ওয়াকফ কি? বা ওয়াকফ কাকে বলে?
সনাতন সমাজকল্যাণের প্রাতিষ্ঠানিক রূপের পরিচায়ক হলো ওয়াক্ফ। ইসলামে ওয়াক্ফ সমাজকল্যাণের অন্যতম প্রতিষ্ঠান। যেসব ঐতিহ্যগত সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান সমাজসেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে তার মধ্যে ওয়াক্ফ অন্যতম। ওয়াক্ফ এর শাব্দিক অর্থ হলো আটক; এখানে আটক বলতে দায়কৃত সম্পদের মালিকানা নির্দিষ্ট করাকে বোঝানো হয়েছে। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের আশায় ধর্মীয় বা জনহিতকর কোনো কাজে মুসলমান কর্তৃক তার সম্পত্তির আংশিক বা সম্পূর্ণ স্বত্ব ত্যাগ করে দান করাকে ওয়াক্ফ বলে । ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের মতানুযায়ী, ওয়াক্ফ অর্থ উৎসগকৃত বস্তুতে ওয়াক্ফকারীর মালিকানার পরিসমাপ্তি এবং তা আল্লাহর অন্তর্নিহিত মালিকানা দ্বারা আটক হওয়া। যাতে এর আয় মানবজাতির কল্যাণের জন্য নিয়োগ করা যেতে পারে। ইমাম আবু হানিফা (রা.) এর মতে, ওয়াক্ফ শব্দের অর্থ হলো কোনো নির্দিষ্ট ওয়াকিফ অর্থাৎ ওয়াক্ফকারীর মালিকানা আটক করে তার আয় দরিদ্রদের দান করা বা অন্য কোনো সৎ উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা।
প্রকৃতিগত দিক থেকে ওয়াক্ফ দুই ধরনের হয়ে থাকে।
১) ওয়াক্ফ-ই-খায়রী ও ২) ওয়াক্ফ-ই-আহলী।
আবার ব্যবহারিক দিক থেকে ওয়াক্ফ তিন ধরনের যেমন- ক) ওয়াক্ফ-ই-খায়রী, খ) ওয়াকফ-ই-আহলী ও গ) ওয়াক্ফ-ই-লিল্লাহ।
ক. ওয়াক্ফ-ই-খায়রী হলো যখন কোনো মুসলিম তার সম্পত্তি বা সম্পত্তির আয় সম্পূর্ণরূপে কোনো জনহিতকরণ কাজে দান করেন তখন তাকে ওয়াক্ফ-ই-খায়রী বলে। এই ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির মাধ্যমে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এতিমখানা প্রভৃতি কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে থাকে।
খ. ওয়াক্ফ-ই-আহলী হলো যখন কোনো ওয়াক্ফকারী তার বংশধর বা আত্মীয়-স্বজনদের কল্যাণে সম্পত্তি বা তার অংশবিশেষ ওয়াক্ফ এর মাধ্যমে দান করেন তখন তাকে ওয়াক্ফ-ই-আহলী বলে। যেমন— পিতৃমাতৃহীন নাতী-নাতনীদের দাদা কর্তৃক এরূপ ওয়াক্ফ করা হয়।
গ. ওয়াক্ফ-ই-লিল্লাহ হলো যখন সম্পূর্ণ ধর্মীয় কাজে কোনো মুসলমান তার সম্পত্তি ওয়াক্ফ করেন তখন তাকে ওয়াক্ফ- ই-লিল্লাহ বলে । যেমন- মসজিদ, ঈদগাহ, কবরস্থান ইত্যাদির জন্য দান করা এ জাতীয় ওয়াক্ফ এর অন্তর্ভুক্ত।
ওয়াক্ফ এর বৈশিষ্ট্য ওয়াক্ফ এর বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো :
ক. ওয়াক্ফ অনেকটাই সর্বজনীন;
খ. এটির আইনগত ভিত্তি আছে;
গ. মুসলিম আইনে এটি স্বীকৃত;
ঘ. ওয়াফের সম্পত্তি স্থাবর-অস্থাবর উভয় প্রকার হতে পারে; ৫. ওয়াক্ফ শর্তযুক্ত হয় ;
চ. ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে;
ছ. ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের জন্য ট্রাস্টি বোর্ড থাকে; এবং জ. এটি একটি জনসেবামূলক ও নিরাপত্তামূলক প্রতিষ্ঠান।
সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়াক্ফ’র গুরুত্ব
সমাজকল্যাণমূলক কাজে সহায়তা করার প্রয়াসেই ওয়াক্ফ প্রত্যয়টির উদ্ভব ঘটে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশেও দুঃস্থ, অসহায় ও বঞ্চিত শ্রেণির রক্ষণাবেক্ষণ, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে অসংখ্য ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠান কর্মরত রয়েছে। এগুলো সমাজসেবার ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছে। এছাড়াও-
১. ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির দ্বারা বহু জনকল্যাণমূলক কার্যাবলী পরিচালিত হয়। সম্প্রতি অনেক এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং, লঙ্গরখানা, দাতব্য চিকিৎসালয় ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে।
২. ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির আয় থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন— পুকুরখনন, খালখনন ও কূপখনন এবং খানকা ও দরবার শরীফ ইত্যাদি পরিচালিত হচ্ছে, যা মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি সাধনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৩. ওয়াক্ফ সম্পত্তির দ্বারা শিক্ষা কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করা হয়। যেমন- স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ইত্যাদি পরিচালনা, ছাত্রবৃত্তি প্রদানও এর অন্তর্ভুক্ত।
৪. আশ্রয়দান এর ক্ষেত্রে সরাইখানা, লঙ্গরখানা প্রভৃতি স্থাপন ও পরিচালনা এবং গরীব ও দুস্থদের আশ্রয় ও সহায়তা প্রদান হয় ওয়াক্ফ এর মাধ্যমে।
৫. বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির মধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল, আনজুমান মফিদুল ইসলাম, হামদর্দ দাওয়াখানা প্রভৃতির অবদান গুরুত্বপূর্ণ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions