খিলাফত আন্দোলন
খিলাফত আন্দোলন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক ছিল অন্যতম। তুরস্কের প্রতি মিত্রশক্তি ( ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স) চরম অবমাননাকর দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল খিলাফত বাতিল ঘোষণা করা। তুর্কি সুলতানরা নিজেদের মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে দাবি করতেন। কিন্তু উসমানীয় সালতানাতের অবসান ঘটিয়ে তুরস্কে প্রজাতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হলে খিলাফতের অবসান ঘটে। ফলে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর মতই ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমরা তুরস্কের খলিফার সাম্রাজ্যের অবসান মেনে নিতে পারেনি। মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী আবুল কালাম আজাদ প্রমূখের নেতৃত্বে তুরস্ক বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের ন্যাক্কারজনক ভূমিকার নিন্দা করেন এবং সরকার বিরোধী এক শক্তিশালী আন্দোলনের ঘোষণা করেন। খিলাফতকে কেন্দ্র করে অর্থাৎ খিলাফতকে টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে আন্দোলন পরিচালিত হওয়ায় এটিকে ‘খিলাফত আন্দোলন' বলা হয়। উল্লেখ্য যে, ডঃ আনসারীর নেতৃত্বে ‘খিলাফত কমিটি' গঠিত হয় ১৯১৯ সালের ১৭ অক্টোবর । আর ঐ তারিখটি ‘খিলাফত দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯১৯ সালের ১৪ নভেম্বরে এ. কে. ফজলুল হকের সভাপতিত্বে খিলাফত বৈঠকের প্রথম অধিবেশন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে তুরস্কের অখণ্ডতা ও খলিফার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার দাবি করা হয়। সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় যে, এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি না পেলে মুসলমানগণ সরকারের সাথে অসহযোগ নীতি অনুসরণ করে চলবে। অবশ্য বেশ কয়েকজন কংগ্রেসি নেতাও খিলাফত বৈঠকে অংশ গ্রহণ করেছিল। মহাত্মা গান্ধীও খিলাফত বৈঠকের একটি সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং তিনি সভাপতির ভাষণে খিলাফত বিষয়ে কংগ্রেস সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। একই বছর ডিসেম্বর মাসে মাওলানা শওকত আলীর সভাপতিত্বে খিলাফতের দ্বিতীয় বৈঠক লক্ষ্মৌতে অনুষ্ঠিত হয় । এ বৈঠকে তুরস্ক ও খলিফার ব্যাপারে ভারতীয় মুসলমানদের মনোভাব জানানোর জন্য বড় লাট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর ধারাবহিকতায় ড. আনসারীর নেতৃত্বে হিন্দু ও মুসলিমদের একটি প্রতিনিধিদল ১৯২০ সালের জানুয়ারি মাসে বড়লাটের সাথে সাক্ষাৎ করে মুসলমানদের অভিযোগগুলো তুলে ধরেন। কিন্তু সরকার তাদের নিরাশ করেন এই বলে যে, জার্মানির অনুকূলে অস্ত্র ধারণ করার শাস্তি তুরস্ককে পেতেই হবে।
১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে আহূত খিলাফত সম্মেলন অসহযোগ আন্দোলনের উপর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং একটি প্রতিনিধিদলকে লন্ডনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মাওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান, কিন্তু তারা ব্যর্থ হন। ১৯২০ সালের মে মাসে তুরস্কের সঙ্গে মিত্রপক্ষের সেভার্সের চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার সংবাদ প্রচারিত হয়। এ সন্ধির শর্তগুলো এদেশের মুসলমানদের মধ্যে গভীর ক্ষোভ ও ঘৃণার সৃষ্টি করে। জুন মাসে খিলাফত কমিটি অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে।
এই কর্মসূচির মধ্যে ছিল:
যথা: ১) সরকারি খেতাব ও অবৈতনিক পদ বর্জন করা,
২) সরকারের বেসামরিক পদগুলো থেকে ইস্তফা দেয়া,
৩) পুলিশ ও সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করা
৪) খাজনা বন্ধ করা প্রভৃতি
উপরোক্ত কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় রংপুর, রাজশাহী, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় গ্রামবাসী খাজনা দিতে অস্বীকার করে। এছাড়াও ব্রিটিশ পণ্য, অফিস আদালত বয়কট করা হয়। ১৯২০ সালের পহেলা আগস্ট বিশালাকারে সারাদেশে হরতালসহ খিলাফত দাবি পালিত হয়। ব্রিটিশ সরকার খিলাফত ও রাওলাট আইন সম্পর্কে অনমনীয় মনোভাব অক্ষুন্ন রাখায় পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলন ও কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলন একীভূত হয়। ফলে এদুটি আন্দোলন মিলে গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় এবং মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, খিলাফত কমিটি, জমিয়ত-ই-উলামা-ই-হিন্দ প্রভৃতি দলের নেতৃত্ব এককভাবে গ্রহণ ও পরিচালনা করেন। আন্দোলন এতই গতিশীল ছিল যে, সারা দেশে ১৯২০ সালেই ২০০ এর অধিক ধর্মঘট সফলভাবে পালিত হয়। গান্ধীজী ও আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষ যোগদান করতে থাকে। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের গ্রন্থ রচয়িতা অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল্লাহর ভাষায়, এ তিনজন (আলী ভ্রাতৃদ্বয় ও গান্ধী) তখন পরিণত হয়েছিল মুকুটহীন ভারত সম্রাটে। ১৯২১ সালে আন্দোলন তীব্ররূপ ধারণ করে। কোন কোন জায়গায় অহিংস আন্দোলন সহিংসতায় রূপান্তরিত হয়। ফলে সরকার দমননীতি পুরোপুরি ভাবে প্রয়োগ করতে থাকে। ১৯২১ সালেই মাওলানা মোহম্মদ আলী, মাওলানা আজাদ, চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহেরু প্রমূখকে সহ প্রায় ২০ হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার ঐ বছরই খিলাফত আন্দোলনকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং সেই সাথে দমননীতিকে আরো সম্প্রসারিত করে। ফলে ধীরে ধীরে আন্দোলন ম্রিয়মান হতে থাকে ।
খিলাফত আন্দোলনের ফলাফল ও গুরুত্ব
খিলাফত আন্দোলন তার চাহিদা অনুযায়ী পরিণতি লাভ করতে পারেনি। এর বড়ো কারণ হলো- এই দাবিটি সময়োপযোগী ছিল না। কেননা এটি শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মাথা ব্যাথার কারণ ছিল না । এটি ছিল সারা বিশ্বের মুসলমানদের সমস্যা। কিন্তু আরবদেশ গুলো থেকে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। আবার যোগ্য নেতৃত্বের অভাবও আন্দোলনকে সফল পরিণতি দেয়নি। কারণ আলী ভাতৃদ্বয় বার বার গ্রেফতার হওয়ায় আন্দোলন পালহীন নৌকার মত দিকবিদিক চলেছিল। তবে ব্যর্থতার জন্য উত্তর প্রদেশের চৌরিচৌরা থানায় অগ্নি সংযোগের ঘটনা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনকে দায়ী করা হয়।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions