সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার
মৌলিক অধিকার বলতে বোঝায়, রাষ্ট্র প্রদত্ত সেসব সুযোগ-সুবিধা যা নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য। সংবিধানের সংশোধন কিংবা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা ছাড়া মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা যায় না । সংবিধানে মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ থাকার কারণে এগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত। উত্তম সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে মৌলিক অধিকার সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করা। মৌলিক অধিকার নাগরিক জীবনের বিকাশ ও ব্যাপ্তির জন্য অত্যাবশ্যকীয় শর্ত।
সুতরাং মৌলিক অধিকার হল নাগরিক জীবনের ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য শর্ত, ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ যা সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত থাকে, সরকার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে না ।
বাংলাদেশ সংবিধানে সন্নিবেশিত মৌলিক অধিকারসমূহ:
আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার অন্তর্ভূক্ত থাকে। বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৭ নং অনুচ্ছেদ থেকে ৪৭ নং অনুচ্ছেদ পর্যন্ত মৌলিক অধিকারসমূহ সন্নিবেশিত রয়েছে। নিম্নে বাংলাদেশ সংবিধানে সন্নিবেশিত মৌলিক অধিকারসমূহ তুলে ধরা হল-
১. আইনের দৃষ্টিতে সমতা : সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। [অনুচ্ছেদ-২৭]
২. নানান কারণে বৈষম্য : ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে। কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না। [অনুচ্ছেদ-২৮(১), ২৮(২), ২৮(৩)]
৩. সরকারি নিয়োগলাভের সুযোগের সমতা : প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হবে না। কিংবা সে ক্ষেত্রে তাঁর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না। [অনুচ্ছেদ- ২৯(১), ২৯ (২)]
৪. বিদেশি খেতাব প্রভৃতি গ্রহণ নিষিদ্ধকরণ : রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদন ব্যতীত কোন নাগরিক কোন বিদেশি রাষ্ট্রের নিকট থেকে কোন খেতাব, সম্মান, পুরস্কার বা ভূষণ গ্রহণ করবে না। [অনুচ্ছেদ-৩০]
৫. আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার : আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত: আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। [অনুচ্ছে-৩১]
৬. জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ : আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না । [অনুচ্ছেদ-৩২]।
৭. গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ : গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁর মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শের ও তাঁর দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না। গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে হাজির করা হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাকে অতিরিক্ত সময় প্রহরায় আটক রাখা যাবে না। [অনুচ্ছেদ- ৩৩ (১), ৩৩(২), ৩৩ (৩ক)]
৮. জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ : সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ। এই বিধান কোনভাবে লঙ্ঘিত হলে তা আইনত: দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। তবে ফৌজদারি অপরাধের জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না। [অনুচ্ছেদ-৩৪ (১), ৩৪ (২ ক)]
৯. বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ : এক অপরাধের জন্য কোন ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারীতে সোপর্দ ও দণ্ডিত করা যাবে না। ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অদিকারী হবে। কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। [অনুচ্ছেদ- ৩৫(১), ৩৫ (২), ৩৫ (৩), ৩৫ (৪), ৩৫ (৫)]
১০. চলাফেরার স্বাধীনতা : জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতিস্থান এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। [অনুচ্ছেদ- ৩৬]
১১. সমাবেশের স্বাধীনতা : জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তি সঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। [অনুচ্ছেদ- ৩৭]
১১. সমাবেশের স্বাধীনতা : জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তি সঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে । [অনুচ্ছেদ- ৩৭]
১২. সংগঠনের স্বাধীনতা : জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে । [অনু-৩৮]
১৩. চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্স্বাধীনতা : বাংলাদেশ সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিককে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অন্যান্য আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হয় । [অনুচ্ছেদ- ৩৯(১), ৩৯ ২ক), ৩৯ ২খ)]
১৪. পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা : আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষে কোন পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায় পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোন যোগ্যতা নির্ধারিত হয়ে থাকলে অনুরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের এবং যে কোন আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায় পরিচালনার অধিকার থাকবে। [অনুচ্ছেদ- ৪০ ]
১৫. ধর্মীয় স্বাধীনতা : আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রয়েছে। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হলে তাঁকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসানায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করতে হবে না। [অনুচ্ছেদ- ৪১ (১), ৪১ ( ২ ), ৪১ (১ক), ৪১ (১খ)
১৬. সম্পত্তির অধিকার : আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর ও অন্যভাবে বিলি-ব্যবস্থা করার অধিকার থাকবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাবে না। [অনুচ্ছেদ- ৪২ (১)
১৭. গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ : রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের প্রবেশ, তল্লাশী ও আটক হতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকবে এবং চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তারক্ষার অধিকার থাকবে। [অনুচ্ছেদ ৪৩, ৪৩(ক), ৪৩(খ)]
১৮. মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ : বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে প্রদত্ত অধিকারসমূহ বলবৎ করার জন্য সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের নিকট মামলা রুজু করার অধিকারের নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। [অনুচ্ছেদ- ৪৪(১)]
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ সংবিধানে যে সকল মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত রয়েছে তা নাগরিকের জন্য কল্যাণকামী এবং যুগোপযোগী। সংবিধানে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত বিষয়াবলির ক্ষেত্রে দায় মুক্তির বিধান এবং কতিপয় আইনের হেফাজতের কথাও সন্নিবেশিত রয়েছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions