সামাজিক পরিবর্তনে বিশ্বায়নের প্রভাব
একবিংশ শতাব্দীর আলোচ্য বিষয় হলো বিশ্বায়ন। অনেকের মতে, এটা এমন একটি প্রক্রিয়া যা তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর বিকাশকে নির্দেশ করে। অনেকে মনে করেন, বিশ্বব্যাপী একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে পুঁজিবাদের সংযোজন হল বিশ্বায়ন। বিশ্বায়ন পৃথিবীর সমগ্র অধিবাসীদেরকে বিশ্বকে একটি বিশ্ব গ্রামে (Global village) পরিণত করেছে। এটি বিশ্বের জনগোষ্ঠীকে এনেছে কাছাকাছি আর করছে পরস্পর পরস্পরকে উপর নির্ভরশীল। বিশ্বায়ন সম্পর্কে ম্যাকগ্রে (McGrew) বলেন, ‘বিশ্বায়ন হলো হয় আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থার অন্তর্গত বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে বহুবিধ সংযোগ ও সম্পর্কের নিমিত্তক।' Oxford Dictionary of Business গ্রন্থে বলা হয়েছে, বিশ্বায়ন হল বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য বা সেবাসমূহের আন্তর্জাতিকরণের একটি প্রক্রিয়া। Andre Gunder Frank -এর মতে, ‘বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া যেমন বাণিজ্য এবং কর্মসংস্থানের, অর্থনীতি তেমনই, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পদ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করার প্রক্রিয়া যা পরস্পরকে প্রভাবিত করছে, আবার এগুলোর মাধ্যমে প্রভাবিত হচ্ছে।' আলব্রো (Albrow) বলেছেন, বিশ্বায়ন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মধ্যে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বস্তুত বিশ্বায়ন হল পুঁজিবাদের নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদের একটি প্রক্রিয়া বা অর্থনৈতিক কৌশল। বিশ্বায়নে তিনটি মৌলিক উপাদান পরিলক্ষিত হয়। এগুলো হচ্ছে, ক) পণ্যের অবাধ প্রবাহ, খ) তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং গ) শ্রমের অবাধ প্রবাহ ।
বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনে বিশ্বায়নের প্রভাব
বাংলাদেশে বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল ইতিবাচক ও নেতিবাচক:
বিশ্বায়নের ইতিবাচক ফলাফল
১. মুক্তবাজার অর্থনীতির সম্প্রসারণ: মুক্ত বাজার অর্থনীতি সম্প্রসারণের ফলে এই দেশের সাথে বিশ্বের অন্যদেশের নির্ভরশীলতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এর ফলে বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য অপর দেশে যেতে বাধা নেই। বিভিন্ন দেশের দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে মুক্ত বাজার অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটেছে।
২. প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে প্রতিযোগিতার সুযোগ পাচ্ছে। সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা থাকায় বাংলাদেশের মানুষের জীবনে অবদান রয়েছে ও সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩. যোগাযোগ ব্যবস্থা: বিশ্বায়নের অন্যতম ইতিবাচক দিক হল যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন। অতীতের সেই সনাতন যানবাহনের জায়গায় আধুনিক প্রযুক্তি ভিত্তিক দ্রুত গতিসম্পন্ন যানবাহনের ব্যাপকতা বাংলাদেশে লক্ষ্য করার মতো। এতে আভ্যন্তরীণ ও বহি:বিশ্বের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা অধিক গতিশীল হয়েছে।
৪. কর্মসংস্থান সৃষ্টি: বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশে বহুমুখী কোম্পানী এবং বিদেশী বিনিয়োগ বেড়ে গেছে। শিল্পখাতে ব্যাপক বিনিয়োগ থাকায় প্রচুর পরিমাণে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। ফলে দেশ বিদেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
৫. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: বিশ্বায়ন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বহুলাংশে গতিশীল করেছে।
৬. শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন: বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন সমগ্র বিশ্বের সমমানের এবং এদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হার বৃদ্ধির মাধ্যমে দক্ষ জনসমম্পদ তৈরি হচ্ছে যার ফলে দেশে বিদেশে কর্মসংস্থানের পথ সুগম হচ্ছে। বিশ্বায়নের ফলে একদেশ থেকে অন্যদেশে মেধাবীরা পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। তারা উন্নত প্রযুক্তির সাথে দিনদিন পরিচিত হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার হার ও গুণগত মান বাড়ছে।
৭. ব্যাংকিং ও বীমা ব্যবস্থার উন্নয়ন: ব্যাংকিং ও বীমা ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশ্বায়নের ভূমিকা অপরিসীম। সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যাংকিং ও বীমা ব্যবস্থার অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে লেনদেন থেকে শুরু করে ব্যাংক ও বীমার নানাবিধ ই-ক্যাশ, ই-ব্যাংকিং ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ফলে সেবার মান অনেকাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সময়, শ্রম ও অর্থের অপচয় হ্রাস পাচ্ছে।
৮. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: বিশ্বায়নের ইতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উপরও পড়ছে। এ ধরনের প্রক্রিয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার সংস্কার সাধিত হয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটছে। উন্নত প্রযুক্তিতে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
৯. মানব সম্পদের মাধ্যমে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন: মানব সম্পদ রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশ্বায়ন মানব সম্পদ উন্নয়ন ও রপ্তানিতে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এক সময় ছিলো বোঝাস্বরূপ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে খেন বাংলাদেশের জনগণের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে অন্যদেশে গমন করছে বিনিময়ে দেশীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখছে।
বিশ্বায়নের নেতিবাচক ফলাফল
১. সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন: বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদশে সমাজ ব্যবস্থা অতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। পারিবারিক ভাঙ্গন, বিবাহ বিচ্ছেদ, বিচ্ছিন্নতা, প্রবীন সমস্যা, মাদকাসক্তি, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ দিন দিন বেড়ে চলেছে।
২. পরিবেশ বিপর্যয়: বিশ্বায়নের প্রভাবে এদেশের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো অধিক মুনাফা লাভের আশায় তাদের অধিকাংশ শিল্প কারখানা ও ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট বাংলাদেশসহ অন্যান্য অনুন্নত দেশে স্তাপন করেছে অথচ বিজ্ঞানসম্মতভাবে বর্জ্য পরিশোধন করা হচ্ছে না। পাশাপাশি নগরায়ন ও শিল্পায়ন পরিবেশ দূষণ করছে।
৩. নব্য ঔপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার: বিশ্বায়ন প্রকিয়া ব্যবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য, বাজার ব্যবস্থাপনা, তথ্য প্রযুক্তি ও তাদের উন্নত পণ্য সামগ্রী রপ্তানীর নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশসহ অনুন্নত বিশ্বে নব্য ঔপনিবেশবাদ ধাচে বাজার ও মার্কেট সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে।
৪. জীবনযাত্রায় অস্থিরতা: বিশ্বায়নের ফলে পশ্চিমা বিশ্বের তথাকথিত উন্নত জীবনযাত্রা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদির প্রভাব জনজীবনে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। ফলে মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তন হচ্ছে। মূল্যবোধের পরিবর্তনের ফলে সামাজিক অনুশাসন হ্রাস পাচ্ছে।
৫. স্থানীয় উদ্যোগ বিকশিত হতে পারছে না: মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে উন্নত বিশ্ব বাংলাদেশসহ প্রান্তিক দেশগুলোতে অবাধে পণ্য, প্রযুক্তি ও সেবা বিপনন করে। এক্ষেত্রে স্থানীয় বা দেশীয় উৎপাদন, প্রযুক্তি ও সেবাখাত প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে রুগ্ন হয়ে পড়ছে, হারিয়ে যাচ্ছে।
৬. অপসংস্কৃতির বিস্তার: বিশ্বায়ন সমগ্র বিশ্বকে সমন্বয় ও সমন্বিত করেছে। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতিতে পার্থক্য রয়েছে। কোনো দেশের সংস্কৃতি অন্য একটি দেশের জন্য অপসংস্কৃতি বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে অনেক সময় অপসংস্কৃতি আমাদের দেশের মূলধারার সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
৭. অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে: বিশ্বায়নের সুফল পাচ্ছে এককভাবে শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলো। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া উন্নত দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। ফলে ধনী দেশগুলোর সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দরিদ্র দেশগুলো ক্রমশ দরিদ্র হতে থাকে। এক্ষেত্রে ধনী দেশগুলো বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে নিজ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটায়। অনুন্নত দেশগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ধনী দেশের বাজারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions