সমাজবিজ্ঞান চর্চার পটভূমি
মানব সমাজকে বুঝতে হলে এবং সমাজ কাঠামো অনুধাবন করতে হলে সমাজবিজ্ঞান চর্চার বিকল্প নেই । সমাজ কাঠামো, সামাজিক পরিবর্তনের গতিধারা, সামাজিক পরিবর্তনের কারণ, সামাজিক সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়াদি, পরিবার, রাষ্ট্র, সম্পত্তি, সামাজিক শ্রেণি, ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা এবং বিশ্লেষণে সমাজবিজ্ঞান চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা এবং এর গতি প্রকৃতি সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়নের পটভূমি তৈরি করেছে। বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি, সংস্কৃতির পরিবর্তন, সামাজিক পরিবর্তন, রাজনীতির দর্শন, ঐতিহাসিক দর্শন ইত্যাদি বিষয় সমাজবিজ্ঞান চর্চার পটভূমি তৈরি করেছে ।
খ্রিস্টের জন্মের পূর্ব থেকেই সমাজবিজ্ঞান চর্চার প্রমাণ ভারতীয় উপমহাদেশে রয়েছে। ভারতীয় দার্শনিক কৌটিল্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০-২৭৫ অব্দ) গভীরভাবে সমাজ কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র' গ্রন্থে তৎকালীন ভারতের আইন, রাষ্ট্র, রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, সমাজনীতি ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয়সমূহ আলোচনা করেন। গ্রিক পণ্ডিত প্লেটো (খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭-৩৪৭ অব্দ), এরিস্টটল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২ অব্দ) প্রমুখের সমাজচিন্তা সমাজবিজ্ঞান উদ্ভবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। মধ্যযুগের বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ ইবনে খালদুন সমাজচিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেছেন। অনেকের মতে তিনিই সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃত জনক। কিন্তু ফরাসি সমাজচিন্তাবিদ অগাস্ট কোঁতকে সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। যেহেতু ১৮৩৯ সালে তিনিই প্রথম সমাজবিজ্ঞান শব্দটি ব্যবহার করেন ।
কার্ল মার্কস উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের আলোকে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের বিষয়ে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি তাঁর আলোচনায় নির্দিষ্ট একটি উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত একটি সমাজব্যবস্থাকে চিহ্নিত করেছেন। সমাজ বিকাশের ধারায় তাঁর উৎপাদন ব্যবস্থা বিষয়ক আলোচ্য স্তরগুলো হলো, আদিম সাম্যবাদী উৎপাদন পদ্ধতি (Primitive Communal Mode of Production); দাস উৎপাদন পদ্ধতি (The Slave Mode of Production); সামন্তবাদী উৎপাদন পদ্ধতি (The Feudal Mode of Production); পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি (The Capitalist Mode of Production), সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি (The Socialistic Mode of Production) এবং সাম্যবাদী উৎপাদন পদ্ধতি (The Communist Mode of Production)। কার্ল মার্কসের উৎপাদন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হলো এশিয় উৎপাদন ব্যবস্থা (Asian Mode of Production)। এশিয় উৎপাদন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য অন্যান্য উৎপাদন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য থেকে আলাদা । এটি মূলত এমন একটি উৎপাদন ব্যবস্থা যা শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এ উৎপাদন ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য ছিলো ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ সম্প্রদায় বা Self Sufficient Village Community.
যুগে যুগে অনেক পর্যটক, পরিব্রাজক, যোদ্ধা, ধর্ম প্রচারক এই বঙ্গভূমিতে এসেছেন। যেমন- হিউয়েন সাং, আবুল ফজল, আলবেরুনি, ইবনে বতুতা প্রমুখ। তাঁদের লেখায় তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনা পাওয়া যায়। এদেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি, কৃষি, শিল্প, সমাজের বৈচিত্র্য, সমাজ কাঠামো, পরিবার, বিবাহ, জ্ঞাতি সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে
তাঁরা বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁদের আলোচনায় সামাজিক প্রেক্ষাপট, সমাজকাঠামো, সামাজিক স্তরবিন্যাস, শ্রেণি কাঠামো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় নি, যা সমাজবিজ্ঞান চর্চায় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে ।
ইংরেজদের হাতে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পর ব্রিটিশ কোম্পানির শাসন ও ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলার অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, সমাজকাঠামো ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চায় নতুন ধ্যান ধারণার তৈরি হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫৬ সালে সমাজবিজ্ঞান একটি আলাদা বিষয় হিসেবে পঠন-পাঠন শুরু হয়। ১৯৪৭ এর দেশভাগ, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ সমাজবিজ্ঞান চর্চার আলাদা পটভূমি তৈরি করে ।
উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চার পটভূমি খুব বেশি দিন আগে তৈরি হয়নি। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন এদেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চার পটভূমি তৈরি করেছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions