সামাজিক পরিবর্তনে প্রযুক্তির প্রভাব
প্রযুক্তির একটি অবিস্মরণীয় বিপ্লব বিশ্বের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অঙ্গনে ব্যাপকতর পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করেছে। সারাবিশ্বের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় বাংলাদেশেও প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। স্বভাবতই বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে প্রযুক্তিবিদ্যারও অগ্রগতি ঘটছে। উন্নয়নের অন্যতম নিয়ামক বা উপাদান হলো তথ্য প্রযুক্তি। কৃষি এবং অকৃষি উভয় খাতেই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। সম্প্রতি বাংলাদেশে ই-কৃষি চালু হয়েছে যার সুফল সকল স্তরের কৃষক এবং ভোক্তা ভোগ করছে। একই সঙ্গে কৃষি উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বাজারজাতকরণের একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে। তবে উৎপাদন এবং পরিবহন প্রযুক্তি অপেক্ষা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সমাজ জীবনে বেশি প্রভাব বিস্তার করছে। আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো কম্পিউটার ও ইন্টারনেট। এ দুই প্রযুক্তির সম্মিলিত রূপ হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। উৎপাদন, পরিবহন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকেই স্পর্শ করে। সমাজের সর্বত্র এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তবে এ প্রভাব সব সময় ইতিবাচক না ও হতে পারে। প্রযুক্তির বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাবও সমাজে পরিলক্ষিত হয়। এখানে সামাজিক পরিবর্তনে প্রযুক্তির প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।
১) যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন: যোগাযোগ ক্ষেত্রে তথ্য ও প্রযুক্তি যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করেছে। দুই ধমক পূর্বে ও অফিসিয়াল যোগাযোগের জন্য যেখানে ফাইল পত্র নির্বাহ করতে মাসের পর মাস সময় লাগতো তা এখন অতি অল্প সময়ে বা কয়েক মিনিটে বা তার চেয়েও কম সময়ে সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদানের প্রয়োজনীয় উপাত্ত এবং ফাইলসমূহ ই-ফাইলিং এর মাধ্যমে স্থানান্তর করা হচ্ছে অতি অল্প সময়ে। এসবের ফলে একদিকে যেমন সময়ের অপচয় রোধ হচ্ছে অন্যদিকে যোগাযোগের গতিশীলতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে যা সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে সমাজ দ্রুত প্রযুক্তি নির্ভরতার দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাস পাচ্ছে।
২) উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিঃ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে অল্প জনবল দিয়ে অধিক কাজ করা সম্ভবপর হচ্ছে। ফলে কর্মী প্রতি ব্যয় কমেছে এবং এখন অল্প ব্যয়ে কর্মীর কাছ থেকে অনেক বেশী করে উৎপাদন পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে বিনিয়োগ কম লাগছে এবং কর্মী ব্যবস্থাপনা সহজ হয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে যা কার্যত অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
৩) ই-কৃষি: কৃষি উন্নয়নে তথ্যও যোগাযোগ প্রযুক্তি নব দিগন্তের সূচনা করেছে। কৃষি তথ্য, গবেষণা ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। আবহাওয়া, ফসল বপন ও পরিচর্যা, সার প্রয়োগের তথ্য, রোগবালাই দমন ইত্যাদি কৃষি তথ্য অনলাইনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কৃষকেরা জানতে পারছে; যা উৎপাদন বৃদ্ধি ও পণ্য বাজারজাত করতে সহায়তা করছে।
৪) ই-কমার্স: অনলাইন যোগাযোগ ব্যবস্থায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনাময় দিক হলো ই-কমার্স। ই-কমার্স হচ্ছে পণ্য কেনাবেচা ও আর্থিক লেনদেনের ইলেকট্রনিক সংস্করণ। ফলে অর্থনৈতিক লেনদেন ও বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় উদ্যোগের পথ সুগম হচ্ছে।
৫) ই-ব্যাংকিং: ব্যাংকিং একটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূল মাইলফলক। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ব্যাংকিং যাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও লেনদেন তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় ব্যাংকের কর্মদক্ষতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং সেবা অনলাইনে এটিএম বুথের মাধ্যমে দিন রাত ২৪ ঘন্টা লেনদেনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফরেন রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তি এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এ সবই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।
৬) ই-গভরনেন্স: সরকারি অনেক ধরনের সেবা অনলাইনে হচ্ছে। ফলে সরকারের নাগরিক সুবিধা জনগন সহজেই নিতে পারছে এবং সরকারের জবাবদিহিতা বাড়ছে। দেশের উন্নয়নের জন্য এ বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
৭) সচেতনতা বৃদ্ধিঃ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ঘরে ঘরে তথ্য পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে। ফলে ঘরে বসেই মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে পারছে যা তাদেরকে অধিকার বিষয়ে সচেতন করে তুলছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সুশাসন, নারীর ক্ষমতায়ন, মানবাধিকার রক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি হচ্ছে।
৮) নারীর ক্ষমতায়ন: নারীর ক্ষমতায়নেও তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে । অনেকে ঘরে বসেই উপার্জন করতে পারছেন। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার পাশাপাশি অধিকার সচেতনতা এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা কামনা (হতে পারে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে) করে নারী সমাজ নিজেদের সক্ষমতা অর্জন করতে পারছেন।
৯) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনমত তৈরি: ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মূলধারার গণমাধ্যম কোনো বিষয়কে কম গুরুত্ব দিলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাপক প্রচার পেতে পারে।
১০) বিনোদন: তথ্য প্রযুক্তি মানুষের বিনোদনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করছে। আবহমান গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতি অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিলো কিন্তু বর্তমানে আবার প্রযুক্তির কারণে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, পথ নাটক, যাত্রা, পুঁথি, জারি- সারি, যাত্রাপালা অনেকটাই সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। হলে গিয়ে সিনেমা দেখার আগ্রহও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ইউটিউব কিংবা মেমোরি কার্ডের মাধ্যমে সুবিধাজনক সময়ে পছন্দমত বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানসমূহ উপভোগের সুযোগ রয়েছে।
১১) আউটসোর্সিং: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে কর্মসংস্থানের বিষয়টিও নতুন মাত্রা পেয়েছে। এখন মানুষ অনলাইনে ঘরে বসেই অনেক কাজ করতে পারছে, ফলে অনেক কাজের ক্ষেত্রেই কর্মস্থলে বা অফিসে আসার প্রয়োজন হচ্ছে না। এতে করে বিনিয়োগকারীদের পক্ষে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দূরে থেকেও কর্মসংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে অনলাইন-ভিত্তিক এক বিশাল কর্মীবাহিনী গড়ে উঠেছে, যারা প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে কাজ করছে। এতে কর্মী ব্যয় একদিকে কমছে অন্যদিকে বিভিন্ন স্থানে কর্মী বা কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। এর ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুনমাত্রা যুক্ত হচ্ছে।
১২) শিক্ষাক্ষেত্রেঃ তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষাকে অত্যাধুনিক এবং গতিশীল করেছে। ঘরে বসেই বিশ্বের নামিদামী লাইব্রেরির বইপুস্তক পড়া যাচ্ছে। অনলাইন বা ই-লার্নিং এবং ই-বুক ব্যবহার করে উচ্চশিক্ষা এখন জনপ্রিয় । ছাত্র- ছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা অনলাইন হওয়ায় দূর দূরান্ত থেকে সব ধরনের যোগাযোগ অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষার ফলাফল প্রস্তুত ও প্রকাশ করা হয় অনলাইনে। এতে ভোগান্তি যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি কমেছে খরচ ও সময়ের বিড়ম্বনা। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তি আশীর্বাদ হিসেবে পরিগণিত।
১৩) চিকিৎসা ক্ষেত্রেঃ তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকেও উন্নত, সাশ্রয়ী ও কার্যকরী করেছে। মানুষ ঘরে বসেই অনেক সময় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসাও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারছে। ডাক্তারগণও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সঠিক রোগ নির্ণয় করে ফলপ্রসু চিকিৎসা দিতে পারছে। নতুন নতুন দূরারোগ্য ব্যাধির কারণ জানাসহ এসব রোগের কার্যকরী ঔষধ তৈরিও সম্ভব হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন সময় ও অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে, অন্যদিকে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে তথ্য প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব
আগেই বলা হয়েছে, প্রযুক্তির কিছু নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। প্রযুক্তি কিছু মানুষকে বেকার করে দেয়। প্রযুক্তির বিশ্বায়নের ফলে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি আক্রান্ত হয়। পর্ণোগ্রাফি মহামারী আকারে বিস্তার ঘটে। হ্যাকিংসহ দুর্নীতি ও প্রতারণার নতুন নতুন ক্ষেত্র চালু হয়েছে। পারিবারিক সম্পর্ক শিথিল হয়ে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময়ের অপচয় করার ফলে উৎপাদনশীল কিংবা সৃষ্টিশীল কাজে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে। পাশাপাশি অনেকের মানসিক এবং স্নাকুবিক অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হচ্ছে যা সমাজে নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতাও সৃষ্টি করছে। অনেকে ফেসবুককে নেশাদ্রব্যের সাথে তুলনা করেন। বস্তুত ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটি ‘ডিজুস প্রজন্ম’ তৈরি করছে যাদের অনেকে নৈতিক মূল্যবোধ ও আচরণবিধির কোনো তোয়াক্কা করে না। অন্য সংস্কৃতির নাটক, সিরিয়াল, সিনেমা ইত্যাদি সহজলভ্য হওয়ায় অনেকে নিজ সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। নাটক, সিরিয়াল কিংবা সিনেমায় বিভিন্ন ঘটনা দেখে অনেকে সন্ত্রাস, নেশা করা, ধর্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions