্ভাব হয়েছে। সমাজকর্ম সামাজিক বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা যার সূচনা ও বিকাশ একদিনে হয়নি। বস্তুত সর্বজনীন মানবমর্যাদা ও মানবাধিকারকে সমুন্নত রেখে মানবকল্যাণ নিশ্চিতকরণ প্রচেষ্টার একটি অংশ হিসেবে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, নৃ-বিজ্ঞান, মনোচিকিৎসাসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার জ্ঞান ও দক্ষতার সমন্বয়ে সমাজকর্ম একটি সমন্বিত ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। শিল্পবিপ্লবোত্তর সময়ে মানুষের জীবনযাত্রার সামাজিক ও অর্থনৈতিক গতিশীলতার পাশাপাশি সৃষ্টি হয় মনো-সামাজিক সংকট ও সমস্যা। এই সংকট ও সমস্যা ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করলে প্রচলিত সমাজকল্যাণ ও সমাজসেবা অপ্রতুল, অপর্যাপ্ত ও অকার্যকর হয়ে উঠে। এই প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিনির্ভর সাহায্য ও সেবামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এর ফলশ্রুতিতে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দক্ষতানির্ভর পেশাগত কর্মকাণ্ড হিসেবে সমাজকর্মের সূচনা হয়। ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম সমাজকর্মের সূত্রপাত হলেও আমেরিকায় পেশাদার সমাজকর্মের ধারণা, পদ্ধতি ও কৌশল পূর্ণতা লাভ করেছে। সমাজকর্মের বিকাশে যাঁরা বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁরা হলেন জ্যান এড্যামস (Jane Addams ) (১৮৬০-১৯৩৫), ম্যারী এ্যালেন রিচমন্ড (Mary Ellen Richmond) (১৮৬১–১৯২৮) এবং উইলিয়াম হ্যানরি বিভারিজ (William Henry Beveridge) (১৮৭৯-১৯৬৩)। সমাজকর্ম মূলত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নির্ভর একটি পেশাগত কর্মকাণ্ড, যা মানুষকে তার সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার সংরক্ষণ, সমৃদ্ধিকরণ, উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধারে সক্রিয় ও সক্ষম করে অনুকূল সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে।
সমাজকর্মের সংজ্ঞা
সমাজকর্ম হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও কৌশলনির্ভর একটি পেশাগত কর্মকাণ্ড ও প্রক্রিয়া, যা সামাজিক কল্যাণ (Social Betterment) আনয়নে প্রয়াস চালায়। আমেরিকার National Association of Social Workers (NASW) কর্তৃক প্রকাশিত সমাজকর্ম অভিধানের (১৯৯৫) সংজ্ঞানুযায়ী, “সমাজকর্ম হলো ব্যক্তি, দল ও সমষ্টিকে সাহায্য করার এক পেশাগত কর্মকাণ্ড, যা তাদের সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতাকে পুনরুদ্ধার ও শক্তিশালী করে এবং সামাজিক পরিবেশকে এই লক্ষ্যের উপযোগী করে গড়ে তোলে।” (Social work is the professional activity of helping individual, groups or communities to enhance or restore, their capacity for social functioning and creating societal conditions favourable to this goal.) NG NASW কর্তৃক প্রদত্ত এই সংজ্ঞাটি বহুল প্রচলিত।
ওয়াল্টার এ. ফ্রিডল্যান্ডার (Walter A. Friedlander) (১৯৯৬) তাঁর Introduction to Social Welfare” গ্রন্থে বলেন, “সমাজকর্ম হলো মানবীয় সম্পর্ক বিষয়ক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দক্ষতাভিত্তিক এমন এক পেশাদার সেবাকর্ম, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক সন্তুষ্টি এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একক বা দলীয়ভাবে ব্যক্তিকে সহায়তা করে।” (Social work is a professional service, based upon scientific knowledge and skills in human relations, which assists individuals, alone or in groups, to obtain social and personal satisfaction and independence.)
আরমান্ডো টি. মোরেলস এবং ব্রাডফোর্ড ডব্লিউ শেফর (Armando T. Morales & Bradford W. Sheafor) (1986 : 18) তাঁদের Social Work: A Profession of Many Faces” গ্রন্থে বলেন, “সমাজকর্ম ক্রমবর্ধমান সমাজের জটিলরুপ ধারনকারী সমস্যা সমাধানের জন্য সৃষ্ট একটি ব্যবস্থা যা সমাজের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত আন্তক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যকরভাবে তাদের চাহিদা পূরণকে জটিল করে তোলে।” (Social work has been a product of an increasingly complex world that makes it difficult for people to meet their needs effectively through conventional interaction with family, friends, neighbors and the various social institutions.) তাঁরা বলেন, সমাজকর্ম একটি বহুমুখী পেশা। (Social work is a profession of many faces.)
সমাজকর্ম বিশ্বকোষ (Encyclopedia of Social Work) এর ব্যাখ্যানুযায়ী, “সমাজকর্ম হলো এমন একটি সুসংগঠিত প্রচেষ্টা যা ব্যক্তি ও পরিবারকে সমষ্টির সাথে সামঞ্জস্যবিধানে সহায়তা করে এবং একইভাবে সমষ্টিকেও ব্যক্তি ও পরিবারের প্রয়োজন পূরণে উপযোগী করে তোলে।” (Social work is an organized effort to help individuals and families to adjust themselves to the community as well as to adapt the community to the needs of such persons and family.)
International Federation of Social Workers-IFSW (২০১৪) এর সংজ্ঞানুযায়ী, “সমাজকর্ম হলো অনুশীলনভিত্তিক একটি পেশা ও জ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা যা সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন, সামাজিক সংহতি এবং জনগণের সক্ষমতা ও স্বাধীনতার উন্নয়ন সাধিত করে। সামাজিক ন্যায়-বিচার, মানবাধিকার, সামষ্টিক দায়িত্ববোধ এবং বৈচিত্র্যময়তার প্রতি সম্মানবোধের নীতিমালা সমাজকর্মের মূল কেন্দ্রবিন্দু।” (Social work is a practice-based profession and an academic discipline that promotes social change and development, social cohesion, and the empowerment and liberation of people. Principles of social justice, human rights, collective responsibility and respect for diversities are central to social work.)
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, সমাজকর্ম হচ্ছে একটি পেশাগত প্রক্রিয়া, যা মানুষের ব্যক্তিগত, দলীয় ও সমষ্টিগত ক্ষেত্রে পরিকল্পিত পরিবর্তন আনয়ন, মানবীয় শক্তি-সামর্থ্য বাড়ানো ও পুনরুদ্ধার করা এবং এক্ষেত্রে অনুকূল সামাজিক পরিবেশ গড়ে তুলে সাহায্যার্থীর ক্ষমতায়ন ও সক্ষমতা লাভে সহায়তা করে। অন্যভাবে বলা যায় যে, সমাজকর্ম একটি সাহায্যকারী প্রক্রিয়া ও পেশা, যা কতগুলো পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষের সমস্যার টেকসই সমাধান করে এবং ব্যক্তিগত, দলীয় এবং সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নে সক্ষম করে তুলতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions