হাজী শরীয়তুল্লাহ
১৭৫৭ সালে পলাশীতে নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা এদেশের মানুষকে পরাধীনতার শিকলে বেঁধে ফেলে। শিকল ভাঙ্গার কাজটি করার জন্য যুগের পর যুগ যে সব ব্যক্তি লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন হাজী শরীয়তুল্লাহ তাদের মধ্যে একজন। হাজী শরীয়তুল্লাহ্ই প্রথম উপলব্ধি করেন যে ব্রিটিশ শোষণ ও উৎপীড়নের কবল থেকে রেহাই পেতে হলে এখানকার মুসলিম সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ শক্তিরূপে দাঁড়াতে হবে। আর এ কারণে ফরায়েজি ও ওয়াহাবিদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি একটি ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের ডাক দেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ্র আদর্শের প্রতি নিম্নবিত্ত মুসলমান পেশাজীবী শ্রেণীসমূহ আকৃষ্ট হয়। দরিদ্র রায়ত, কৃষক, তাঁতী ও তেলী সম্প্রদায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর পতাকাতলে জড়ো হয় ।
হাজী শরীয়তুল্লাহ্ জীবন বৃত্তান্ত
হাজী শরীয়তুল্লাহ ১৭৮১ সালে ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্গত শামাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাঁর নামানুসারে শরিয়তপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে। মাত্র আট বছর বয়সে পিতাকে হারানোর পর চাচার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন শরীয়তুল্লাহ্। কলকাতা ও হুগলীতে প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর তিনি আঠারো বছর বয়সে মক্কা গমন করেন। তিনি দীর্ঘ বিশ বছর মক্কায় অবস্থান করেন। সেখানে অবস্থানকালে তিনি ওয়াহাবি মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। ওয়াহাবি মতবাদের ভিত্তিতেই হাজী শরীয়তুল্লাহ্ তাঁর সংস্কারমূলক আন্দোলন শুরু করেন। সমাজ ও ধর্মীয় সংস্কারমূলক এই আন্দোলন এক পর্যায়ে অত্যাচারী জমিদারদের শোষণ হতে কৃষকদের মুক্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। হাজী শরীয়তুল্লাহ্র আন্দোলন পরবর্তীতে 'ফরায়েজি আন্দোলন' নামে পরিচিতি পায়। ফরায়েজি আন্দোলনের মাধ্যমেই তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আমৃত্যু সোচ্চার থাকেন। ১৮৪০ সালে শরীয়তুল্লাহ মৃত্যুবরণ করলে, পুত্র দুদু মিয়া ফরায়েজিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহর অবদান
ফরায়েজি মতাদর্শ: হাজী শরীয়তুল্লাহ তৎকালীন আরবের ওহাবিদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মানসে একটি ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের ডাক দেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বিদেশী “বিধর্মীদের” রাজত্বে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সম্ভব নয় । তিনি মনে করেন উৎপীড়নের কবল থেকে রেহাই পেতে হলে মুসলিম সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ শক্তিরূপে দাঁড়াতে হবে। এ জন্য ইসলাম ধর্মের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যসমূহ কার্যকর করতে হবে। আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্তব্যসমূহকে ফরজ বলা হয়। শরীয়তুল্লাহ মুসলমানদের স্থানীয় লোকাচার পালনের বিরোধী ছিলেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে, অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্তব্যসমূহকে কার্যকর করতে হাজী শরিয়তউল্লাহ ফরায়েজি মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করেন।
সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব: হাজী শরীয়তুল্লাহ ধর্মীয় চিন্তার পাশাপাশি মুসলিম সমাজ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মুসলিম সমাজে অসাম্য ও বর্ণ বা শ্রেণীভেদের কোন জায়গা নেই ।
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, ফরায়েজি আন্দোলন ইসলামী ধর্মের ভিত্তিতে হলেও এক পর্যায়ে এসে এটি একটি রাজনৈতিক প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে নীলকর ও জমিদারদের উৎপীড়নে মুসলমান কৃষক সম্প্রদায় যখন জর্জরিত তখন এই সম্প্রদায়কে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হাজী শরীয়তুল্লাহ, উদাত্ত আহবান জানান ।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions