নীল বিদ্রোহ
নীল বিদ্রোহ: শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বিশেষ করে ১৮ শতকে নীল ব্যবসা খুবই লাভজনক হয়ে উঠেছিল। বস্ত্রশিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কাপড় রং করার জন্য ব্রিটেনে নীলের চাহিদা খুব বেড়ে গিয়েছিল। ইংরেজরা বাংলার কৃষককে নীল চাষে বাধ্য করে।
নীল চাষের জন্য নীলকররা কৃষকদের সবথেকে উৎকৃষ্ট জমিটাই বেছে নিতো। কৃষকদের নীলচাষের জন্য অগ্রীম অর্থ গ্রহণে (দাদন) বাধ্য করা হতো। আর একবার এই দাদন গ্রহণ করলে সুদ-আসলে যতই কৃষকরা ঋণ পরিশোধ করুক না কেন, বংশ পরম্পরায় কোনো দিনই ঋণ শোধ হতো না।
নীল চাষে কৃষকরা রাজি না হলে তাদের উপর চরম অত্যাচার চালানো হতো। বাংলাদেশে নীলের ব্যবসা ছিল একচেটিয়া ইংরেজ বণিকদের। ফরিদপুর, ঢাকা, পাবনা, যশোর, রাজশাহী, নদিয়া, মুর্শিদাবাদে ব্যাপক নীল চাষ হতো। ফলে এই সব অঞ্চলের মানুষ ধীরে ধীরে এক দীর্ঘ সংগ্রামের পথ বেছে নেয়।
তাছাড়া প্রথম দিকে ইংরেজরা চাষিদের বিনামূল্যে নীল বীজ সরবরাহ করা। পরের দিকে তা বন্ধ করে দিলে নীল চাষ কৃষকদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তারা চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায়। এ অবস্থায় নীলকররা বাংলার গ্রামাঞ্চলে শুধু ব্যবসায়ী রূপে নয় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক অভিনব অত্যাচারী জমিদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরা এতটাই নিষ্ঠুর আর বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে অবাধ্য নীল চাষিকে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি। ফলে নীল চাষিদের বিদ্রোহ হয়ে ওঠে সময়ের দাবি, চরম অত্যাচার আর শোষণে বিপর্যস্ত দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নীল চাষিরা ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রচণ্ড বিদ্রোহে ফেটে পড়ে । গ্রামে গ্রামে কৃষকরা সংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এই সব বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় নীল চাষিরাই ।
বাংলার এ অঞ্চলে যশোরের নীল বিদ্রোহের নেতা ছিলেন নবীন মাধব ও বেনী মাধব নামে দুই ভাই। হুগলীতে নেতৃত্ব দেন বৈদ্যনাথ ও বিশ্বনাথ সর্দার। নদীয়ায় ছিলেন মেঘনা সর্দার এবং নদীয়ার চৌগাছায় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস নামে দুই ভাই। স্থানীয় পর্যায়ের এই নেতৃত্বে বাংলায় কৃষক বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। কৃষকরা নীল চাষ না করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। এমনকি তারা ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের উপদেশও অগ্রাহ্য করে।
এদিকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি নীল চাষিদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব প্রকাশ করতে থাকে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী ছাপা হতে থাকে। দীনবন্ধু মিত্রের লেখা 'নীলদর্পণ' নাটকের কাহিনী চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রথম বারের মতো বাংলার সংগ্রামী বিদ্রোহী কৃষকদের জয় হয়।
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ‘ইন্ডিগো কমিশন' বা নীল কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের সুপারিশের উপর ভিত্তি করে কৃত নানা সংস্কারের প্রেক্ষিতে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। পরবর্তিকালে নীলের বিকল্প কৃত্রিম নীল আবিষ্কৃত হওয়ায় ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে এদেশে নীলচাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comment below if you have any questions