লাহোর প্রস্তাব ১৯৪০
ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ প্রস্তাব মুসলমানদের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। বস্তুত: লাহোর প্রস্তাব ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে মুসলিম লীগ পরিচালিত আন্দোলনের পরিণতিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয় ।
লাহোর প্রস্তাব এর প্ৰেক্ষাপট
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৩৭ সালে প্রদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত প্রাদেশিক নির্বাচনে অধিকাংশ প্রদেশে কংগ্রেস জয়লাভ করে। এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশেও কংগ্রেস জয়লাভ করে। মুসলিম লীগের পরাজয় মুসলিম নেতৃবৃন্দকে শংকিত করে তোলে। এমন এক বাস্তবতাতে, ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের সাধারণ অধিবেশন আহবান করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজণিত বাস্তবতা, ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ ছাড়াই ভারত সরকারের যুদ্ধে যোগদান এবং ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিতেও মুসলিম লীগের পরাজয়ের কারণ পর্যালোচনাই ছিল অধিবেশনের উদ্দেশ্য। এই অধিবেশনে মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস ও জাতীয়তাবাদী মনোভাব সম্পন্ন মুসলিম নেতাদের তীব্র সমালোচনার কারণে তিনি ধর্মভিত্তিক জাতির ধারণাকে সামনে তুলে ধরে, হিন্দু-মুসলিমদের দুটি জাতি হিসাবে দাবী করেন। জিন্নাহর সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবী, এক পর্যায়ে লাহোরে অনুষ্ঠিত উপরোক্ত অধিবেশনের মূল সুর হয়ে ওঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক একটি প্রস্তাব পেশ করেন। জিন্নাহর সভাপতিত্বে প্রস্তাবটি সভায় গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবই ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব নামে পরিচিত।
লাহোর প্রস্তাব এর বৈশিষ্ট্য:
লাহোর প্রস্তাবের মূল বৈশিষ্ঠ্যসমূহ নিম্নরূপ:
১. ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সংলগ্ন বা সন্নিহিত স্থানসমূহকে পৃথক অঞ্চল হিসেবে গণ্য করতে হবে।
২. ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যে সকল স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করতে হবে।
৩. এসব স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে প্রয়োজনবোধে ভারতবর্ষের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর সীমানা পুন:নির্ধারণ করতে হবে।
৪. এসব স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যসমূহ হবে সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত।
৫. ভারতের ও নবগঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা রাখতে হবে ।
৬. পরবর্তীতে দেশের যেকোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনায় উক্ত বিষয়গুলোকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
লাহোর প্রস্তাব এর ফলাফল ও তাৎপর্য
লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব। এ প্রস্তাবের কোথাও পাকিস্তান শব্দটি ছিল না। তথাপি এ প্রস্তাব ‘পাকিস্তান প্রস্তাব' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ প্রস্তাব ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে পৃথক আবাসভূমির স্বপ্ন বপন করে। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ লাহোর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
লাহোর প্রস্তাব মুসলিম লীগকে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ভারতের মুসলিমদের পক্ষে জনমত তৈরি হতে থাকে । ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল এর প্রমাণ ।
১৯৪৬ সালে জিন্নাহর নেতৃত্বে দিল্লি মুসলিম লেজিসলেটরস কনভেনশন এ মুসলমানদের একাধিক রাষ্ট্র পরিচালনাকে বাদ দিয়ে এক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। এটি ছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। তথাপি, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে দু'টি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল নিয়ে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান এবং বাকি অংশ নিয়ে গঠিত হয় ভারত।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions